বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার প্রতিবাদে সোমবার বিরোধী দল বিএনপির ডাকা ৪৮ ঘণ্টার হরতালের দ্বিতীয় দিন চলছে।
অন্যদিক নির্বাচনী প্রস্তুতির অংশ হিসাবে মনোনয়ন পত্র বিক্রি চলছে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে।
সোমবার সকাল থেকে ঢাকার গাবতলী, মিরপুর, শ্যামলী, কল্যাণপুরসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এদিনে রাজধানীতে যান চলাচল স্বাভাবিক দিনের তুলনায় কিছুটা কম চোখে পড়েছে। তবে গণপরিবহনের পাশাপাশি কিছু ব্যক্তিগত গাড়িও চলাচল করতে দেখা গেছে। আগের হরতাল বা অবরোধের তুলনায় যান চলাচল বেড়েছে।
শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ও অফিস-আদালত খোলা থাকার কারণে যান চলাচল কম থাকায় ভোগান্তিতে পড়েছেন অনেক যাত্রী। অনেক যাত্রীকে রাস্তায় গাড়ির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে।
বিবিসির সংবাদদাতার জানাচ্ছেন, সকাল নয়টার কিছু পর পর্যন্ত অফিসগামী যাত্রীদের ভিড় ছিল। কিন্তু সকাল সাড়ে নয়টা ও ১০টার পর থেকে ভিড় কমে রাস্তা ফাঁকা হতে শুরু করে।
কল্যাণপুর এলাকায় একজন সিএনজি চালকের সাথে কথা হলে তিনি জানান, সকালে কিছুটা ভাড়া পাওয়া গেলেও দিনের অন্যান্য সময় রাস্তায় ঘুরে ঘুরেও যাত্রী পাওয়া যায় না।
আর এই চিত্র শুধু সোমবার হরতালের সময় হচ্ছে, সেটি নয়। বরং বিএনপির ডাকা হরতাল ও অবরোধের পুরোটা সময়েই সকাল ছাড়া অন্য সময়ে ভাড়া কম পাওয়া গেছে বলে জানান তিনি।
গাবতলি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সকালে গণপরিবহন কিছুটা চলাচল করলেও সাড়ে দশটার পর যান চলাচল কমে এসেছে। যাত্রীর অভাবে দূর পাল্লার গাড়ি ছেড়ে যায়নি।
গাবতলী বাস টার্মিনাল এলাকায় কয়েকজন গাড়ি চালকের সাথে কথা হলে তারা জানান, গত প্রায় ৭-৮ দিন ধরে টার্মিনালে আটকা পড়েছেন তারা। যাত্রী কম থাকার কারণে বাস নিয়ে টার্মিনালে পৌঁছালেও যাত্রীর অভাবে তারা আর ছেড়ে যেতে পারেননি।
এক চালক জানান, স্বাভাবিক সময়ে প্রতি মাসে ১৭-১৮টি করে ট্রিপ দেন তিনি। কিন্তু হরতাল ও অবরোধের কারণে গত এক মাসে মাত্র তিনটি ট্রিপ দিতে পেরেছেন। যার কারণে অর্থ সংকটের দিনযাপন করতে হচ্ছে তাকে।
তফসিল ঘোষণার প্রতিবাদে রোববার ভোর ছয়টা থেকে বিএনপির ৪৮ ঘণ্টার হরতাল শুরু হয়। এটি চলবে মঙ্গলবার সকাল ছয়টা পর্যন্ত।
ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, সোমবার সকাল থেকে বেলা সাড়ে বারটা পর্যন্ত রাজধানীর কোথাও আগুন দেয়ার ঘটনা সম্পর্কে জানা যায়নি। তবে এর আগের দিন রাজধানীতে তিনটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে বলেও জানানো হয়।
এর আগে গত ২৮শে অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর বিএনপি একদিনের জন্য হরতালের ডাক দিয়েছিল। এরপর থেকে পাঁচ দফায় মোট ১০ দিন অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে দলটি।
বিএনপি নির্বাচনে আসলে ফিরিয়ে দেবে না কমিশন
বিএনপিসহ যে বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে আসার বিষয়ে এখনো কোন ঘোষণা দেয়নি, তারা মত পাল্টে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চাইলে তাহলে তাদের বিষয়টি বিবেচনা করে দেখা হবে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা।
নির্বাচন কমিশনে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি সরাসরি বিএনপির নাম না নিলেও দলটির প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, “ওনারা যদি ফিরতে চান, ইতিপূর্বেও আমার জানা মতে, ওনারা একটু পরেই এসেছিলেন এবং ওনারা সে সুযোগটা পেয়েছিলেন। ওনারা যদি আসতে চান, ইচ্ছা প্রকাশ করেন, সেক্ষেত্রে কীভাবে কী করা যাবে, নিশ্চই আমরা সেটা নিয়ে আলোচনা করবো, সিদ্ধান্ত নেবো।”
“ওনারা আসতে চাইলে নিশ্চই আমরা ওয়েলকাম করবো, ওনারা আসছে চাইছেন, আমরা ফিরায় দিবো, এটা হবে না।”
বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ওনারা নির্বাচনে না আসলে এক ধরণের শূন্যতা থাকবে এবং এটা অস্বীকার করার উপায় নেই।
তবে তফসিল ঘোষণার পর কোন রাজনৈতিক দল নির্বাচনে আসতে চাইলে সেখানে আইনগত প্রক্রিয়া কী আছে- সেসম্পর্কে সাংবাদিকরা জানতে চাইলেও তা নিয়ে বিস্তারিত কিছু জানাননি তিনি। মিজ সুলতানা বলেন, এমন অবস্থার মুখোমুখি এখনো তারা হননি।
“আসলে তো বিবেচনা করবোই। আমরা তো চাই সব দলের অংশগ্রহণে একটা সুন্দর ইলেকশন হোক। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ওনারা এসেছিল। সেসময় তাদেরকে একটু স্পেস দেয়া হয়েছিল।”
মাঠের রাজনীতি শান্ত কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, যখনই একটা বিভাজন তৈরি হয়ে গেছে তখন রাজনীতি একটু পাল্টে গেছে। তবে পরিস্থিতি অশান্ত হয়েছে বলে সেটা শান্ত হবে না বলে মনে করেন না তিনি। তিনি বলেন, “এটা যেকোনো সময় শান্ত হতে পারে।”
যারা নির্বাচনে অংশ নেবে তাদের উদ্দেশ্যে তিনি আহ্বান জানিয়ে বলেন, “আপনার আমাদের প্রতি আস্থা রাখেন, আসেন, ইলেকশন করেন, নিঃসন্দেহে আপনারা একটা ভাল, সুষ্ঠু, সুন্দর, ইলেকশন করার সুযোগ পাবেন এবং ভোটাররা এসে স্বাধীনভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে, তাদের যাকে ইচ্ছা তাকে মনোনীত করবে। নিশ্চই আমরা সেটা করার চেষ্টা করবো।”
রাজনৈতিক যে সংকট তৈরি হয়েছে সেটার উদ্যোগ নেয়ার আর কোন সুযোগ আছে বলে তিনি মনে করেন না। কারণ তফসিল এরইমধ্যে ঘোষণা করা হয়ে গেছে। এই সুযোগটা নির্বাচন কমিশনের কখনোই ছিল না বলে জানান তিনি।
রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন ফরম বিক্রি
রাজধানীসহ সারা দেশে বিএনপির হরতালের মধ্যেও থেমে নেই নির্বাচনে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক দলগুলোর মনোনয়ন কার্যক্রম।
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম বিক্রি শনিবার থেকে শুরু হয়ে এখনো চলছে। সোমবার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে মনোনয়ন ফরম কিনতে আসতে শুরু করেছেন রাজধানী ঢাকার আশেপাশের জেলার মনোনয়ন প্রত্যাশীরা।
গুলিস্তান এলাকা থেকে বিবিসির সংবাদদাতা শাহনেওয়াজ রকি জানাচ্ছেন, সকাল থেকেই আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য এমপি প্রার্থীরা মনোনয়ন কিনতে এসেছেন। তারা বাস ও ট্রাকে করে ঢাকার বাইরে থেকে সমর্থকদের নিয়ে এসেছেন।
রাজধানীর গুলিস্তান, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও শহীদ মিনার চত্বর এলাকায় বাস-ট্রাকে করে সমর্থক ঢাকার বাইরে থেকে এনে নামানো হচ্ছে। এসব এলাকা থেকে তাদেরকে নিয়ে দলীয় স্লোগান দিতে দিতে মনোনয়ন ফরম কিনতে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ের দিকে যাচ্ছেন অনেকে।
গুলিস্তান এলাকায় সাধারণ গণপরিবহনের সংখ্যা কম হলেও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে ঢাকায় পৌঁছেছে এমন যানবাহনের সংখ্যা বেশ চোখে পড়েছে। একই কারণে ওই এলাকায় মানুষের বেশ ভিড় রয়েছে বলেও জানান মি. রকি।
শনিবার থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু হওয়ার পর এরইমধ্যে গত দুই দিনে দুই হাজার ২৮৬টি ফরম বিক্রি করেছে বলে দলটি জানায়। এরমধ্যে বেশিরভাগ মনোনয়ন ফরম সম্ভাব্য প্রার্থীরা দলীয় কার্যালয়ে সশরীরে উপস্থিত হয়ে কিনেছেন। আর মাত্র ৩২টি মনোনয়ন ফরম অনলাইনে বিক্রি করা হয়েছে।
এদিকে রোববার পর্যন্ত জাতীয় পার্টি বলে এসেছে যে, তারা নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা তা নিশ্চিত নয়। কিন্তু এদিন সন্ধ্যায় এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে দলটি জানায়, সোমবার সকাল থেকে মনোনয়ন বিক্রি করা শুরু করবে তারা।
সকাল ১১টার পর থেকে রাজধানীর বনানী কার্যালয় থেকে মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু হয়। সকাল থেকে জাতীয় পার্টির তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা দলীয় কার্যালয়ের কাছে এসে অবস্থান নেন।
জাতীয় পার্টির মনোনয়ন ফরম বিক্রির এই কার্যক্রম আগামী ২১শে নভেম্বর পর্যন্ত চলবে বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
এরআগে তফসিল ঘোষণায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আওয়াল জানান, আগামী সাতই জানুয়ারি নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য মনোনয়ন পত্র দাখিলের শেষ দিন ৩০শে নভেম্বর। আর মনোনয়নপত্র যাচাই বাছাই করা হবে আগামী এক থেকে চার ডিসেম্বর। সর্বশেষ ১৭ই ডিসেম্বর প্রার্থিতা প্রত্যাহার করা যাবে।
হরতালের পক্ষে-বিপক্ষে মিছিল
হরতালের সমর্থনে বিএনপির নেতাকর্মীরা রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্ষোভ মিছিল করেছে।
বিএনপির ডাকা হরতালের সমর্থনে ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিল করেছেন। রাজধানীর মগবাজার, কারওয়ান বাজার ও দয়াগঞ্জ চৌরাস্তা এলাকায় হরতালের পক্ষে মিছিল করে বিএনপি। এই মিছিলের নেতৃত্ব দেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
ঢাকায় তোপখানা রোড, পুরানা পল্টন, দক্ষিণ খান এলাকায়ও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে।
রাজধানীর বাইরে শেরপুর, মাদারীপুর, বগুড়া, লক্ষীপুর, মেহেরপুর, নোয়াখালী, সিলেট, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, জয়পুরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, হবিগঞ্জ, ভোলা, কক্সবাজার জেলায় বিএনপির ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল করেছে।
হরতালের বিপক্ষে রাজশাহীসহ কয়েকটি জেলায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিক্ষোভসহ নানা ধরনের কর্মসূচির খবর পাওয়া গেছে।