বিশ্বকাপে বাংলাদেশের জন্য ‘বাস্তবসম্মত’ লক্ষ্যটা ঠিক কী হতে পারে, সে প্রসঙ্গে কোচ চন্ডিকা হাতুরাসিংহে-র সাম্প্রতিক এক মন্তব্য নিয়ে দিনকয়েক আগেই বেশ হইচই হয়েছিল।
চন্ডিকা কিন্তু গতকালও (শুক্রবার) তার সাংবাদিক সম্মেলনে পরিষ্কার জানিয়েছিলেন, রাউন্ড রবিন পর্যায়ে ‘অন্তত চার থেকে পাঁচটা ম্যাচ জিতে’ দলকে সেমিফাইনালে নিয়ে যাওয়াই তার প্রথম লক্ষ্য।
রাউন্ড রবিনে (মানে যেখানে সব দল সবার সাথে খেলবে) তাদের মোট ন’টা ম্যাচের মধ্যে বাংলাদেশ যে চার-পাঁচটা ম্যাচকে জেতার জন্য মূলত টার্গেট করেছে, আফগানিস্তান তার মধ্যে অবশ্যই একটা ছিল।
সেই প্রথম টার্গেটটা প্রায় ফুল মার্কস পেয়ে লক্ষ্যভেদ করার পর বাংলাদেশ দল শনিবার রাতে ধরমশালায় যে নিশ্চিন্তে ঘুমোবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
প্রথম ম্যাচেই আফগানিস্তানকে উড়িয়ে দিয়ে তারা পরের ম্যাচে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধেও শুরু করতে পারবে অনেক আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গীতে।
অন্যদিকে যে ইংল্যান্ড ধরমশালায় এসে সদ্য নেমেছে, তারা বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতে পারে – কিন্তু বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের ডেভিড কনওয়ে আর রাচিন রবীন্দ্রার হাতে বিধ্বস্ত হওয়া একটা দল।
উল্টো দিকে ধরমশালার মাঠটা এর মধ্যেই বেশ ভালভাবে চিনে গেছে বাংলাদেশ, সেখানে আগে থেকেই একটু কোণঠাসা ইংল্যান্ডকে চেপে ধরার এর চেয়ে ভাল সুযোগও হয়তো তাদের আসবে না।
তার ওপর আশ্চর্যজনকভাবে ধরমশালার মাঠে শনিবার বল বেশ টার্ন করেছে, বাংলাদেশের স্পিনাররা দারুণ পারফর্ম করেছেন।
ফলে বাংলাদেশ সমর্থকরা এই মুহুর্তে হয়তো আশা করতেই পারেন, বিশ্বকাপের স্কোরশিটে বাংলাদেশ ‘দুইয়ে দুই’ করেই ধরমশালা থেকে চেন্নাইয়ের বিমান ধরতে পারবে।
সেটা যদি সত্যিই সম্ভব হয়, তাহলে বাকি সাতটা ম্যাচে অন্তত দু-তিনটে বের করে নিতে পারলেই – অন্তত হাতুরাসিংহের কথা অনুযায়ী – বাংলাদেশের জন্য সেমিফাইনালের রাস্তা পরিষ্কার হয়ে যেতেই পারে।
তবে সে সব পয়েন্টস টেবল এবং যদি-কিন্তুর জটিলতা পরের কথা, আপাতত বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচটা যে বাংলাদেশ এর চেয়ে ভালভাবে আর শুরু করতে পারত না – তা নিয়ে কোনও বিতর্কই নেই।
টুর্নামেন্টের ‘ডার্ক হর্স’ বলে অনেকেই যে আফগানিস্তানকে চিহ্নিত করেছেন, তাদের ধরাশায়ী করে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের অভিযান আসলে রূপকথার মতোই শুরু হয়েছে।
তবে হ্যাঁ, ওপেনিং জুটির ব্যর্থতা যথারীতি নতুন করে সামনে এনে দিয়েছে তামিম ইকবাল ইস্যুকেও – তামিম থাকলে অন্যরকম কিছু হতো কি না সেই বিতর্ক এখনও দলের পিছু ছাড়ছে না।
তবে এ ছাড়া আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে ম্যাচে বাংলাদেশের বাকি সব এক্সপেরিমেন্টই দারুণ খেটে গেছে – তা সে মেহিদি হাসান মিরাজকে তিন নম্বরে তুলে আনাই হোক, কিংবা মুস্তাফিজুর রহমানকে প্রথম এগারোতে রাখা।
আফগান দলের সর্বোচ্চ স্কোরার ও ওপেনার রহমতুল্লা গুরবাজকে ম্যাচের একটা গুরুত্বপূর্ণ মুহুর্তে আউট করে প্রতিপক্ষকে হতোদ্যম করে দিয়েছিলেন মুস্তাফিজ।
বস্তুত আফগানিস্তান ইনিংস মাত্র ১৫৬ রানে গুটিয়ে যাওয়ার পর স্কোরটা ওয়ানডে ক্রিকেটের না টি-টোয়েন্টির হল, ধরমশালার স্থানীয় ক্রিকেট সমর্থকরা সেটাই বলাবলি করছিলেন।
তারা এই মাঠে নিয়মিত আইপিএলের ম্যাচ দেখতে অভ্যস্ত – আর সেই আইপিএলেও এরকম দেড়শো বা পৌনে দুশো রান যে যথেষ্ঠ নয়, সেটা তারা খুব ভালই জানেন।
আর সেখানে ওয়ানে-ডেতে এটা তো কোনও স্কোর বলেই ধরা যায় না!
ফলে ঘড়িতে বেলা দেড়টা বাজারও সাত মিনিট আগে আফগানিস্তান যখন মাত্র শ’দেড়েক রানে অল আউট হল, তখনই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচটায় জয় একরকম চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল।
তবে ধরমশালার এই ম্যাচ নিয়ে ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের দুটো পূর্বাভাস একেবারে মেলেনি বললেই চলে।
প্রথমত, এই মাঠের সবুজ গ্রিনটপ উইকেটে স্পিনাররা কতটা সহায়তা পাবেন তা নিয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন।
কিন্তু বাংলাদেশের হয়ে সাকিব আল হাসান (৩-৩০) আর মেহিদি হাসান মিরাজ (৩-২৫) তাদের অনায়াসে ভুল প্রমাণ করেছেন।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান দুই শিবিরই মনে করেছিল এরকম স্পোর্টিং উইকেটে এটা একটা হাই-স্কোরিং ম্যাচ হতে যাচ্ছে।
হাশমাতুল্লাহ্ শাহিদির দল মাত্র ১৫৬ রানে অল আউট হওয়াতে সেই ধারণাও ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
শনিবার ধরমশালার যে পিচে খেলা হল, মঙ্গলবারও (১০ অক্টোবর) সেটিতেই, না কি তার পাশের পিচে খেলা হবে কি তা এখনও নিশ্চিতভাবে জানা নেই।
তবে স্পিনার হিসেবে সাকিব আর মিরাজের এদিনের পারফরমেন্স ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে বাংলাদেশকে অবশ্যই দারুণ আশ্বস্ত রাখবে।
ম্যাচের পর নির্ধারিত সাংবাদিক সম্মেলনে প্লেয়ার অব দ্য ম্যাচ মেহেদি হাসান মিরাজ তো বলেই ফেললেন, স্পিনাররা এই পিচে সাহায্য পাবেন তারাও আশা করেননি।
“তবে দু’তিন ওভার হাত ঘোরানোর পরই দেখলাম বল কিন্তু একটু একটু ঘুরছে, থেমে থেমে আসছে।
পুরো ম্যাচটা জুড়েই আমরা সব সময় ইনফর্মেশন আদানপ্রদান করি, দেখলা্ম সাকিবভাই-ও একই কথা বললেন”, বিবিসি বাংলার এক প্রশ্নের জবাবে জানালেন মিরাজ।
অদ্ভুত ব্যাপার হল, আফগান ক্রিকেটের বিখ্যাত স্পিনার ত্রয়ী – রাশিদ খান, মুজিব উর রহমান ও মহম্মদ নবী কিন্তু উইকেট থেকে সেভাবে ফায়দা তুলতে পারেননি।
আফগান দলের হেড কোচ জোনাথন ট্রট সে কথা কিছুটা মেনেও নিলেন।
ট্রট সেই সঙ্গেই বললেন, “বল অল্প কিছুটা ঘুরেছে এটা ঠিক। তবে বাংলাদেশের বোলারদের পুরো কৃতিত্ব দিয়েও বলব, আমাদের ব্যাটাররা অনেকগুলো সফট ডিসমিস্যাল করেছে।“
মাত্র ৭৫ রানের মধ্যে ন’টা উইকেট হারালে কোনও ওয়ান ডে ম্যাচে জেতার আশা যে না-করাই ভাল, সেটাও মেনে নিলেন তিনি।
ফলে ধরমশালার উইকেটে কতটা স্পিন ধরেছে তা নিয়ে কিছুটা মতপার্থক্য আছেই।
কিন্তু তিনদিন পরের ম্যাচেও যদি বাংলাদেশের স্পিন আক্রমণ এই মাঠে দুর্দান্ত হয়ে ওঠে, তাহলে বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধেও টাইগারদের যথেষ্ঠ সম্ভাবনা থাকবে।