ছবির উৎস, A F Hassan Ariff & Associates
অন্তর্বর্তী সরকারের বিমান ও পর্যটন এবং ভূমি উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ মারা গেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর।
শুক্রবার বেলা তিনটার দিকে তিনি নিজ বাড়িতে অচেতন হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
তার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
উপদেষ্টা হাসান আরিফের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তার সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মো. আবেদ চৌধুরী।
বিবিসি বাংলাকে তিনি জানান, “গত দুদিন ধরেই তিনি সর্দি জ্বরে ভুগছিলেন। অসুস্থ শরীরেই গতকাল (বৃহস্পতিবার) বেলা ৩টা থেকে ৬টা পর্যন্ত মিটিং করেছেন। আজ জুমার পর তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।”
উপদেষ্টা হাসান আরিফের ছেলে মুয়াজ আরিফের বরাতে বাংলাদেশের কয়েকটি গণমাধ্যম জানিয়েছে, তার বাবা হঠাৎ করে মেঝেতে পড়ে যান।
এরপরে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
পারিবারিক সূত্রে জানা গিয়েছে, শুক্রবার বাদ এশা ধানমন্ডি ৭ নম্বর বায়তুল আমান মসজিদে তার প্রথম নামাজে জানাজা সম্পন্ন হবে। এরপর তার লাশ বারডেমের হিমঘরে রাখা হবে।
শনিবার বেলা ১১টায় হাইকোর্ট প্রাঙ্গনে দ্বিতীয় নামাজে জানাজা অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে।
এরপর বাদ জোহর তার লাশ মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করার কথা রয়েছে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
তার মৃত্যুর খবর পাওয়ার সাথে সাথে হাসপাতালের বাইরে ভিড় করেন উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও তার শুভানুধ্যায়ীরা।
ছবির উৎস, A F Hassan Ariff & Associates
হাসপাতালের বাইরে সাংবাদিকদের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানান, “হাসান আরিফ সবচেয়ে অ্যাকটিভ, সবচেয়ে উদ্যোগী উপদেষ্টাদের একজন ছিলেন। তিনি উচ্ছ্বল প্রাণবন্ত মানুষ ছিলেন।”
পরিবেশ বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানান, “আইন অঙ্গনে এমন সৎজন, ভদ্র, বিদ্বান, ভদ্র, প্রাজ্ঞ আইনজীবী খুঁজে পাওয়া আসলেই দুষ্কর। হাসান আরিফের মৃত্যু মানে আইনজীবী হিসেবে একজন প্রতিষ্ঠানের চলে যাওয়া।”
এদিকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস শুক্রবার বিকালে দুবাই থেকে তাকে বহনকারী একটি বিমান ঢাকায় অবতরণের সঙ্গে সঙ্গে উপদেষ্টা হাসান আরিফের মৃত্যুর খবর জানতে পারেন। এই খবরে তিনি ভীষণ মর্মাহত হয়েছেন বলে জানান প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
খবর পেয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের এই উপদেষ্টাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে বিমানবন্দর থেকে হাসপাতালে ছুটে যান ড. ইউনূস।
শোক বার্তায় প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘তার (হাসান আরিফ) আকস্মিক মৃত্যুতে আমি গভীরভাবে শোকাহত। উপদেষ্টা হাসান আরিফ একজন শীর্ষ আইনজীবী ছিলেন, যিনি অন্তর্বর্তী সরকারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।’
ছবির উৎস, A F Hassan Ariff & Associates
ফখরুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবং দেশের একজন অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্বপালনসহ তার বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে কয়েক দশকব্যাপী জনসেবাকেও গভীর শ্রদ্ধা জানান ড. ইউনূস।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘তিনি একজন উজ্জ্বল আইনজীবী হিসেবে এবং তার আইনি সক্রিয়তা এবং ভিন্নমতাবলম্বী, ভিন্নমতের কণ্ঠস্বর এবং আমাদের সমাজের প্রান্তিক মানুষের মানবাধিকার রক্ষার জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।’
প্রধান উপদেষ্টা শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান এবং বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন।
প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, হাসান আরিফ মন্ত্রিসভার প্রতিটি বৈঠকে অংশ নিয়ে তার সুচিন্তিত মতামত দিতেন। আমি আশা করি তিনি যেসব কাজ রেখে গিয়েছেন আমরা যেন সবাই মিলে সেগুলো সম্পন্ন করতে পারি”।
হাসান আরিফের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন, প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ, স্বরাষ্ট্র ও কৃষি উপদেষ্টা মোঃ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার গভীর শোক প্রকাশ করেছেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
ছবির উৎস, A F Hassan Ariff & Associates
গত ৫ই অগাস্ট সরকার পতনের পর ৮ই অগাস্ট বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত হন এ এফ হাসান আরিফ।
পরদিন ৯ই অগাস্ট স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পান এবং ২৭শে অগাস্ট তিনি ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
পরে তাকে ভূমি এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি বর্তমানে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির কমপ্লেক্সের উপদেষ্টার দায়িত্বে আছেন বলে জানিয়েছে বাসস।
পেশাগত জীবনে হাসান আরিফ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ছিলেন।
তিনি বাংলাদেশের সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এবং ফখরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, ভূমি এবং ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
হাসান আরিফ জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার আইনজীবী ছিলেন।
এছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আইন উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন । এর মধ্যে আছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ, সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংক, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং গ্রামীণফোন বাংলাদেশ।
এছাড়া তিনি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পরামর্শ, নির্মাণ সালিস, বাণিজ্যিক সালিস, অর্থ, ব্যাংকিং এবং সিকিউরিটিজ বিষয়, কর্পোরেট, বাণিজ্যিক ও ট্যাক্সেশন বিষয়, সাংবিধানিক আইন বিষয়, পাবলিক আস্বাদন, আরবিট্রেশন এবং বিকল্প বিরোধ সমাধানের অন্যান্য পদ্ধতি নিয়ে কাজ করেছেন বলে জানা গিয়েছে।
ছবির উৎস, A F Hassan Ariff & Associates
এ এফ হাসান আরিফ ১৯৪১ সালের ১০ই জুলাই কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। এরপর স্নাতক এবং এলএলবি ডিগ্রি সম্পন্ন করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
তার কর্মজীবন শুরু হয় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা হাইকোর্টে। সেখানে ১৯৬৭ সালে আইনজীবী হিসেবে নথিভুক্ত হন তিনি।
এরপর ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশের হাইকোর্টে প্রাকটিস শুরু করেন তিনি। সত্তরের দশকেই তিনি এ এফ হাসান আরিফ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস নামে ল’ ফার্ম প্রতিষ্ঠা করেন।
হাসান আরিফ ২০০১ সালের অক্টোবর থেকে ২০০৫ সালের ২৮শে এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল পদে ছিলেন।
এরপর ২০০৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০০৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত স্বল্প সময়ের জন্য বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইন উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
তিনি আন্তর্জাতিক আরবিট্রেশন সেন্টার (BIAC) এবং সার্ক আরবিট্রেশন কাউন্সিল (SARCO) এর পাশাপাশি আইসিসি ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব আরবিট্রেশনের কোর্ট মেম্বার।
ছবির উৎস, A F Hassan Ariff & Associates