কেউ নিষেধাজ্ঞা দেবে না, তলে তলে আপস হয়ে গেছে – আওয়ামী লীগ সাধারন সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের এমন বক্তব্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন আলোচনার সূত্রপাত করেছে। মি. কাদের এই বক্তব্য দেবার একদিন আগেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লন্ডনে বলেছেন, “বেশি স্যাংশন দিলে আমরাও স্যাংশন দিতে পারি।” তিনি আমেরিকাকে ইঙ্গিত করে কড়া সমালোচনা করেছেন। আমেরিকা ইস্যুতে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাধারন সম্পাদকের বক্তব্য আলাদা ধরণের। এটি নিয়েই মূলত কৌতুহল।
মি. কাদের তার বক্তব্যে ভারতের প্রসঙ্গও টেনে এনেছেন। তার কথায় – দিল্লি আছে। আমেরিকার দিল্লিকে দরকার।
“আমরা আছি, দিল্লিও আছে। দিল্লি আছে, আমরা আছি। শত্রুতা কারো সঙ্গে নেই। সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব। শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর কন্যা, এমন ভারসাম্য সবার সঙ্গে করে ফেলেছেন, আর কোনো চিন্তা নেই,” মঙ্গলবার এক সমাবেশে বলেন ওবায়দুল কাদের।
শেখ হাসিনা এবং ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের তাৎপর্য কী? কিংবা এসব বক্তব্য কী বার্তা দিচ্ছে?
বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা কোন মন্তব্য করতে চাননি। তারা মনে করেন, সভাপতি ও সাধারন সম্পাদকের বক্তব্য নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেয়া ঠিক হবে না।
‘অনর্থক বক্তব্য নয়’
তবে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, দলের সভাপতি ও সাধারন সম্পাদকের বক্তব্যের মধ্যে কোন ভিন্নতা নেই।
“রাজনৈতিক নেতা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের পরিস্থিতি অনুযায়ী নির্দেশনামূলক বক্তব্য দিয়েছেন,” বলেন মি. নাসিম।
“প্রধানমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন ভিসা নীতি- সেটা কার্যকর হোক আর না হোক, তা নিয়ে আমাদের উদ্বেগের কিছু নেই। আর সাধারণ সম্পাদক যে বক্তব্য নিয়েছেন সেটিও অনর্থক নয়। এর মর্মার্থ দলের ভেতরে বাইরে যারা বোঝার তারা বুঝেছেন,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
মি. নাসিম বলেন, দলের নেতাদের নিজের দলের নেতাকর্মীদের যেমন বার্তা দেয়ার বিষয় থাকে, তেমনি যারা অপপ্রচার করে তাদের জবাব দেয়ারও বিষয় থাকে। প্রধানমন্ত্রী ও সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যে তারই প্রতিফলন ঘটেছে বলে তিনি মনে করেন।
দলটির তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক সেলিম মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র এবং অন্য আরেকটি দেশের নিজস্ব ভিসা নীতি নিয়ে বাংলাদেশের কারও চিন্তার কিছু নেই। সেটিই বোঝানোর চেষ্টা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
“সাধারণ সম্পাদক বোঝাতে চেয়েছেন যে ভারত ও বাংলাদেশের বন্ধুত্ব এবং জাতীয় স্বার্থ একই সূত্রে গাঁথা। এখানে বাংলাদেশকে আলাদা করে ক্ষুদ্র বা বিচ্ছিন্ন ভাবার সুযোগ নেই,” মি. মাহমুদ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন।
‘নেতা-কর্মীদের চাঙ্গা করতে এ বক্তব্য’
আমেরিকা ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বক্তব্য দিয়ে আসছেন ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে।তখন বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র্যাব ও তার কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আমেরিকা। এরপর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বর্তমান সরকারের এই টানাপোড়েন শুরু হয়।
এরপর যুক্ত হয় আগামী নির্বাচন নিয়ে ঢাকার নিযুক্ত আমেরিকার রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের নানা তৎপরতা, যা নিয়ে প্রকাশ্যেই বিভিন্ন সময় অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে আওয়ামী লীগের দিক থেকে।
তবে আমেরিকাকে নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আরো বেশি সমালোচনামুখর হয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ভিসা নীতি ঘোষণার পর।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার মনে করেন, দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের ‘চাঙ্গা করতেই’ আমেরিকা ইস্যুতে এমন ধরণের বক্তব্য দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা।
“কারণ নির্বাচন সামনে রেখে আমেরিকা আর কী পদক্ষেপ নেয় বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কী করে- তা নিয়ে দলটির বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা আছে। সে কারণেই হয়তো পরিস্থিতিকে সহজ করতে কিংবা কর্মী সমর্থকদের উজ্জীবিত করতে এমন বক্তব্য এসেছে শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের দিক থেকে। এগুলো খুব একটা পরিকল্পিত বলে মনে হয়নি বরং মনে হয়েছে কথার ফুলঝুরি মাত্র,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
আপসের দাবি কেন?
আ্ওয়ামী লীগের নেতাদের সাথে কথা বলে এমন ধারণা পাওয়া গেছে যে ওবায়দুল কাদের হয়তো ভিসা নীতিসহ নির্বাচনকে সামনে রেখে আমেরিকার ক্রমবর্ধমান চাপ নিয়ে নেতাকর্মীদের ‘মনস্তাত্ত্বিক চাপ’ কমানোর কৌশল হিসেবে এসব কথা বলছেন।
কেউ কেউ আবার বলছেন ‘এটি নিতান্তই রাজনৈতিক কৌশল’ এবং এর মূল উদ্দেশ্য হলো যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে বিরোধী দল বিশেষ করে বিএনপি যেভাবে ব্যাখ্যা করছে তার পাল্টা ধারণা জনমনে তৈরি করা।
আওয়ামী লীগের কোন কোন নেতা বলছেন, ভিসা নীতি নিয়ে পুলিশ, প্রশাসন কিংবা রাষ্ট্রের কোন অংশের মধ্যে যাতে ‘চিন্তার ছাপ’ তৈরি না হয় সেজন্য হয়তো মি. কাদের এভাবে বলে থাকতে পারেন।
ড. সেলিম মাহমুদ মনে করেন, শেখ হাসিনা এবং ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য পরস্পরবিরোধী হয়েছে এমনটা তারা মনে করেন না।
“প্রধানমন্ত্রী পরিষ্কার করে বলেছেন যে ভিসা নীতি একটা দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এটি বাংলাদেশের কারও জন্য চিন্তার বিষয় নয়। অন্যদিকে ওবায়দুল কাদের বলতে চেয়েছেন যে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে নিবিড় বন্ধুত্ব রয়েছে। উভয় দেশের জাতীয় স্বার্থ একই সূত্রে গাঁথা। আবার ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে, বাংলাদেশেরও আছে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক নিয়ে অপপ্রচারের যে সুযোগ নেই সেটিই আমাদের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
‘তলে তলে আপস হয়ে গেছে’ বলে মি. কাদের কী বোঝাতে চেয়েছেন? সে প্রসঙ্গে মি. মাহমুদ কোন মন্তব্য করেননি।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক শান্তনু মজুমদার মনে করছেন করছেন উভয় নেতার বক্তব্যই মাঠে দেয়া রাজনৈতিক বক্তৃতার অংশ, যেগুলো তারা নেতাকর্মীদের ‘উজ্জীবিত করার’ জন্যই বলেছেন বলে তিনি মনে করেন।
“ এ বিষয়ে ওনাদের বক্তব্যগুলো খুব পরিকল্পিত বলে মনে হয়নি বরং দুটো বক্তব্যই মনে হচ্ছে কথার ফুলঝুরি। এর কোনটাই দলের অবস্থানকে প্রতিফলিত করেনি”
“রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে এটা কমন স্ট্রাটেজি। সমর্থকদের মনোবল উজ্জীবিত রাখা। এটাই শেষ কথা নয়। নির্বাচনকে সামনে রেখে সমর্থক গোষ্ঠীকে চাঙ্গা রাখার একটা প্রয়াস,” বলছিলেন মি. মজুমদার।