পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মিঠা পানি নদীবেষ্টিত শহর ঢাকা। এই বিশাল মিঠা পানির জলাধার ইতোমধ্যে ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়েছে। তাছাড়া অভিন্ন নদীর পানি উজান থেকে প্রত্যাহার করায় ধীরে ধীরে উত্তরাঞ্চল মরুকরণের দিকে যাচ্ছে এবং দক্ষিণাঞ্চলের নদীগুলোতে লবণাক্ততা বাড়ছে। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ পানির কারণে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় নেমে আসবে।
শুক্রবার রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবে বিশ্ব পানি দিবস উপলক্ষ্যে ‘জীবন ও জীবিকার জন্য পানি’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানটি যৌথভাবে আয়োজন করে পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন আন্দোলন (পরিজা) ও মানবাধিকার উন্নয়ন কেন্দ্র।
পরিজার সভাপতি প্রকৌশলী মো. আব্দুস সোবহানের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক ফেরদৌস আহমেদ উজ্জলের সঞ্চালনায় গোলটেবিল বৈঠকে এসব বিষয়ে বক্তব্য দেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মোস্তাক হোসেন। এ ছাড়া আলোচনা করেন অধ্যক্ষ আকমল হোসেন, মাহবুল হক, ক্যামেলিয়া চৌধুরী প্রমুখ।
বক্তারা বলেন, পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র রক্ষা এবং খাবার পানি সরবরাহ, নৌ চলাচল, কৃষি ও শিল্প উৎপাদনে নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। এদেশে ছোট বড় ৪০৫টি নদী রয়েছে। এরমধ্যে অভিন্ন নদীর সংখ্যা ৫৭টি। ৫৪টি ভারতের এবং ৩টি মিয়ানমারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। দেশের নদীগুলোর ৪৮টি সীমান্ত নদী, ১৫৭টি বারোমাসি নদী, ২৪৮টি মৌসুমী নদী। মানুষের অত্যাচারে নদীগুলো আজ মৃতপ্রায়। উজানে পানি প্রত্যাহারের কারণে উত্তরাঞ্চলের নদীগুলো শুল্ক বালুচরে পরিণত হয়েছে এবং দক্ষিণাঞ্চলের নদীগুলোতে লবণাক্ততা বেড়েই চলেছে। দখল, ভরাট, আর বর্জ্যে নদীগুলো এখন নিস্তব্ধ স্রোতহীন এবং দূষণের ভারে পানি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে জীববৈচিত্র শূন্য হয়ে পড়ছে। ফলে পরিবেশ, প্রতিবেশ, অর্থনীতি, জনস্বাস্থ্য ও জীবন-জীবিকা মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন।
তারা বলেন, দেশের নদীগুলোর প্রায় প্রতিটিরই একই দশা। তিস্তার পানি প্রবাহ ব্যাপক হারে কমে গেছে। পদ্মা, তিস্তা এখন মৃতপ্রায়, যুমনায় পড়েছে চর। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা ও কর্ণফুলী দখল, ভরাট ও দূষণের ভারে বিষাক্ত নিঃশ্বাস ফেলছে। সদরঘাট লঞ্চঘাট এলাকায় বুড়িগঙ্গার পানি বিষাক্ত এত পরিমাণ যে, কোনো জীব বসবাস অনুপযোগী বলে রিপোর্ট পাওয়া গেছে। ঢাকার চারদিকে নদীবেষ্টিত। প্রাকৃতিক পরিবেশ সমৃদ্ধ এ ধরনের শহর পৃথিবীতে বিরল। দূষণ, দখল, ভরাটের ফলে ঢাকার চারপাশের নদীগুলো আজ মৃতপ্রায় এবং এগুলোর অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন। অন্যদিকে এ শহরের প্রায় ৭০ শতাংশ নিম্নাঞ্চল ইতোমধ্যে ভরাট করা হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে পাল্লা দিয়ে চলছে ভরাট কার্যক্রম। ভরাটের এ গতি অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ শতভাগ নিম্নাঞ্চল হারিয়ে যাবে। দেশের অন্যান্য এলাকার মতো ঢাকাতেও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর উদ্বেগজনক গতিতে নিচে নেমে যাচ্ছে। প্রতি বছর ১০ ফুট করে নিচে নেমে যাচ্ছে।
বক্তারা বলেন, ঢাকা মহানগরীতে ১৯৭০ সালে ৪৯টি গভীর নলকূপ ছিল। ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর দূষিত পানি ব্যবহারের অনপুযোগী হওয়ায় ওয়াসা সুপেয় পানির চাহিদার শতকরা ৭৮ ভাগ ১০০টিরও বেশি গভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করছে। এছাড়াও ব্যক্তি পর্যায়ে ২৫০০টি গভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা হচ্ছে। নদীর পানি দূষিত হওয়ার অজুহাতে ওয়াসা একের পর এক গভীর নলকূপ বসিয়ে যাচ্ছে। অথচ ওয়াসাকে নদীর পানি দূষণ রোধে পয়ঃবর্জ্য পরিশোধনে কার্যকর তেমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে না।
তারা বলেন, ভাটির দেশ হিসেবে অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা না পাওয়ায় আমাদের দেশে পানি সংকট আরও ঘনিভূত হচ্ছে এবং নৌ চলাচল, সেচ ব্যবস্থা ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। উত্তরাঞ্চলের নদীগুলো শুষ্ক বালুচরে পরিণত হচ্ছে, দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিদ্যমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে। নদীতে পানি কমে যাওয়া বা না থাকায় ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানি নির্বিচারে উত্তোলন এবং শুষ্ক মৌসুমে নদী শুকিয়ে যাওয়ার কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতিনিয়ত নিচে নেমে যাচ্ছে। খরা মৌসুমে সেচ ও রাসায়নিক সারনির্ভর ধান চাষের ফলে ভূ-উপরিস্থ ও ভূগর্ভস্থ পানি সংকট তীব্রতর হচ্ছে। ভূ-উপরিস্থ ও ভূগর্ভস্থ পানি সংকট মোকাবিলায় আমাদেরকে প্রকৃতিনির্ভর ধান চাষে গবেষণা জোরদার এবং গবেষণালব্ধ ফলাফল মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করতে হবে।
বক্তারা আরও বলেন, উজানে বাঁধ নির্মাণসহ পানি প্রত্যাহার ছাড়াও অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করা হচ্ছে রাস্তাঘাট ও সেতু। যমুনা, মেঘনা-গোমতি, কর্ণফুলি নদীতে সেতু নির্মাণের ফলে প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে উজানে চর পড়ছে, ভাটিতে পানি প্রবাহ কমে যাচ্ছে। পদ্মা নদীতে নির্মাণাধীন সেতুও একই ধরনের প্রভাব ফেলবে। মেঘনা নদীর ওপর শরীয়তপুর-চাঁদপুর এবং গজারিয়া-মুন্সীগঞ্জ সড়কে সেতু নির্মাণে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনা এবং মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হচ্ছে। দেশের বড় বড় নদীতে পিলারবিশিষ্ট সেতু নির্মাণ করা হলে তা শুধুমাত্র নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত ও ক্লাস এবং চর পাড়াকে তরান্বিত করবে না, তা জীববৈচিত্র্যকেও হুমকির মুখে ফেলবে। দেশের নদীগুলো প্রচুর পরিমাণে পলি বহন করায় এসব নদীতে পিলারসমৃদ্ধ ব্রিজের স্থলে ঝুলন্ত ব্রিজ বা টানেল নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বিপুল জনগোষ্ঠির খাদ্য চাহিদা পূরণে সেচ কাজে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করতে হচ্ছে। ৩৮ হাজার গভীর নলকূপ, ১৪ লাখের অগভীর নলকূপ এবং ১৮ লাখের অগভীর পাম্পের মাধ্যমে সেচ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। মোট চাষকৃত জমির প্রায় ৭৫ শতাংশ ভূগর্ভস্থ পানি এবং বাকি ২৫ শতাংশ ভূ-উপরিস্থ পানির দ্বারা সেচ করা হয়। অভিমানায় ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির জর, পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে, বাড়ছে ঝুঁকি। কোনো কোনো এলাকায় সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। উপকূলীয় এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানিতে লবণ পানির অনুপ্রবেশ ঘটে চলেছে। ভূগর্ভে কৃত্রিম রিচার্জ এবং কৃষি কাজে পানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া প্রতিরোধ করা যেতে পারে।