ইসরায়েলের ওপরে হামাসের হামলার পরেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সেটিকে ‘সন্ত্রাসী হামলা’ বলে উল্লেখ করায় আলোচনা শুরু হয়েছিল যে ভারত কী তাহলে অনেক দশক ধরে ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়ানো অবস্থান বদল করল?
তবে ওই হামলা এবং হামাস-ইসরায়েল সংঘর্ষ শুরু হওয়ার ছয়দিন পরে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রক প্রথমবারের মতো বিষয়টি নিয়ে যে মন্তব্য করেছে, তাতে ফিলিস্তিনের সমর্থনের কথা বলা হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রকের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী ফিলিস্তিন নিয়ে ভারতের দীর্ঘকালের যে অবস্থান, সেটাকেই তুলে ধরেছেন যে ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত দেশ ফিলিস্তিনের দাবির প্রতি ভারত সমর্থন জানাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী যখন ইসরায়েলের পাশে দাঁড়ানোর বার্তা দিলেন, তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কেন ফিলিস্তিনের দাবির প্রতি তাদের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করল?
বিশ্লেষকরা মনে করছেন মি. মোদীর মন্তব্যে আন্তর্জাতিক মহলে যে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, সেটারই ড্যামেজ কন্ট্রোল করল পররাষ্ট্র মন্ত্রক।
কী বলেছে পররাষ্ট্র্র দপ্তর?
পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের উত্তরে জানান, “আমাদের নীতি দীর্ঘদিন ধরে একই আছে। একটি সার্বভৌম, স্বাধীন এবং কার্যকর রাষ্ট্র হিসাবে ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠার জন্য সরাসরি আলোচনা শুরু করার পক্ষে সবসময়েই থেকেছে ভারত।“
মি. বাগচী যোগ করেছেন যে ভারত এমন এক পরিস্থিতি চায়, ফিলিস্তিনিরা “যেখানে নির্দিষ্ট এবং সুরক্ষিত সীমান্তের ভেতরে” ইসরায়েলে সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করতে পারবেন।
“এই অবস্থানের কোনও বদল হয় নি,” জানিয়েছেন অরিন্দম বাগচী। তবে মি. বাগচী হামাসের হামলাকে ‘সন্ত্রাসী কাজ’ বলেও উল্লেখ করেছেন। তার কথায়, “যে কোনও ধরণের সন্ত্রাসবাদী হুমকির মোকাবিলা করারও দায়িত্ব আছে।“
নরেন্দ্র মোদীর মন্তব্যের ড্যামেজ কন্ট্রোল?
সামাজিক মাধ্যম এক্স-এ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ‘সন্ত্রাসী হামলা’ এবং ইসরায়েলের পাশে দাঁড়ানোর কথাকে ফিলিস্তিন নিয়ে ভারতের পুরণো অবস্থান বদলের ইঙ্গিত বলে মনে করা হচ্ছিল। ওই মন্তব্যে মি. মোদী ফিলিস্তিনের কথা উল্লেখও করেননি।
তার ওই মন্তব্যের পরে দেশের অভ্যন্তরে হিন্দুত্ববাদীরা জোরালোভাবে ইসরায়েলকে সমর্থন করছিলেন। এমনকি কেউ কেউ ইসরায়েলের হয়ে হামাসের বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াইতে অংশ নেওয়ারও ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।
আর এই কদিন নিশ্চুপ ছিল দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। অবশেষে তারা যখন মুখ খুলল, হামাসের হামলার ঘটনাটিকে ‘সন্ত্রাসী হামলা’ বলেও ফিলিস্তিনের প্রতি ভারতের সহানুভূতির কথা পুনর্ব্যক্ত করল।
দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ এ কে পাশা বলছিলেন, “প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রকের মন্তব্য দুটি দুই বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে।“
“নরেন্দ্র মোদী আবেগের থেকে, দেশে তার হিন্দু ভোট ব্যাংকের কথা মাথায় রেখে ওই মন্তব্য করেছিলেন। আর পররাষ্ট্র মন্ত্রককে আন্তর্জাতিক সম্পর্কগুলো, কূটনীতি এসব বাস্তবতা মাথায় রেখে কাজ করতে হয়। তাই দুটো মন্তব্য সাংঘর্ষিক,” বলছিলেন মি. পাশা।
তার কথায়, এটা পররাষ্ট্র মন্ত্রকের একটা ড্যামেজ কন্ট্রোলের প্রচেষ্টা।
“প্রধানমন্ত্রীর ওই মন্তব্য যে আরব বিশ্ব ভালভাবে নেবে না, সেটা কূটনীতিকরা ভালই টের পেয়েছেন। আরব দেশগুলো ভারতের সবথেকে বড় বাণিজ্য-সঙ্গী। ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে তেল, সার এসবের ওপরে আরব বিশ্বের ওপরে নির্ভর করতে হয় ভারতকে”
“নরেন্দ্র মোদীর মন্তব্যের পরে যাতে আরব বিশ্ব ভারত-বিরোধী কোনও অবস্থান না নেয়, তাই অবস্থা সামলাতে এই কদিন সময় নিল পররাষ্ট্র মন্ত্রক,“ বলছিলেন এ কে পাশা।
ফিলিস্তিন নিয়ে ভারতের অবস্থান
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী থেকে শুরু করে অটল বিহারী বাজপেয়ী – ভারতের সব নেতা নেত্রীই ফিলিস্তিনের পক্ষে থেকেছেন গত শতাব্দীর তিরিশের দশক থেকেই।
মি. গান্ধী তার হরিজন পত্রিকায় ২৬ নভেম্বর, ১৯৩৮ সালে লিখেছিলেন , “ইংল্যান্ড যেরকম ব্রিটিশদের বা ফ্রান্স যেভাবে ফরাসীদের, সেই একই ভাবে ফিলিস্তিন আরবদের। “
ওই একই লেখায় তিনি এটাও বলেছিলেন, “আরবদের ওপরে ইহুদীদের চাপিয়ে দেওয়া হলে সেটা ভুল এবং অমানবিক হবে।“
জওহরলাল নেহরু ১৯৩৬ সালে লিখেছিলেন ‘ফিলিস্তিনের সমস্যা মূলত একটি জাতীয়তাবাদী সমস্যা, সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণ ও শোষণের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছে জনগণ। এটা কোনও জাতিগত বা ধর্মীয় বিষয় নয়।” তিনি বলেন, ‘সম্ভবত আমাদের কিছু মুসলিম দেশবাসী ধর্মীয় বন্ধনের কারণে আরবদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে। “
এই দৃষ্টিভঙ্গির ওপরে ভিত্তি করেই ভারত স্বাধীন হওয়ার পরেও দেশের ফিলিস্তিন-ইসরায়েল নীতি গড়ে উঠেছিল।
মি. নেহরুর নেতৃত্বাধীন ভারত ফিলিস্তিনের বিভাজন এবং জাতিসংঘে ইসরায়েলের প্রবেশের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল। পরে, ১৯৫০ সালে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয় ভারত।
প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ইন্দিরা গান্ধী ফিলিস্তিনি সংগ্রামের প্রতি ভারতের সহমর্মিতাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যান। প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা পিএলও প্রধান ইয়াসের আরাফতকে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসাবে মনে করতেন মিসেস গান্ধী।
তারপরে রাজীব গান্ধীও সেই নীতিই মেনে চলতেন।
প্রধানমন্ত্রী মোরারাজি দেশাই-এর অধীনে জনতা সরকারের সময় অটল বিহারী বাজপেয়ী যখন জনতা দল সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন, তখন এবং পরবর্তীকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসাবেও ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়ানোর কথাই বলতেন।
ইসরায়েলের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিমা রাও। তবে একই সঙ্গে ফিলিস্তিনি সংগ্রামের প্রতিও সমর্থন অটুট ছিল মি. নরসিমা রাওয়ের সময়েও।
মনমোহন সিং সহ একের পর এক প্রধানমন্ত্রী এই সংগ্রামের প্রতি ভারতের সংহতি প্রকাশ করেছিলেন।
ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন মোদীরও
নরেন্দ্র মোদী ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পরেও কিন্তু ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থনের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে চলেছে ভারত।
ভারত ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের মধ্যে নিয়মিত উচ্চ পর্যায়ের দ্বিপাক্ষিক সফর হয়েছে। মি. মোদী ইসরায়েল যেমন সফর করেছেন, তেমনই পৃথক সফরে গেছেন ফিলিস্তিনি এলাকাতেও।
সেই সময়ে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস মি. মোদীকে দেশের সর্বোচ্চ সম্মান ‘গ্র্যান্ড কলার অব দ্য স্টেট অব প্যালেস্টাইন’ প্রদান করেছিলেন।
আবার ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ২০১৭ সালের মে মাসে ভারত সফর করেন।
গত বছর আন্তর্জাতিক ফিলিস্তিনিদের সংহতি দিবসে প্রধানমন্ত্রী মোদী একটি বার্তাও দিয়েছিলেন।