বাংলাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি যে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছে তাতে জনগণ কতটা উদ্বুদ্ধ হবে, তা নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। বিএনপি অবশ্য বলছে, তাদের এই আন্দোলনে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। আন্দোলনে তারা ক্রমান্বয়ে জনগণের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চাইছেন।
তবে আওয়ামী লীগ বলছে, বিএনপির এই আন্দোলনকে পাত্তা দিচ্ছেন না তারা। একই সাথে জনগণও বিএনপিকে ত্যাগ করেছে বলে আওয়ামী লীগের দাবি ।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমাদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে এই আন্দোলন যাতে নামসর্বস্ব হয়ে না পড়ে। বাকিটা দেখা যাক।”
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ জনজীবন ও অফিস-আদালত এবং মানুষের কর্মজীবন স্বাভাবিক রয়েছে উল্লেখ করে বলেন, “এখানে কোথায় তারা (বিএনপি) জনগণের সমর্থন পেলো? কোন জনগণের সমর্থন তারা পেয়েছে?”
এর আগে বুধবার, এক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মি. রিজভী বলেন, শেখ হাসিনার বর্তমান সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত তারা অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।
এই কর্মসূচির অংশ হিসেবে, জনগণকে ভোট দিতে না যাওয়া, কর ও সেবার বিল জমা না দেওয়া এবং প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষের প্রতি ভোট বর্জনের আহ্বান জানানো হয়। একই সাথে বিএনপির যেসব নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে তাদেরকেও আদালতে হাজিরা না দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়।
“অবৈধ সরকারকে অসহযোগিতার বিকল্প নেই। সাতই জানুয়ারির ডামি নির্বাচন বর্জন করুন। আপনারা ভোট কেন্দ্র যাবেন না, এটা আপনার অধিকার। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকুন,” বলছিলেন রুহুল কবির রিজভী।
বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর গত ২৮শে অক্টোবর ঢাকায় সমাবেশের পর থেকে দুই-এক দিনের বিরতিতে টানা অবরোধ-হরতাল কর্মসূচি পালন করে আসছে। তারা বর্তমান সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিও জানিয়ে আসছে।
দীর্ঘদিন ধরে চলা দলটির হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচিতে বর্তমানে অনেকটাই ঢিলেঢালা ভাব চলে এসেছে। বিশেষ করে গত মধ্য নভেম্বরের পর থেকেই ঢাকা ও ঢাকার বাইরে হরতাল-অবরোধের প্রভাব কমে আসতে থাকে। এমন অবস্থায় বুধবার নতুন করে অসহযোগ কর্মসূচির ঘোষণা আসলো।
‘ক্রমান্বয়ে উপস্থিতি নিশ্চিত করা হবে’
সরকার পতনের আন্দোলনে থাকা বিএনপি ও সমমনা দলগুলো আগেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে নির্বাচনের প্রচারণা শুরুর দিন থেকেই আরও শক্ত কর্মসূচিতে যাবেন তারা এবং এর মূল উদ্দেশ্য হবে সাতই জানুয়ারির ভোট বর্জন করা।
বুধবার নির্বাচন প্রতিরোধ করার কথা না আসলেও ‘প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সর্বস্তরের মানুষের’ প্রতি ভোট বর্জনের আহবান জানানো হয়েছে।
অসহযোগ আন্দোলনকে জনগণের পরোক্ষ প্রতিরোধ হিসেবে দেখছে বিএনপি। তাই তাদেরকে সংযুক্ত করতে নানা ধরণের ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে তারা।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বিবিসি বাংলাকে বলেন, মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে এরই মধ্যে গণসংযোগ শুরু করা হয়েছে।
এছাড়া লিফলেট বিতরণ করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। এসব লিফলেটে বিএনপির আন্দোলনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করতে বিস্তারিত বর্ণনা থাকবে বলে জানান তিনি।
মি. রিজভী বলেন, তারা তাদের আন্দোলনের বিষয়বস্তু বিভিন্ন সময় জনগণের কাছে তুলে ধরেছেন এবং সেগুলো থেকে সাড়াও পেয়েছেন। আর এই আন্দোলনেও তারা সাড়া পাবেন বলে আশা করছেন।
“সেই যে সাড়া, সেটার উপর ভিত্তি করে আমরা মনে করি যে আমাদের কর্মসূচিতে জনগণের সমর্থন আছে এবং উদ্বুদ্ধকরণ তো আগে থেকেই হয়ে আসছে।”
তিনি বলেন, “বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে আমরা বড় বড় সমাবেশ করেছি, আমরা মিছিল, মিটিং এগুলোর মধ্যেও তো থেকেছি। এটাও তাই হবে। আমরা গণসংযোগ করবো, কথা বলবো।”
এছাড়া গণমাধ্যম ভিত্তিক যেসব প্রযুক্তি আছে সেগুলো ব্যবহার করেও মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
তিনি বলেন, “আমরা মনে করি যে, জনগণের পক্ষের যে কোনও আন্দোলন সফল হবেই। সরকারের নিপীড়ন থাকবে, নির্যাতন থাকবে, নানাভাবে হয়রানি করবে, গ্রেফতার করবে, অত্যাচার থাকবে, অবিচারের সম্মুখীন হবো, সবই তো সরকারের নিয়ন্ত্রণে।”
“লড়াই হয়তো দীর্ঘস্থায়ী হবে, অল্প সময়ের মধ্যেও হতে পারে, তবে পরাস্ত তাদের (আওয়ামী লীগকে) হতেই হবে।”
জনগণের অংশগ্রহণ না থাকলে বা হরতাল-অবরোধের মতো আন্দোলনে ঢিলেঢালা একটা ভাব দেখা গেলে কী করা হবে, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “সে বিষয়ে পরবর্তীতে আলোচনা করে ঠিক করা হবে।”
তিনি আরও বলেন, সরকারি নানা বাধা ও নিপীড়নের পরও তাদের দলীয় নেতাকর্মীরা হরতাল ও অবরোধের মতো কর্মসূচি সফল করতে মাঠে নামছে।
“তারা তাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আন্দোলনের কর্মসূচিকে সফল করার জন্য।”
অসহযোগ আন্দোলন পরোক্ষ প্রতিরোধের মতো উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখানে জনগণকে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে হবে।
“আমরা ক্রমান্বয়ে চেষ্টা করছি জনগণের উপস্থিতিকে নিশ্চিত করা। জনগণের তো আর নিজস্ব সেনাবাহিনী নেই, পুলিশ বাহিনী নেই, সে তার অবস্থান নিয়ে, স্ট্র্যাটেজি (কৌশল) নিয়ে কাজ করছে,” বলেন তিনি।
“আমাদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে এই আন্দোলন যাতে নামসর্বস্ব হয়ে না পড়ে। বাকিটা দেখা যাক।”
মি. রিজভী বলেন, অসহযোগ আন্দোলন সফল করতে গিয়ে যদি কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যে সরকার ক্ষমতায় আসবে, সেই সরকার তাদেরকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থা করবে। এমন প্রতিশ্রুতির কথা এরই মধ্যে নেতাকর্মীদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
‘জনগণের সমর্থন কোথায়?’
আওয়ামী লীগ অবশ্য বলছে, বিএনপি যে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে তার প্রতি আসলে দেশের জনগণের কোন সমর্থন নেই। বরং তারা ওই দলটির আন্দোলনের নামে করা নানা ধরনের কর্মকাণ্ডকে প্রত্যাখ্যান করেছে বলেই আওয়ামী লীগের দাবি।
বিএনপির নতুন ঘোষিত আন্দোলন কর্মসূচিকে আওয়ামী লীগ কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে এমন প্রশ্নের উত্তরে দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বলেন, “বিএনপি কি এখন কোনো রাজনৈতিক দল আছে নাকি? তারা তো রাজনৈতিক দল থেকে আস্তে আস্তে সন্ত্রাসী দলে পরিণত হয়ে গেছে। এই সন্ত্রাসীদের কর্মকাণ্ড নিয়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে আমাদের তো ভাবনার কিছু নেই।”
তিনি বলেন, বাংলাদেশের অন্যান্য যেসব রাজনৈতিক দল আছে তাদের সম্পর্কে আওয়ামী লীগ চিন্তাভাবনা করতে পারে। কিন্তু বিএনপিকে নিয়ে ভাবার কিছু নেই।
“তাদেরকে নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ভাববে। দেশে সন্ত্রাস করে কেউ যাতে জনজীবন বিপর্যস্ত করতে না পারে সেই জন্য তারা পদক্ষেপ নেবে। এটা তো আওয়ামী লীগের কোনও বিষয় না।”
তিনি বলেন, বিএনপি আন্দোলনের নামে যেসব কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে তাতে জনগণের অংশগ্রহণ নেই। জনগণ তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করেছে।
“বিএনপির সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে যে তারা(জনগণ) প্রত্যাখ্যান করেছে তা তো রাস্তার চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। তাদের হরতাল-অবরোধের নামে যে কর্মসূচি, এগুলো তো জনগণ কোনওটাই মানছে না। সারাদিন তো রাস্তায় হাজার হাজার গাড়ি।”
জনজীবন ও অফিস-আদালত এবং মানুষের কর্মজীবন স্বাভাবিক রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এখানে কোথায় তারা জনগণের সমর্থন পেলো? কোন জনগণের সমর্থন তারা পেয়েছে?”
“কিছু চোর-ডাকাত আর খুনিদের সমর্থন পেয়েছে। ওদের সমর্থন নিয়ে ওরা জঙ্গি সংগঠন হিসেবেই থাকুক।”
সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে বলে জানান মি. আলম।
তিনি বলেন, “আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আছে। যেভাবে বাংলাদেশে ইতিপূর্বে জঙ্গী দমন করেছে, বা বিভিন্ন সময় জঙ্গী সংগঠন দমন করেছে, এদেরকেও সেভাবেই দমন করা হবে।”
বিএনপির কর্মসূচিকে ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন মাহবুবুল আলম হানিফ। এর সাথে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
“যারাই ঘটনার সাথে জড়িত, বিএনপির যেসমস্ত নেতারা, তাদের নির্দেশে মাঠে যারা কাজ করছে, নির্দেশদাতা, হুকুমদাতা এবং যারা কাজ করতেছে, প্রত্যেককে আইনের আওতায় এনে বিচার করে কঠোর শাস্তি দেয়া হবে”, মন্তব্য করেন তিনি।