গাজার জনাকীর্ণ আল-আহলি হাসপাতালে বিস্ফোরণে শত শত মানুষ নিহত হয়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজায় ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে এ ঘটনার জন্য ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বিমান হামলার অভিযোগ তুলেছে। ইসরায়েল এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
এমন অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগের মধ্যে সত্য খুঁজে বের করাটা খুবই কঠিন।
কী ঘটেছে বা কী ঘটেনি- তা বুঝতে ভিডিও ফুটেজ, স্থির চিত্র, অন্যান্য নথি এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে কথা বলে তা যাচাই করে দেখার চেষ্টা করবে বিবিসি ভেরিফাই। এছাড়া বিবিসির একজন সাংবাদিক ঘটনাস্থলে গিয়েছেন, যেখানে সাধারণ মানুষের যাওয়ার অনুমতি নেই।
সব সময়ই নতুন নতুন তথ্য সামনে আসছে, তাই আমরা যত বেশি তথ্য পাবো এবং বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে যা জানবো, তার সবই এই প্রতিবেদনে হালনাগাদ করা হবে।
আরো মনে রাখতে হবে যে, এই যুদ্ধ শুধু সম্মুখ যুদ্ধ নয় বরং এই সংঘাত এক ধরণের তথ্য যুদ্ধেও পরিণত হয়েছে।
কোন একটি বিস্ফোরণ নিয়ে ইসরায়েল ও গাজা কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের তথ্য তুলে ধরার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। এছাড়াও আমরা আরো নানা ধরণের দাবি ও বিবৃতি খতিয়ে দেখবো।
বিস্ফোরণ
মঙ্গলবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যা সাতটার দিকে হাসপাতালে এই বিস্ফোরণটি ঘটে। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে যাওয়া ২০ সেকেন্ডের একটি ভিডিওতে বিস্ফোরণটি ঘটতে দেখা যায়। এটি এই ঘটনার প্রথম কোন ভিজ্যুয়াল প্রমাণ।
ভিডিওটিতে একটি ক্ষেপণাস্ত্র ধেয়ে আসার সময় বাঁশির শব্দের মতো শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। এরপরেই একটি বিস্ফোরণ ঘটে এবং ব্যাপক আগুন দেখা যায়।
স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ছয়টা ৫৯ মিনিটে আল-জাজিরা মিডিয়া নেটওয়ার্কে সরাসরি সম্প্রচারিত একটি ভিডিওতে দেখা যায়, গাজার আকাশে একটি উজ্জ্বল আলো উপরের দিকে উঠছে। এটি খুব দ্রুত দিক পরিবর্তন করার আগে দুই বার জ্বলে ওঠে এবং পরে বিস্ফোরিত হয়।
এরপর দূরে মাটিতে একটি জায়গায় বিস্ফোরণ দেখা যায়। এরপর ক্যামেরা অপারেটরের কাছাকাছি এর চেয়ে বড় আকারের একটি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। এই জায়গাটির ভৌগোলিক অবস্থান খুঁজে পেয়েছে বিবিসি।
সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক মন্তব্যকারী ধারণা করে বলছেন, এই আওয়াজটি একটি রকেট বিচ্ছিন্ন হওয়ার সময় বা বিস্ফোরিত হওয়ার কারণে তৈরি হয়েছে।
সোশ্যাল মিডিয়াতে আরো যেসব ফুটেজ প্রচারিত হয়েছে সেগুলো একই বিস্ফোরণের ভিডিও। কিন্তু সেগুলো বিভিন্ন দিক থেকে এবং বিভিন্ন দূরত্ব থেকে ধারণ করা হয়েছে।
আমরা ২০টি থিংক ট্যাংক, বিশ্ববিদ্যালয় এবং অস্ত্র সম্পর্কিত জ্ঞানের পারদর্শিতা রয়েছে এমন প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করেছি।
এদের মধ্যে নয়টি প্রতিষ্ঠান এখনো কোন প্রতিক্রিয়া জানায়নি, পাঁচটি প্রতিষ্ঠান মন্তব্য করবে না বলে জানিয়েছে। তবে বাকি ছয়টি প্রতিষ্ঠানের সাথে আমরা কথা বলতে পেরেছি।
আমরা তাদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, যেসব প্রমাণাদি এখনো পর্যন্ত পাওয়া গেছে- বিশেষ করে বিস্ফোরণের আকার এবং এটি ঘটার আগে শোনা যাওয়া শব্দের মাধ্যমে হাসপাতালের বিস্ফোরণের কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় কী না?
এখনো পর্যন্ত যে তথ্য পাওয়া গেছে তা দিয়ে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। আমরা যাদের সাথে কথা বলেছি তাদের মধ্যে তিন জন বলেছেন, বড় আকারের অস্ত্র দিয়ে ইসরায়েলি বিমান হামলার কারণে যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি আপনি আশা করবেন তার সাথে এই ঘটনার সামঞ্জস্যতা নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যানডারবিল্ট ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক জে অ্যান্ড্রেস গ্যানন বলেন, মাটিতে আঘাত হানা বিস্ফোরণটি ছোট বলে মনে হয়েছে।
তার মানে হচ্ছে, বিস্ফোরণের কারণে যে তাপ উৎপাদিত হয়েছে তা আসলে কোন ক্ষেপণাস্ত্রের বিস্ফোরণের কারণে নয় বরং রকেটের বেচে যাওয়া জ্বালানির কারণে হয়েছে।
তার এই মতের সাথে একমত হয়েছেন যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিস ইন্সটিটিউটের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো জাস্টিন ব্রঙ্ক।
তিনি বলেন, এতো প্রাথমিক পর্যায়ে নিশ্চিত করে কিছু বলাটা কঠিন। প্রমাণাদি দেখে মনে হচ্ছে, বিস্ফোরণটি একটি রকেটের অংশ থেকে হয়েছে, যেটি গাড়ি পার্কিংয়ে আঘাত হানার পর জ্বালানি এবং প্রোপেলান্ট থেকে আগুন ধরে যায়।
মি. গ্যানন বলেন, তিনি যে ভিডিও দেখেছেন তা থেকে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না যে ক্ষেপণাস্ত্রটি তার নির্ধারিত লক্ষ্যে আঘাত হানতে পেরেছিলো কী না।
তিনি আরো বলেন, আকাশে আলোর ঝলক দেখে মনে হচ্ছে ক্ষেপণাস্ত্রটির সাথে একটি রকেট ছিল যেটির ইঞ্জিন অতিরিক্ত গরম হওয়ার কারণে কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল।
ঝুঁকি মূল্যায়ন করে এমন একটি কোম্পানি সিবিলিন এর মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক প্রধান বিশ্লেষক ভ্যালেরি স্কুটো বলেন, ড্রোনের মাধ্যমে আরো অন্য ধরণের হামলা চালানোর সক্ষমতা ইসরায়েলের রয়েছে।
যেখানে তারা হেলফায়ার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে থাকে। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো থেকে অনেক বেশি তাপ উৎপাদিত হয়। কিন্তু এর আঘাতে সব সময় এ ধরণের গর্ত তৈরি হয় না।
তিনি বলেন, অসমর্থিত ফুটেজগুলো থেকে হাসপাতালের দিকে অস্ত্র ছোড়ার যে প্যাটার্ন দেখা গেছে তা আসলে এই বর্ণনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
ভিজ্যুয়াল প্রমাণ
বিস্ফোরণটি যে হাসপাতালেই হয়েছিল তা নিশ্চিত হতে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত স্যাটেলাইটের ছবির সাথে আল-আহলি হাসপাতাল প্রাঙ্গণের ভবন এবং নকশার চিত্র মিলিয়ে দেখেছে বিবিসি।
যেসব প্রমাণাদি পাওয়া গেছে তা থেকে বোঝা যায় যে, বিস্ফোরণটি একটি আঙ্গিনায় ঘটেছে যা আসলে হাসপাতালের অংশ।
বিস্ফোরণ যে স্থানে ঘটেছে সেখানকার ছবিতে দেখা যায় যে, হাসপাতালটির ভবনের খুব একটা ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ছবিতে যা দেখা যাচ্ছে তা হলো ঝলসে যাওয়ার চিহ্ন এবং আগুনে পোড়া গাড়ি।
এই হাসপাতালটির মালিকানা এবং এটি পরিচালনা করে একটি অ্যাংলিকান চার্চ।
জেরুসালেমে অবস্থিত সেন্ট জর্জ কলেজের ডিন ক্যানন রিচার্ড সেওয়েল বিবিসিকে বলেন, হাসপাতালের প্রাঙ্গণে প্রায় এক হাজারের মতো বাস্তুচ্যুত মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল। আর হাসপাতাল ভবনের ভেতরে ছয় শতাধিক রোগী ও স্বাস্থ্যকর্মী ছিল।
হতাহত
বিবিসির প্রতিনিধি রুশদি আবুআলুফ আল-আহলি হাসপাতালে গিয়েছিলেন। সেখানকার প্রত্যক্ষদর্শীরা তার কাছে ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র তুলে ধরেন এবং বলেন সেখান থেকে তখনো মরদেহ সংগ্রহ করা হচ্ছে।
এক ব্যক্তি তাকে বলেন, বিস্ফোরণটি ঘটার সময় নারী, শিশু এবং বয়স্করা হাসপাতালে আশ্রয় নিয়েছিল।
আমরা এখনো হতাহতদের ছবি বিশ্লেষণ করছি কারণ তাদের আঘাতের চিত্র দেখে হামলার প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেতে পারে।
বিবিসি বিস্ফোরণ স্থলে নিহত এবং বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের অত্যন্ত সংবেদনশীল কিছু ছবি দেখেছে যেখানে হতাহতদের মধ্যে মারাত্মক ধরণের আঘাতের চিত্র রয়েছে।
যুক্তরাজ্যের ফিজিশিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটস এর প্রতিষ্ঠাতা এবং যুদ্ধক্ষেত্রে আঘাত বিষয়ক বিশেষজ্ঞ প্যাথলজিস্ট ডেরিক পাউন্ডার এসব ছবির কয়েকটি দেখেছেন।
তিনি বলেন, “বিক্ষিপ্ত ক্ষত চিহ্ন দেখে মনে হচ্ছে এগুলো বিস্ফোরণের কারণে বের হওয়া শার্পনেলের কারণে হয়েছে।”
তবে তিনি এটাও বলেছেন যে, যাচাই করা এতো কম সংখ্যক ছবি দেখে আসলে সব ক্ষতের কারণ সম্পর্কে স্পষ্টভাবে কিছু বলা সম্ভব নয়।
ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বুধবার জানিয়েছে, বিস্ফোরণে ৪৭১ জন নিহত হয়েছে।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী বলেছে, এই সংখ্যা ইচ্ছাকৃতভাবেই বাড়িয়ে বলা হয়েছে। তবে তাদের হিসাব অনুযায়ী কত মানুষ মারা গেছে সে সম্পর্কে কিছু জানায়নি।
স্বাধীন কোন সংস্থার পক্ষে ঘটনাস্থলে যাওয়াটা সম্ভব নয় বলে নিহতের সংখ্যা যাচাই করা যায়নি।
আমরা এখনো যা জানি না
বিস্ফোরণের পর যে গর্ত তৈরি হয়েছে সেগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ।
ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্সেস বা আইডিএফ বলেছে, বড় কোন গর্ত তৈরি না হওয়ার কারণে এবং আশেপাশের ভবনগুলোতে বিস্ফোরণের কোন ক্ষতি না হওয়ায় তারা মনে করছে যে, এটি তাদের অস্ত্রের বিস্ফোরণ নয়।
নিচের চিত্রে আপনি একটি ছোট গর্ত দেখতে পাবেন এবং আমরা এরকম আরো চিহ্ন খতিয়ে দেখছি।
আরো গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। আর সেটি হচ্ছে ক্ষেপণাস্ত্রের অবশিষ্টাংশ। ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সাধারণত তাদের গোলার অবশিষ্টাংশ দেখে সহজেই শনাক্ত করা যায়।
এগুলো থেকে ক্ষেপণাস্ত্রটি কোথায় তৈরি করা হয়েছে তাও বোঝা যায়। কিন্তু এই ক্ষেত্রে আমরা এ ধরণের কোন প্রমাণ দেখিনি।
আইডিএফ গোপনে ধারণ করা হামাসের দুই সদস্যের একটি কথোপকথনের রেকর্ড প্রকাশ করেছে। ওই রেকর্ডে ওই দুই সদস্য বলছে যে, ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদ-এর একটি ক্ষেপণাস্ত্র হাসপাতালে আঘাত হেনেছে। এই ইসলামিক জিহাদ গাজায় দ্বিতীয় বৃহৎ সশস্ত্র গোষ্ঠী। তারা হামাসের ৭ই অক্টোবরের হামলায় সমর্থন জানিয়েছে।
এই রেকর্ডিংটির সত্যতা যাচাই করতে পারেনি বিবিসি। এক বিবৃতিতে, বিস্ফোরণের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে পিআইজে এবং এর জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করেছে তারা।