ছবির উৎস, Getty Images
আগামী সাতই জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে
বাংলাদেশের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে এক শতাংশ ভোটারে স্বাক্ষর বিষয়ক গরমিলের অভিযোগে চারশর বেশি স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল হওয়ার পর তাদের করা আপিলের এখন নিষ্পত্তি করছে নির্বাচন কমিশন।
গণপ্রতিনিধিত্ব আইন অনুযায়ী কোন নির্বাচনী এলাকায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে হলে প্রার্থীকে ওই আসনের মোট ভোটারের এক শতাংশের সমর্থনের তালিকা মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দিতে হয়। যারা সমর্থন করবেন, সেই তালিকায় তাদের স্বাক্ষর বা টিপসই থাকতে হবে। তবে আগে সংসদ সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হয়ে থাকলে বা দলীয় প্রার্থী হলে এটা জমা দিতে হবে না।
এগুলো যাচাই বাছাইয়ের সময় স্বাক্ষর দানকারী ভোটারকে পাওয়া যায়নি কিংবা তার স্বাক্ষর মিলেনি- এ ধরনের নানা অভিযোগে এবার ৪২৩ জন প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল করেছিলো নির্বাচন কমিশন।
এর বিরুদ্ধে প্রার্থীরা যে আপিল করেছেন তার শুনানির প্রথম দিনে রোববার বাছাইয়ে বাদ পড়া ৫৬ জন তাদের প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন। এছাড়া ৩২ জনের প্রার্থিতা নামঞ্জুর হয়েছে এবং ছয়টিই আবেদন সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রাখা হয়েছে।
প্রার্থিতা বাতিল হওয়া অনেকেই এক শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর তদন্ত করতে গিয়ে ‘সত্যিকার ভাবে যাচাই বাছাই না করেই প্রাথমিকভাবে তাদের প্রার্থিতা বাতিল করায়’ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
এমন দুজন প্রার্থীর একজন বিবিসিকে বলেছেন তিনি আপিল করে প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন। আরেকজন আপিলেও প্রার্থিতা ফিরে না পাওয়ায় উচ্চ আদালতে যাবেন বলে জানিয়েছেন।
এক বিশ্লেষক বলছেন, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের এই এক শতাংশের সমর্থনের বিধানটিই তার মতে আইনসিদ্ধ নয়। এছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিপাকেও ফেলতেও এ বিধানটির সুযোগ নেয়ার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে বলে জানান তিনি।
প্রসঙ্গত, আগামী সাতই জানুয়ারি বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি সহ নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ত্রিশটির মতো দলের প্রার্থীরা ছাড়াও সাতশোর বেশি স্বতন্ত্র প্রার্থী এবার মনোনয়ন পত্র দাখিল করেছেন।
তবে বিরোধী দল বিএনপি ও সমমনা বেশ কিছু দল এ নির্বাচন বর্জন করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছে।
একনজরে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ সময়সূচি
স্বতন্ত্র ও এক শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর
মূলত দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে দল থেকে বহিষ্কৃত হতে হবে না- ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দিক থেকে এমন বক্তব্য আসার পর দলটির বতর্মান এমপিদের যারা মনোনয়ন পাননি অথবা যারা নতুন করে মনোনয়ন চেয়ে পাননি, এমন অনেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থিতার আবেদন করেছেন।
মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনের (ইসি) দেয়া তথ্য অনুযায়ী, মোট ৭৪৭ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন, যা আগের যে কোন নির্বাচনের চেয়ে অনেক বেশি।
এর আগে ২০১৮ সালের নির্বাচনে মোট ৪৯৮ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলেন এবং তাদের মধ্যে ১২৮ জন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।
আর ২০১৪ সালের নির্বাচনে প্রায় দেড়শ স্বতন্ত্র প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন এবং তাদের মধ্যে ১০৪ জন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।
ওই নির্বাচনেও অবশ্য এবারের মতো বিএনপি ও সমমনা কিছু বিরোধী দল বর্জন করেছিলো। সেবার ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার রেকর্ড করেছিলেন।
কিন্তু প্রতিটি নির্বাচন এবং এর মধ্যবর্তী বিভিন্ন উপ-নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মনোনয়নপত্রের সাথে দেয়া এক শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর নিয়ে নানা সমস্যা দেখা দিয়েছিলো।
এসব স্বাক্ষর যাচাই করতে যাওয়া পুলিশ দেখে ভোটারের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে অনেক জায়গায়। কোন কোন ক্ষেত্রে ভোটারকে না পাওয়ার কারণে প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিলের পর আপিলে তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
এই বিধানটি গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে যুক্ত করা হয় ২০১১ সালে।
ছবির উৎস, Getty Images
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে জমা পড়া প্রায় পৌনে তিন হাজার মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই করে ৭৪৭ জনের প্রার্থিতা বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন।
কয়েকজন প্রার্থীর বক্তব্য
এবারের নির্বাচনে যারা মেহেরপুর-২ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলেন তাদের মধ্যে একজন হলেন মোখলেছুর রহমান। এক শতাংশ ভোটারের তথ্য ভুল থাকার কারণ দেখিয়ে কমিশন শুরুতে তার প্রার্থিতা বাতিল করে দিয়েছিলো।
রোববার আপিল শুনানিতে প্রার্থিতা ফিরে পেয়ে বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেছেন মাঠে যারা পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে গিয়েছিলো তারা ভোটারের কাছে না গিয়েই রিপোর্ট দিয়েছিলো।
“যেই ভোটারকে না পাওয়ার কথা বলা হয়েছিলো তিনি নিজে আজ এসে এফিডেভিট দিয়ে বলেছেন যে তিনিই স্বাক্ষর দিয়েছেন এবং তিনি আমাকে সমর্থন করেন,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মি. রহমান।
অন্যদিকে টাঙ্গাইল-৫ আসনের খন্দকার আহসান হাবিবের প্রার্থিতা বাতিল হয়েছিলো এই কারণে যে তিনি যেসব ভোটারের স্বাক্ষর নিয়েছেন তাদের মধ্যে একজনের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।
রোববার আপিল শুনানিতে তার আপিল না মঞ্জুর হওয়ায় এখন তিনি উচ্চ আদালতে যাবেন বলে বিবিসিকে জানিয়েছেন।
“তারা পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেট নিয়া ভোটার খুঁজতে গেছে। স্বতন্ত্র প্রার্থীর জন্য স্বাক্ষর করে ভোটার কি নিজের ঠিকানায় বসে থাকবে? মানুষের তো কাজকর্মও থাকে। তারা স্বাক্ষর পরীক্ষা করতে পারতো। যাই হোক আমি এখন উচ্চ আদালতে যাবো,” বিবিসি বাংলাকে বলেছেন তিনি।
নেত্রকোনা-৫ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন। এক শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষরে ত্রুটির কথা বলে রিটার্নিং অফিসার তার মনোনয়নপত্র বাতিল করেছিলো।
তিনি এর বিরুদ্ধে আপিল করেছেন। রোববার সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন যে তার কাছে মনে হয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নির্বাচন থেকে দূরে রাখার কৌশল এটি।
“আমার মতো একজন মানুষের এক শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষরে বিষয়ে অভিযোগ তুলে প্রার্থিতা বাতিল করা হয়েছে, এটি গুরুতর বিষয়। এ আইনটি পরিবর্তন হওয়া উচিত”।
এ মাসের শুরুর দিকে এই বিধানের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে একটি রিটের আবেদন করেছিলেন একজন আইনজীবী। যদিও ওই বেঞ্চ আগেই এই আইনের অন্য একটি বিধান নিয়ে শুনানি করায় রিটের আবেদনটি কার্যতালিকা থেকে বাদ করে দেন।
পরবর্তীতে অন্য বেঞ্চে রিট আবেদনটি তোলা হবে বলে রিট আবেদনকারীর আইনজীবী জানিয়েছেন।
ছবির উৎস, BNP MEDIA CELL/ BABUL TALUKDER
বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো নির্বাচন বর্জন করছে।
কেন এত সমালোচনা
এক শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষরের বিষয়টি নিয়ে গত কয়েকটি নির্বাচনের সময়েই অনেক সমালোচনা হয়েছে। এ নিয়ে নানা ধরনের ঘটনাও ঘটেছে বিভিন্ন উপ-নির্বাচনে।
নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও বেসরকারি সংস্থা জানিপপের চেয়ারম্যান প্রফেসর নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলছেন এ আইনটির অপব্যবহারের ভয়ংকর সব ঘটনার অভিযোগ তাদের কাছে অনেক প্রার্থীই করেছেন।
“অনেক ক্ষেত্রে স্বাক্ষরদাতা ভোটারকে ভয় কিংবা প্রলোভন দেখিয়ে সরে পড়তে বাধ্য করার ঘটনাও ঘটছে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রার্থী হওয়া স্বতন্ত্রদের কারও কারও এমন অভিজ্ঞতা এবারও হয়েছে বলে আমরা জেনেছি,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
তার মতে আইনটি নির্বাচনে প্রার্থী হবার যোগ্যতা সম্পর্কে সংবিধানে যেসব বিধি বিধান আছে তার সাথেও সাংঘর্ষিক।
“সংবিধানে তো বলাই আছে প্রার্থী হবার যোগ্যতা কি? সেখানে তো এই এক শতাংশের কথা নেই। এ নিয়মটিই থাকা উচিত নয়। তাছাড়া এটি ভোটারের গোপনীয়তারও লঙ্ঘন। এখানে আগেই এক শতাংশ ভোটারকে তিনি কাকে ভোট দিবেন বা সমর্থন দিবেন সেটি প্রকাশ করতে বাধ্য করা হচ্ছে”, বলছেন অধ্যাপক কলিমউল্লাহ।
আইনের বিধান হওয়ায় এই বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে চাননি নির্বাচন কমিশনের কোন কর্মকর্তা।
তবে রবিবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের বলেছেন, ”যারা প্রত্যাখ্যান হয়েছেন, অথবা যাদের আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে, দুটোর বিরুদ্ধেই আপিল হতে পারে। পুরো কমিশন বসে আমরা আপিলগুলো শুনবো। শুনে আমাদের সিদ্ধান্ত দেবো।”
ওদিকে রোববার থেকে শুরু হওয়া বাতিল হওয়া প্রার্থীদের আপিল শুনানি মোট ছয় দিন চলবে। তাতেও সন্তুষ্ট না হলে কমিশনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোনও ব্যক্তি চাইলে উচ্চ আদালতে যেতে পারবেন।
নির্বাচনের তফসিল অনুযায়ী সতেরই ডিসেম্বর প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন পার হওয়ার পর এবারের নির্বাচনের চূড়ান্ত প্রার্থী সংখ্যা জানা যাবে।