ছবির উৎস, Ahmed Noor
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর সাম্প্রতিক একটি বৈঠকের ছবি বিভিন্ন মহলে বেশ কৌতূহল ও আলোচনার জন্ম দিয়েছে। কেউ কেউ একে ‘গোপন বৈঠক’ বলেও অভিহিত করছেন।
বৈঠকটি এমন একটি সময় অনুষ্ঠিত হয়েছে, যখন গৃহকর বাড়ানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে প্রায় প্রতিদিনই নগরীর কোথাও না কোথাও প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ সমাবেশ করছেন সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ব্যবসায়ী ও বাসিন্দারা।
অন্যদিকে, গৃহকর বাড়ানোর জন্য বর্তমান মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী না কি সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী দায়ী, সেটি নিয়েও দু’জনের পক্ষে-বিপক্ষে নানান আলোচনা ও যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করতে দেখা যাচ্ছে।
এমনকী, বর্তমান এবং সাবেক ওই দুই নগরপিতা নিজেরাও আলাদা সংবাদ সম্মেলন করে এ বিষয়ে নিজ নিজ অবস্থান সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরছেন।
ঠিক এমন একটি সময়ে তাদের বৈঠকের ছবি সামনে আসায় সাধারণ মানুষের মধ্যে কৌতূহল ও আলোচনা তৈরি হয়েছে।
কিন্তু সিলেটের বর্তমান এবং সাবেক মেয়র হঠাৎ কেন বৈঠকে বসতে গেলেন? বৈঠকে আলোচনাই বা হল কী নিয়ে?
ছবির উৎস, Ahmed Noor
ঘটনার শুরু যেভাবে
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে নগরীর ব্যবসায়ী ও বাসিন্দাদের একটা অংশ যে ক্ষোভ দেখাচ্ছেন, সেটি সৃষ্টি হয়েছে মূল গৃহকর বাড়ানোকে কেন্দ্র করে।
যদিও বাড়তি করের বিষয়টি কয়েক বছর আগেই চূড়ান্ত করা হয়েছিল বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছে সিটি কর্পোরেশন।
“এ ব্যাপারে মাঠ পর্যায়ে কর পুর্নমূল্যায়নের কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৯-২০ অর্থবছরে। এরপর ২০২১ সালে সেটি চূড়ান্ত করা হয়”, বিবিসি বাংলাকে বলেন সিলেট সিটি কর্পোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা সাজলু লস্কর।
চূড়ান্ত মূল্যায়ন শেষে ২০২১ সালে নতুন হারে গৃহকর ধার্য করা হয় বলে জানিয়েছে সিটি কর্পোরেশন।
এরপর চলতি বছরের ৩০শে এপ্রিল ভবন মালিকদের নোটিশ দিয়ে নতুন হারে হোল্ডিং ট্যাক্স বা গৃহকর পরিশোধের অনুরোধ জানানো শুরু করে সিটি কর্পোরেশন।
ওই চিঠিতে নগরের প্রায় পৌনে এক লাখ ভবন মালিকের গৃহকর অস্বাভাবিক হারে বাড়ানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন নগরীর ব্যবসায়ী ও বাসিন্দারা।
এরপরই নগর জুড়ে দেখা যায় ক্ষোভ ও অসন্তোষ।
“আগে আমার যেখানে সাড়ে সাতশ টাকার মতো কর আসতো, এবার সেখানে এসেছে নব্বই হাজার টাকা”, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন সিলেট শহরের একজন বাসিন্দা গোলাম কাদের।
ক্ষোভ প্রকাশ করে মি. কাদের আরও বলেন, “এখন যা শুরু হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে বাড়ি ঘর রাখা সম্ভব হবে না। বিক্রি করে কর দিতে হবে।”
একইভাবে ক্ষোভের কথা জানাচ্ছিলেন মেহেদী হাসান নামের আরেকজন স্থানীয় বাসিন্দা।
তিনি জানান যে আগে যেখানে তার বসতবাড়ির কর আসতো তিনশ টাকা, এবছর সেখানে সাত হাজার টাকার বেশি কর ধার্য করা হয়েছে।
“অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে যেন সিটি কর্পোরেশনই বাড়ির মালিক, আর আমরা ভাড়া দিয়ে থাকতেছি”, বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. হাসান।
অবশ্য করের বিষয়ে কোনও অভিযোগ বা আপত্তি থাকলে আবেদন করা যাবে বলে জানিয়েছে সিটি কর্পোরেশন।
ফলে অভিযোগ জানাতে এখন সবাই যেখানে ছুটছেন।
একই সঙ্গে, সাধারণ নাগরিকের ব্যানারে নগরীতে অনেকেই বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করছেন।
নতুন করাদেশ দ্রুত স্থগিত করার আহ্বান জানাচ্ছেন তারা।
ছবির উৎস, Ahmed Noor
‘পাঁচ থেকে পাঁচশ গুণ বৃদ্ধি’
সিলেট সিটি কর্পোরেশন এলাকায় অবস্থিত বসতবাড়ি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের উপর বাড়তি কর আরোপের প্রতিবাদে চলতি মে মাসের শুরু থেকে প্রায় প্রতিদিনই বিক্ষোভ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে আসছেন ভুক্তভোগীরা।
নতুন নীতিতে সর্বনিম্ন পাঁচ গুণ থেকে শুরু করে কয়েকশ গুণ পর্যন্ত কর বাড়ানো হয়েছে বলে অভিযোগ করছেন তারা।
“সিটি কর্পোরেশন থেকেই আমরা জানতে পেরেছি যে, এবার পাঁচ থেকে শুরু করে পাঁচশ গুণ পর্যন্ত কর বাড়ানো হয়েছে”, বিবিসি বাংলাকে বলেন বিক্ষোভ কর্মসূচির এক সংগঠক।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তি আরও বলেন, “এটি একটি অকল্পনীয় বিষয় এবং এ ধরনের সিদ্ধান্তকে আমরা গণপরিপন্থী মনে করি। কাজেই এটি দ্রুত স্থগিত করা হোক।”
সিটি কর্পোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, নতুন তালিকায় আবাসিক ভবনে প্রতি বর্গফুট পাঁচ টাকা এবং বাণিজ্যিক ভবনের ক্ষেত্রে প্রতি বর্গফুট আট টাকা হারে গৃহকর নির্ধারণ করা হয়েছে।
“আইন মেনে যৌক্তিকভাবেই করের এই হার নির্ধারণ করা হয়েছে”, বিবিসি বাংলাকে বলেন সিলেট সিটি কর্পোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা সাজলু লস্কর।
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ২৭টি পুরনো ওয়ার্ড এবং ১৫টি নতুন ওয়ার্ড রয়েছে।
এর মধ্যে পুরনো ওয়ার্ডগুলোর উপর নতুনভাবে কর ধার্য করা হয়েছে।
২৭টি ওয়ার্ডে বর্তমানে ৭৫ হাজার ৪৩০টি বসতবাড়ি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে বলে জানিয়েছে সিটি কর্পোরেশন।
এগুলো থেকে চলতি অর্থ-বছর ১১৩ কোটি ২৭ লাখ টাকা কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সিটি কর্পোরেশন।
এছাড়া নতুনভাবে যুক্ত হওয়া ১৫টি ওয়ার্ডের উপর নতুন হারে কর ধার্য করার বিষয়টি আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে।
ছবির উৎস, Ahmed Noor
পাল্টাপাল্টি অভিযোগ
কর বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে ক্ষমতা গ্রহণের ছয় মাসের মাথায় নগরবাসীর ‘রোষানলের মুখে’ পড়েছেন সিলেটের মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী।
এমন পরিস্থিতির জন্য সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকেই দায়ী করছেন বর্তমান মেয়রের সমর্থকরা।
“বর্তমান মেয়র তো ক্ষমতা নিয়েছেন ছয় মাস আগে। অথচ নতুন করের বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়েছে সাবেক মেয়রের সময় ২০২১ সালে”, বিবিসি বাংলাকে বলেন বর্তমান মেয়রের এক সমর্থক।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তি আরও বলেন, “এখন রাজনৈতিকভাবে ক্ষতি করার জন্যই উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমাদের নেতার বিরুদ্ধে মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে।”
যদিও বর্তমান মেয়রের সমর্থকদের এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী।
গত বৃহস্পতিবার নিজ বাসভবনে আয়েজিত সংবাদ সম্মেলনে মি. চৌধুরী বলেন, “আমাদের বিগত পরিষদ অ্যাসেসম্যান্ট করেছিলো। কিন্তু সে অ্যাসেসমেন্টে যে পরিমাণ গৃহকর দেওয়ার বিষয়টি এসেছে, সেটা অসহনীয় বলে নাগরিকেরা মতামত দিয়েছিলেন।”
“আর সে কারণেই ওই সময় গৃহকর স্থগিত করেছিলাম”, বলেন সিলেট সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী।
ছবির উৎস, Ahmed Noor
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর বৈঠকের যে ছবিটি নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা হচ্ছে, সেটি তোলা হয়েছে গত শুক্রবার।
ওইদিন সন্ধ্যায় সিলেটের স্থানীয় একটি পত্রিকার কার্যালয়ে তারা বৈঠক করেন বলে বিবিসি বাংলাকে জানান সিলেট সিটি কর্পোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা সাজলু লস্কর।
তবে বৈঠকটি পূর্ব-পরিকল্পিত বা গোপন কোনও বৈঠক ছিল না বলে দাবি করেছেন তিনি।
“মেয়র সাহেব আসলে সেদিন দৈনিক সিলেট মিররের সম্পাদকের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন। পরে সেখানেই হঠাৎ করে সাবেক মেয়রের সঙ্গে দেখা হয়ে গেছে”, বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. লস্কর।
তবে স্থানীয় ওই গণমাধ্যমের কার্যালয়ে যাওয়ার আগে সাবেক মেয়রের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেছিলেন বর্তমান মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী।
“ওই এলাকাতেই সাবেক মেয়র থাকেন। সে জন্যই তার খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য মেয়র সাহেব ফোন দিয়েছিলেন”, বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. লস্কর।
তিনি আরও বলেন, “এরপর বর্তমান মেয়রের অবস্থান জানতে পেরে সাবেক মেয়র হুট করেই পত্রিকা অফিসে চলে আসেন।”
দেখা হওয়ার পর বর্তমান এবং সাবেক মেয়র বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করেন। সেই আলোচনার এক পর্যায়ে নতুন করারোপের বিষয়টিও উঠে আসে।
বৈঠক পরিকল্পিত?
ছবির উৎস, Ahmed Noor
“বর্তমান পরিস্থিতিতে কী করা যায়, সে বিষয়ে সাবেক মেয়রের কাছ থেকে বেশ কিছু পরামর্শ নিয়েছেন বর্তমান মেয়র”, বিবিসি বাংলাকে বলেন সিলেট সিটি কর্পোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা সাজলু লস্কর।
স্থানীয় যে পত্রিকার কার্যালয়ে বর্তমান এবং সাবেক মেয়রের দেখা হয়েছে, সেটির সম্পাদক আহমেদ নূর।
বৈঠকে কী নিয়ে আলোচনা হয়েছে, সে বিষয়ে তিনি সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর সঙ্গে পরে কথা বলে জেনেছেন।
“তিনি আমাকে বলেছেন যে, বর্তমান মেয়রকে পরামর্শ দিয়েছেন যেন নাগরিকদের সঙ্গে আলাপ করে গৃহকরের হার যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করা হয়”, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মি. নূর।
এ ব্যাপারে কোনও সহযোগিতা দরকার হলে সাবেক মেয়র সেটি করতে রাজি হয়েছেন বলেও জানান তিনি।
এদিকে, জনসংযোগ কর্মকর্তা মি. লস্কর বিবিসি বাংলাকে বলেন, “মেয়র মহোদয় বিষয়টি আন্তরিকভাবে নিয়েছেন এবং ইতিমধ্যেই বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে কথা বলা শুরু করে দিয়েছেন।”
তিনি আরও বলেন, করের বিষয়ে অভিযোগ জানানোর শেষ তারিখ ছিল চলতি মাসের ১৪ তারিখ। সেটির মেয়াদ বাড়িয়ে এখন ২৮শে মে করা হয়েছে।
“মেয়র যেহেতু নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, কাজেই নাগরিকদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়, তেমন কোনও সিদ্ধান্তই তিনি নিবেন না বলে জানিয়েছেন”, বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. লস্কর।