ভারতের সংবাদ পোর্টাল নিউজক্লিকের সম্পাদক সহ দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে দিল্লি পুলিশ। সংবাদ সংস্থা পিটিআই এখবর জানিয়েছে। চীনা অর্থায়নের অভিযোগে সন্ত্রাস দমন আইনে মঙ্গলবার সকাল থেকে ওই পোর্টালের সাংবাদিক ও নিয়মিত লেখকদের বাড়িতে তল্লাশি অভিযান চলে।
সকাল থেকে ৩০টিরও বেশি জায়গায় ৩৭ জন পুরুষ এবং নয় জন নারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ভারতীয় সময় রাত সাড়ে আটটা নাগাদ বাকি সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হলেও পোর্টালের সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থ এবং আরও এক কর্মীকে ছাড়া হয় নি।
পিটিআই রাত নয়টা নাগাদ নিশ্চিত করে যে ওই দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সাংবাদিক অভিসার শর্মা মঙ্গলবার সকালে প্রথম এক্স (আগের টুইটার) – এ লেখেন যে তার বাড়িতে পুলিশ এসেছে।
রাত নয়টা নাগাদ তিনি ফের লেখেন, “দিনভর দিল্লি পুলিশের স্পেশাল সেলের জিজ্ঞাসাবাদের পরে আমি বাড়ি ফিরলাম। প্রতিটা প্রশ্নের জবাব দেওয়া হবে। ভয়ের কিছু নেই। যারা ক্ষমতায় আছে, বিশেষ করে যারা সাধারণ প্রশ্নকেও ভয় পায়, তাদের উদ্দেশ্যে আমি প্রশ্ন তুলতেই থাকব। কোনও মূল্যেই পিছিয়ে আসার প্রশ্ন নেই।”
এই পোর্টালটিতে সরকারের বিভিন্ন নীতি ও কাজকর্ম নিয়ে নিয়মিত প্রশ্ন তোলা হয় এবং ওখানে যারা নিয়মিত লেখেন, তাদের একটা বড় অংশই বিজেপি সরকারের সমালোচক বলে পরিচিত।
তবে সাম্প্রতিক তল্লাশি ও গ্রেপ্তারির সঙ্গে পোর্টালটিতে চীনা অর্থায়নের অভিযোগের যোগসূত্র আছে বলে মনে করা হচ্ছে।
সকাল থেকে শুরু হওয়া তল্লাশি অভিযানের বিরুদ্ধে দিল্লি, বিহার সহ নানা জায়গায় সাংবাদিক ও সমাজকর্রাীম বিক্ষোভ দেখান। এই অভিযানকে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপরে হস্তক্ষেপ বলেই বিক্ষোভকারী ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি মনে করছে।
অগাস্ট মাসে নিউ ইয়র্ক টাইমস এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে লিখেছিল যে অন্য আরও অনেক গণমাধ্যমের সঙ্গে ‘নিউজক্লিক’-এ চীনা অর্থায়ন হয় ঘুরপথে। তারপরেই ভারত সরকার বিষয়টি নিয়ে সরব হয়।
সকাল থেকে শুরু অভিযান
সংবাদ সংস্থা এএনআই জানিয়েছে ৩০টিরও বেশি জায়গায় তল্লাশি অভিযান চলেছে।
ভারতীয় গণমাধ্যমের পরিচিত মুখ অভিসার শর্মা মঙ্গলবার সকালে এক্স-এ (আগেকার টুইটার) করে জানান যে দিল্লি পুলিশ তার বাড়িতে পৌঁছিয়েছে এবং তার ফোন ও ল্যাপটপ নিয়ে যাচ্ছে।
এরপরে আরেক সাংবাদিক ভাষা সিং এক্স-এ লেখেন “এই ফোন থেকে শেষ টুইট। দিল্লি পুলিশ আমার ফোন বাজেয়াপ্ত করছে।“
নিউজক্লিকের সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থকে তার বাড়ি থেকে দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে জানাচ্ছে কয়েকটি সংবাদমাধ্যম।
সংস্থাটির সাংবাদিক ছাড়াও এমন বেশ কয়েকজনের বাড়িতেও তল্লাশি চলছে, যারা নিউজক্লিকের কর্মী নন, কিন্তু নিয়মিত প্রবন্ধ লিখে থাকেন সেখানে। নিয়মিত প্রবন্ধকার, যাদের বাড়িতে তল্লাশি হচ্ছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন সমাজকর্মী তিস্তা সিতলওয়াড এবং বিশিষ্ট সাংবাদিক পরঞ্জয় গুহ ঠাকুরতা, ইতিহাসবিদ সুহেল হাসমি। মিজ সিতলওয়াডকে তার মুম্বাইয়ের বাড়িতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে আরেকটি সংবাদ পোর্টাল ‘দ্য ওয়্যার’।
‘অত্যন্ত উদ্বেগজনক’ : প্রেস ক্লাব অফ ইণ্ডিয়া
নিউজক্লিকের সাংবাদিক ও লেখকদের বাড়িতে অভিযান সম্পর্কে সংস্থাটির কোনও প্রতিক্রিয়া আসে নি, কিন্তু নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে তাদের সংস্থায় চিনা অর্থায়নের অভিযোগ ওঠার পরে সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থ ইণ্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেছিলেন, “এগুলি নতুন কোনও অভিযোগ নয়। আগেও এই অভিযোগ উঠেছে। আমরা সঠিক জায়গায়, অর্থাৎ আদালতেই জবাব দেব কারণ বিষয়টি বিচারাধীন।“
মঙ্গলবারের অভিযান নিয়ে প্রেস ক্লাব অফ ইন্ডিয়া বলেছে, “নিউজক্লিকের সঙ্গে যুক্ত সাংবাদিক ও লেখকদের বাড়িতে অভিযান অত্যন্ত উদ্বেগজনক। আমরা বিষয়টির দিকে নজর রাখছি এবং পরবর্তী সময়ে বিস্তারিত মন্তব্য করা হবে।“
তারা একটি হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করেছে, ‘ডিফেণ্ড মিডিয়া ফ্রিডম’।
নিউজক্লিকের সাংবাদিকদের এই অভিযানের সমালোচনা করে বিবৃতি দিয়েছে নারী সাংবাদিকদের সংগঠন নেটওয়ার্ক অব উইমেন ইন মিডিয়া, ইন্ডিয়া।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “নিউজক্লিক সিনিয়র সাংবাদিক এবং বিজ্ঞানী, ভাষ্যকার এবং কলামিস্টদের বাড়িতে দিল্লি পুলিশের অভিযানের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে এনডব্লিউএমআই।
সংবাদ পোর্টালের সাংবাদিকদের বাড়িতে তল্লাশি অভিযান নিয়ে সরগরম রাজনৈতিক মহলও।
বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ জোটের তরফে বিজেপি সরকারের গণমাধ্যমের ওপরে সাম্প্রতিক আক্রমণের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে।
তারা বলেছে, “আমরা গণমাধ্যম ও সংবিধানে বর্ণিত মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে থাকছি।
“গত নয় বছরে বিজেপি সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে তদন্ত সংস্থাগুলিকে দিয়ে গণমাধ্যমকে দমন ও হয়রানি করেছে। উদাহরণস্বরূপ, বিবিসি, নিউজলন্ড্রি, দৈনিক ভাস্কর, ভারত সংবাদ, কাশ্মীরওয়ালা এবং দ্য ওয়্যারের মতো সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
জোটের তরফে বিবৃতি দেওয়া ছাড়াও পৃথকভাবে কংগ্রেস সহ বিরোধী দলীয় নেতা নেত্রীরা নিউজক্লিকের সাংবাদিকদের বাড়িতে তল্লাশি অভিযান নিয়ে কড়া প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন।
ভারতের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর উড়িষ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “আমার কোনও জবাবদিহি করার দরকার নেই। যদি কেউ অন্যায় করে থাকেন তাহলে তদন্ত সংস্থাগুলি তাদের কাজ করবে। এরকম তো কোথাও লেখা নেই যে আপনার কাছে যদি অবৈধভাবে অর্থ এসে থাকে, কোনও আপত্তিকর কিছু যদি থাকে তাহলেও তদন্ত সংস্থাগুলো কিছু করতে পারবে না!”
নিউ ইয়র্ক টাইমসের রিপোর্ট
এবছর অগাস্ট মাসের পাঁচ তারিখে নিউ ইয়র্ক টাইমস একটি দীর্ঘ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেটি আপডেট করা হয়েছে ১০ তারিখ।
সেখানে লেখা হয় যে চীনের পক্ষে প্রচারণা চালানোর জন্য বিপুল অর্থ খরচ করা হয় বিভিন্ন মাধ্যমে। এগুলির মধ্যে যেমন রয়েছে বিক্ষোভ-আন্দোলনকে অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা দেওয়া, তেমনই রয়েছে গণমাধ্যমে অর্থায়ন।
তারা লিখেছে, “এর মধ্যমণি হলেন একজন ক্যারিশ্মাটিক মার্কিন মিলিয়নিয়ার, নেভিল রয় সিংঘম।“
মি. সিংঘম আদতে শ্রীলঙ্কান বংশোদ্ভূত, তবে তার বাবার সময় থেকেই তারা যুক্তরাষ্ট্র নিবাসী। মি. সিংঘম সাংহাইয়ে তার দপ্তর থেকে কাজ করেন বলে লিখেছে নিউ ইয়র্ক টাইমস। তার বাবা আর্চিবল্ড সিংঘম একজন পরিচিত বামপন্থী বুদ্ধিজীবী।
তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী,”স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এবং জাল সংস্থাগুলির মাধ্যমে মি. সিংঘম চীনা সরকারের মিডিয়া ব্যবস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে থাকেন এবং বিশ্বব্যাপী তাদের প্রচার ব্যবস্থার অর্থায়ন করেন।
“ম্যাসাচুসেটসের একটি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক থেকে ম্যানহাটনের একটি সভাক্ষেত্র, দক্ষিণ আফ্রিকার একটি রাজনৈতিক দল থেকে ভারত আর ব্রাজিলে সংবাদ সংস্থায় মি. সিংঘমের সংস্থাগুলির মাধ্যমে কীভাবে কোটি কোটি মার্কিন ডলার দেওয়া হয়েছে তা খুঁজে বার করা গেছে,” লিখেছে নিউ ইয়র্ক টাইমস।
প্রগতিশীলতার গুণগান করতে গিয়ে চীনা সরকারের বক্তব্যগুলি তুলে ধরা হয় ওই সব সংগঠনগুলির মাধ্যমে, জানিয়েছে ওই পত্রিকাটি।
ওই প্রতিবেদনেই ভারতের নিউজক্লিকের নাম উল্লেখ করেছে নিউ ইয়র্ক টাইমস।
নিউজক্লিকের সঙ্গে চীনা সম্পর্ক
নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে ভারতীয় সংবাদ পোর্টাল নিউজক্লিকের নাম একবারই উল্লেখ করা হয়েছে।
লেখা হয়েছে, “কর্পোরেট তথ্য দেখাচ্ছে যে মি. সিংঘমের নেটওয়ার্ক নিউজক্লিক নামের একটি সংবাদ পোর্টালে অর্থায়ন করেছেন, যারা চীনা সরকারের ভাষ্যগুলি তাদের খবরে আলতো করে ছড়িয়ে দেয়। একটি ভিডিওতে লেখা হয়েছে ‘চীনের ইতিহাস শ্রমিক শ্রেণীকে এখনও উদ্বুদ্ধ করে’।“
ভিডিওটির লিঙ্ক প্রতিবেদনে এম্বেড করে দেওয়া হয়েছে।
সেটিতে ক্লিক করে দেখা গেল ইউটিউবে নিউজক্লিকের চ্যানেলে ২০১৯ সালে ২রা অক্টোবরের একটি ভিডিও সেটি।
গত চার বছরে মাত্রই ৮২৬৯ জন ভিডিওটি দেখেছেন।
ভিডিওর ‘ডেসক্রিপশন’-এ লেখা হয়েছে ১৯৪৯ সালের চীনা বিপ্লবে ৭০ তম বার্ষিকীতে ‘পিপলস ডেসপ্যাচ’ সেই বিপ্লবের ইতিহাস ফিরে দেখেছে এবং কীভাবে একটি সামন্ততান্ত্রিক দেশ থেকে সামাজিক চরিত্রবিশিষ্ট এক বিশ্বশক্তি হয়ে উঠল, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এখনও চীনা বিপ্লবের ইতিহাস শ্রমিক শ্রেণী এবং সারা পৃথিবীর যেখানে যারাই পুঁজিবাদী শোষন ও সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনে বিরুদ্ধে লড়াই করেন, তাদের সবাইকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে।“
ভিডিওটি শুরু হয়েছে মাও সে তুংয়ের একটি ঘোষণা দিয়ে।
প্রশ্ন উঠছে শুধুমাত্র প্রতিবেদনে এক অনুচ্ছেদ উল্লেখ আর একটি ইউটিউব ভিডিও লিঙ্ক দিয়েই কি নিউ ইয়র্ক টাইমস প্রমাণ করে দিল যে নিউজক্লিকে চীনা অর্থায়ন হয়েছে?
মি. সিংঘমকে ওই প্রতিবেদনে উদ্ধৃত করা হয়েছে, যেখানে তিনি চীনা সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ অস্বীকার করেছেন।