আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে একসাথেই পেনশন স্কিমে আসবেন। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষকদের সঙ্গে বৈঠকের পর একথা জানান মি. কাদের।
বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শিক্ষকরাও সরকারি কর্মকর্তাদের মতো চলতি বছরের পরিবর্তে আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৫ সালের পহেলা জুলাই থেকে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের আওতায় আসবেন।
মি. কাদের সরকারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত জানিয়ে শিক্ষক নেতাদের চলমান কর্মবিরতি কর্মসূচি প্রত্যাহারের আহবান জানিয়েছেন। শিক্ষক নেতারা জানিয়েছেন, রাতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনা করবেন তারা।
“সবার জন্য পেনশন কর্মসূচিতে শিক্ষকদের বিষয়টি নিয়ে যে তথ্য গেছে সেটি একটি মিসটেক (ভুল)। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ২০২৪ সালের পহেলা জুলাই থেক যোগ দেয়ার খবর সঠিক নয়। শিক্ষক, সরকারি কর্মকর্তাসহ সবাই ২০২৫ সালের পহেলা জুলাই পেনশন কর্মসূচিতে আসবেন,” বৈঠকের পর ব্রিফিং এ বলছিলেন মি. কাদের।
অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক নিজামুল হক ভুঁইয়া বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয় স্কিমে’ শিক্ষকরা যাচ্ছেন না, এটা নিশ্চিত করা হয়েছে।
“আমরা বলেছিলাম যে চলতি বছরের জুলাই থেকে ‘প্রত্যয় স্কিমে’ আমরা যোগ দিবো না। মন্ত্রী মহোদয় বলেছেন যে এটি ভুলবশত এসেছে। সবাই আগামী বছর থেকে একসাথে পেনশন স্কিমে আসবে। বাকী বিষয়গুলো প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনায় সিদ্ধান্ত হবে,” বলছিলেন মি. ভুঁইয়া।
প্রসঙ্গত, সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয় স্কিমের’ প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার ও শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের দাবিতে গত পহেলা জুলাই থেকে শিক্ষক-কর্মচারীদের ক্লাস পরীক্ষা বর্জন করে আসছেন ৩৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
এর আগে তারা ‘প্রত্যয় স্কিম’ বাতিলের জন্য সরকারকে গত ৩০শে জুন পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। তাদের অভিযোগ ছিলো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সাথে আলোচনা ছাড়াই সরকার এটি চাপিয়ে দিয়েছে।
গত মার্চে ‘প্রত্যয়’ পেনশন স্কিম চালুর ঘোষণার পর থেকেই এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন। স্কিমটি প্রত্যাহারের দাবিতে সরকারি প্রতি আহবান জানিয়ে বেশকিছু কর্মসূচি পালনের পর গত চৌঠা জুন প্রথম অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালন করেন শিক্ষকরা।
এরপর টানা তিন দিন অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালনের পর পহেলা জুলাই থেকে কর্মবিরতি পালন করে আসছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)সহ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
এ কর্মবিরতির ফলে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস-পরীক্ষা, অনলাইন, সান্ধ্যকালীন ক্লাস, শুক্র ও শনিবারের প্রফেশনাল কোর্সের ক্লাস বন্ধ ছাড়াও পরীক্ষা বর্জন করেন তারা। এমনকি বিভাগীয় অফিস, সেমিনার, কম্পিউটার ল্যাব ও গবেষণাগারও বন্ধ রাখা হয়।
শিক্ষকদের এ কর্মবিরতির মধ্যেই গত চৌঠা জুলাই মি. কাদেরের সঙ্গে একবার শিক্ষকদের বৈঠকের কথা বলা হলেও তখন বৈঠকটি আর হয়নি। ফলে শিক্ষকরাও তাদের কর্মসূচি চালিয়ে আসছিলেন।
বৈঠকে কী হলো
বৈঠক সূত্র জানিয়েছে শিক্ষকদের পক্ষ থেকে প্রত্যয় স্কিম ছাড়াও, শিক্ষকদের জন্য সুপারগ্রেডে অন্তর্ভুক্তি এবং শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল চালুর দাবি তুলে ধরা হলে মি. কাদের শিক্ষকদের নিশ্চিত করেন যে চলতি বছরের জুলাই থেকে প্রত্যয় স্কিম শিক্ষকদের জন্য প্রযোজ্য হবে না।
তবে অন্য বিষয়গুলো নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সব পক্ষের আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে হবে বললে শিক্ষক নেতারাও তার সঙ্গে একমত পোষণ করেন।
ব্রিফিংয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মর্যাদা, সুবিধা ও অসুবিধাগুলো নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
“বিশেষ করে তাদের দাবি দাওয়া সরকারের উচ্চ পর্যায়ে তুলে ধরবো । পরবর্তী সিদ্ধান্ত আলাপ আলোচনা করে নিবো। আলোচনার ভিত্তিতে আশা করি সব সমস্যার অচিরেই সমাধান হবে,” বলছিলেন তিনি।
তিনি বলেন সর্বজনীন পেনশন স্কিমে আগামী বছর থেকে সবাই আসবেন, শিক্ষক সরকারি কর্মকর্তা সবাই । “সবারই স্কিমে আসার তারিখ হলো ২০২৫ সালের পহেলা জুলাই”।
জানা গেছে বৈঠকে সরকারের সিদ্ধান্ত জানিয়ে ওবায়দুল কাদের কর্মবিরতি প্রত্যাহারের আহবান জানালে শিক্ষক নেতারা ফেডারেশনের বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা জানান।
অধ্যাপক নিজামুল হক ভুঁইয়া বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন যে আজ শনিবার রাতেই তাদের বৈঠকে বসার কথা রয়েছে।
প্রত্যয় স্কিমের বিরোধিতা কেন?
বাংলাদেশে গত বছরের অগাস্টে চালু করা হয়েছিল সর্বজনীন পেনশন স্কিম। তখন এতে চারটি স্কিম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এর সাত মাসের মাথায় গত মার্চে এতে যুক্ত করা হয়েছিলো ‘প্রত্যয়’ নামে নতুন এই স্কিম।
এ স্কিমের আওতায় স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা এবং তাদের অধীনস্থ অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলোকে রেখে দুটি আলাদা প্রজ্ঞাপন জারি করা হয় গত তেরই মার্চ। এরপর বিশেই মার্চ অর্থ মন্ত্রণালয় স্কিমটির বিষয়ে বিস্তারিত জানায়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছিলো ২০২৪ সালের পহেলা জুলাই থেকে এসব প্রতিষ্ঠানে যারা যোগদান করবেন তাদের বাধ্যতামূলকভাবে সার্বজনীন পেনশনের সর্বশেষ স্কিমের আওতাভুক্ত করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেতারা তখন থেকেই বারবার বলে আসছিলেন যে এ স্কিমে যোগ দিলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বর্তমানে থাকা বেশ কিছু অবসর সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন।
বিদ্যমান পেনশন স্কিম অনুযায়ী, বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যে পেনশন পান সে জন্য বেতন থেকে কোন টাকা কাটা হয় না। নতুন স্কিমে কাট হবে দশ শতাংশ।
বিদ্যমান ব্যবস্থায় কেউ অধ্যাপক পদ থেকে অবসরে গেলে গ্র্যাচুইটি পান ৮০ লাখ ৭৩ হাজার টাকা, নতুন স্কিমে সেটি পাওয়া যাবে না।
অবসরে গেলে অধ্যাপকরা এখন মাসিক পেনশন পান ৪৫ হাজার ৭৯০ টাকা যার বিপরীতে বেতন থেকে কোনো টাকা কাটা হবে না।
প্রত্যয় স্কিমে যুক্ত হলে বেতন থেকে কেটে ও প্রতিষ্ঠানের টাকায় পেনশন পাওয়া যাবে মাসে ১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এককালীন কোনো টাকা পাবেন না পেনশনাররা। বর্তমানে প্রতি বছর পেনশনে ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট হলেও প্রত্যয় স্কিমে সেটি বাড়বে না।
বিদ্যমান ব্যবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ৬৫ বছরে, কর্মকর্তারা ৬২ এবং কর্মচারীরা ৬০ বছরে অবসরে যান। নতুন ব্যবস্থায় সবাইকে অবসরে যেতে হবে ৬০ বছর বয়সে।
বিদ্যমান ব্যবস্থায় শিক্ষকরা অর্জিত ছুটির বিপরীতে টাকা পেলেও সেই ব্যবস্থা নেই নতুন পেনশন স্কিমে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা ভাতা, উৎসব ও বৈশাখী ভাতা কিংবা এলপিআর সুবিধা পান। কিন্তু নতুন পেনশন স্কিমে সেটি থাকবে কি না সেটি স্পষ্ট করা নেই।
অন্য চার পেনশন স্কিম
সর্বজনীন পেনশন স্কিমের উদ্যোগের শুরুতে সরকার মোট ছয়টি স্কিমের কথা ঘোষণা করে। তবে প্রাথমিকভাবে চালু হয় চারটি স্কিম। সেগুলো হলো:
এটি শুধু বিদেশে কর্মরত বা অবস্থানকারী বাংলাদেশি নাগরিকের জন্য। এর মাসিক চাঁদার হার ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার, সাড়ে সাত হাজার ও ১০ হাজার টাকা করে।
ব্যক্তি চাইলে এই চাঁদার সমপরিমাণ অর্থ তিনি যে দেশে আছেন সে দেশের মুদ্রায় দিতে পারবেন। আবার দেশে এসে দেশি মুদ্রায়ও দিতে পারবেন। এছাড়া প্রয়োজনে প্রবাস স্কিম পরিবর্তনেরও সুযোগ থাকছে।
এই স্কিম বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের জন্য। এক্ষেত্রেও তিন ভাগে চাঁদার হার ভাগ করা হয়েছে।
কেউ চাইলে মাসে দুই হাজার, তিন হাজার বা পাঁচ হাজার টাকা করে দিয়ে এই স্কিমে অংশ নিতে পারবে।
আবার প্রতিষ্ঠান বা প্রতিষ্ঠানের মালিকও প্রগতি স্কিমে অংশ গ্রহণ করতে পারবে। সেক্ষেত্রে মোট চাঁদার অর্ধেক কর্মচারী এবং বাকি অর্ধেক প্রতিষ্ঠান বহন করবে।
এই স্কিমটা স্বনির্ভর ব্যক্তির জন্য। অর্থাৎ কেউ কোথাও চাকরি করছেন না কিন্তু নিজে উপার্জন করতে পারেন, তারা সুরক্ষা স্কিমে অংশ নিতে পারবেন।
এর আওতায় পড়েন ফ্রিল্যান্সার, কৃষক, শ্রমিক ইত্যাদি পেশার লোকজন।
এই স্কিমে চাঁদার হার চার রকম- মাসে এক হাজার, দুই হাজার, তিন হাজার ও পাঁচ হাজার টাকা করে।
এই স্কিমে চাঁদার হার একটিই – এক হাজার টাকা। তবে এক্ষেত্রে প্রতিমাসে ব্যক্তি দেবে পাঁচশ টাকা আর বাকি পাঁচশো দেবে সরকার।
মূলত দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসরত স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য এই স্কিম। দারিদ্রসীমা নির্ধারণ করার দায়িত্ব বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর।
যেমন বর্তমানে বছরে যাদের আয় ৬০ হাজার টাকার মধ্যে তারাই কেবল এই স্কিমের অন্তর্ভুক্ত হবেন।