বাংলাদেশে এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রধান শ্লোগান ছিল ‘স্মার্ট বাংলাদেশে’ নির্মাণ।
বিজয়ী হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন তাতে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ আর অর্থনীতিসহ বিভিন্ন খাতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার চেষ্টা কতটা প্রতিফলিত হয়েছে তা নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা হচ্ছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।
নতুন মন্ত্রিসভার শপথের পরদিন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নিজেও বলেছেন যে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক- এই তিনটি চ্যালেঞ্জই শেখ হাসিনার নতুন সরকারকে আগামীতে মোকাবিলা করতে হবে।
তবে এটি যে খুব একটা সহজ হবে না সেটি উল্লেখ করে এর কারণ হিসেবে তিনি বৈশ্বিক বাস্তবতার কথা তুলে ধরেছেন।
তবে বৈশ্বিক বাস্তবতা যাই হোক, দেশ থেকে অর্থ পাচার, রিজার্ভের পতন, রেমিট্যান্স প্রবাহ, ব্যাংক খাতের অনিয়ম, মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির জেরে দ্রব্যমূল্য আকাশচুম্বী হওয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের সাথে সম্পর্কের অবনতির মতো বিষয়গুলো মোকাবেলার জন্য রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন মন্ত্রিসভায় কতটা ঘটেছে তা নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা হচ্ছে।
বিশেষ করে মন্ত্রিসভায় অনেক নতুন মুখ আসলেও অর্থমন্ত্রী হিসেবে প্রবীণ সংসদ সদস্য ও সাবেক কূটনীতিক আবুল হাসান মাহমুদ আলীর মনোনয়ন অনেককেই বিস্মিত করেছে। অনেকে অবাক হয়েছেন নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে নিয়েও।
তবে দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলছেন মন্ত্রিসভায় বড় আকারের পরিবর্তনের মধ্যেই সংকট মোকাবেলার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম মনে করেন, আগের সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় নিষ্ক্রিয় ছিলো বলেই সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ। ফলে সেখানে পরিবর্তনটা এক ধরনের বার্তা দেয়।
পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ডঃ আহসান এইচ মনসুর বলছেন, অর্থ, পরিকল্পনা, বাণিজ্য ও পররাষ্ট্রে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছেন প্রধানমন্ত্রী।
“কী চিন্তা করে এটা তিনি করেছেন সেটা হয়তো আমরা জানিনা। তবে এসব ব্যক্তিরা আগ্রহ নিয়ে কাজ করলে আর কোন গোষ্ঠীর হয়ে কাজ না করলেই দেশ উপকৃত হবে”।
চ্যালেঞ্জগুলো কোথায়: মন্ত্রিসভায় তা কতটা গুরুত্ব পেলো
বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন এ মুহুর্তে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি বড় সংকট হলো পশ্চিমা বিশ্বের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন ঘটানো।
গত সাতই জানুয়ারি বিরোধী দল বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর বর্জনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের যে নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা টানা চতুর্থ বারের মতো ক্ষমতায় এলেন, সেই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমারা।
এছাড়া ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে আলোচনা আছে যে ২০২১ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলার সাথে দূরত্ব তৈরি হওয়ার পর থেকে বর্তমান পর্যায়ে আসা পর্যন্ত যত ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো বিদায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন ও প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সামাল দিতে পারেননি।
বরং অনেক সময় মন্ত্রীর বক্তব্য সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলেছে এবং কিছু ক্ষেত্রে পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্যোগী হতে হয়েছে।
কিন্তু সবাইকে বিস্মিত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সরকারেরই এক সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রবীণ সংসদ সদস্য আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে অর্থমন্ত্রী করেছেন। আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী করেছেন গত সরকারের তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদকে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগসূত্র আছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের। সেখানে নতুন মন্ত্রী হয়ে এসেছেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আব্দুস সালাম।
আবার ইউক্রেন যুদ্ধের জের ধরে দেশের অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হওয়ার পর মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় গত দু’বছর ধরে দ্রব্যমূল্য নিয়ে দুঃসহ অবস্থায় রয়েছে দেশের মানুষ। এ নিয়ে বিদায়ী বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশীকে বিভিন্ন সময়ে ব্যাপক সমালোচনা সইতে হয়েছে।
অথচ নতুন মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রী বাণিজ্য মন্ত্রী রাখেননি। আবার প্রতিমন্ত্রী বানিয়েছেন আহসানুল ইসলামকে, যিনি এবারই প্রথম মন্ত্রিসভায় আসলেন।
অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলছেন, “অর্থ, বাণিজ্য ও পরিকল্পনা- তিন জায়গাতেই নতুন মন্ত্রী এসেছেন । অর্থমন্ত্রী যাকে করা হয়েছে কূটনীতির ক্ষেত্রে তার সুনাম আছে, সততা নিয়ে প্রশ্ন নেই। পরিকল্পনাতেও নতুন মানুষ। বাণিজ্যে তরুণ প্রতিমন্ত্রী আসলেও তিনি ব্যবসায়ী হিসেবে অভিজ্ঞ। তারা আন্তর্জাতিক বিষয়গুলো বুঝে কাজ করলে ভালো কাজের সুযোগ আছে”।
অন্যদিকে অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলছেন, অর্থমন্ত্রীর কূটনীতির ক্ষেত্রে দীর্ঘকাল পদচারণা থাকলেও তিনি অর্থনীতির ছাত্র ও শিক্ষক ছিলেন। অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্বেও ছিলেন অনেকদিন।
“আশা করি তিনি গত অর্থমন্ত্রীর চেয়ে ভালো করবেন। আগের মন্ত্রী নিষ্ক্রিয় ছিলেন এবং তার অদক্ষতার কারণে অর্থনৈতিক সংকট সামাল দেয়া যায়নি। আশা করি নতুন অর্থমন্ত্রী অর্থ খাতের সংকট মোকাবেলায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে পারবেন”।
তিনি বলেন, রিজার্ভ সংকট, ডলারের দাম বৃদ্ধি, রেমিট্যান্স হ্রাস পাচ্ছে, পুঁজি পাচারের মতো বিষয়গুলো সামাল দিতে হলে কঠোর হাতে পদক্ষেপ নেয়ার সদিচ্ছা থাকলে ভালো ফল পাওয়া সম্ভব হবে।
তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, এসব বিষয়ের সঙ্গে অনেক প্রভাবশালী মহলের স্বার্থ জড়িত থাকে, যাদের অনেকে আবার সরকারের ঘনিষ্ঠ। ফলে অনেক ক্ষেত্রে আইন বা নিয়ম থাকার পরেও কঠোর পদক্ষেপ নিতে দেয়া যায়নি। সেসব ক্ষেত্রে নতুন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা কতটা ভূমিকা রাখতে পারবেন, তার ওপরে অনেক কিছু নির্ভর করবে।
আহসান এইচ মনসুর বলছেন, যেই চিন্তা থেকেই হোক না কেন, যেসব খাতে সংকট ছিলো সেগুলোতে পরিবর্তন এনেছেন প্রধানমন্ত্রী ।
“এখন নতুন করে যারা এসেছেন তারা সংকট অনুধাবন করে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বুঝে দেশের স্বার্থে কাজ করলে ভালো করার সুযোগ আছে। তারা কী ডেলিভারি করেন সেটাই হবে সামনে দেখার বিষয়,” বলছিলেন তিনি।
এর বাইরে শেখ হাসিনার গত দুটি সরকারের সময়ে বার বার আলোচনায় এসেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এবারেও নতুন পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা সমালোচনা চলছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আগের সরকারের শিক্ষা উপমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের তরুণ নেতাদের একজন মহিবুল হাসান চৌধুরীকে। তরুণ প্রতিমন্ত্রী পেয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগও।
স্বাস্থ্য খাতে বিশেষ করে করোনা মহামারির সময় টিকা সংগ্রহ করে সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জনগণকে দেয়ার চ্যালেঞ্জ সরকার ভালোভাবে মোকাবেলা করলেও এ খাতে দুর্নীতির অভিযোগ বারবার গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে গত পাঁচ বছর।
এখন সেই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন সুপরিচিত চিকিৎসক সামন্ত লাল সেন। টেকনোক্র্যাট কোটায় নিয়োগ পাওয়া মি. সেন এবারই প্রথম মন্ত্রিসভায় এলেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডঃ আব্দুল খালেক বলছেন, “গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে পরিবর্তন করার মাধ্যমে শেখ হাসিনা জনগণকে একটি বার্তা দিয়েছেন। এর আগে দলের এমপি মনোনয়ন দেয়ার সময় ৭০ জনকে বাদ দেয়ার মাধ্যমেই তিনি বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন”।
“আমার ধারণা সবকিছু বিশ্লেষণ করেই শেখ হাসিনা তার টিমমেটদের বেছে নিয়েছেন। যেসব খাতে চ্যালেঞ্জ ছিলো তার প্রতিটিতেই অভিজ্ঞদের এনেছেন। পাশাপাশি শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে নির্ভর করেছেন তারুণ্যের ওপর। সবমিলিয়ে মন্ত্রিসভা গঠনের মধ্যেই সরকারের স্মার্ট বাংলাদেশ ও সংকট নিরসনের চেষ্টার প্রতিফলন আছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
ওদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের শনিবার টুঙ্গিপাড়ায় বলেছেন দলের ইশতেহার বাস্তবায়নে অনেক প্রতিবন্ধকতা আসতে পারে কারণ যারা নির্বাচন বর্জন করেছে তারা নতুন করে ষড়যন্ত্র করছে।
“তারা বিদেশী বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে আছে কবে কম্বোডিয়ার মতো একটা নিষেধাজ্ঞা হয়তো এখানে আসবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কোন নিষেধাজ্ঞা বা ভিসা নীতির পরোয়া করেন না”।
যদিও বিশ্লেষকরা অনেকে মনে করেন নিষেধাজ্ঞার মতো কোন কঠিন পরিস্থিতির মুখে যেন বাংলাদেশকে না পড়তে হয়, সেটা নিশ্চিত করাও নতুন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে।