গত সেপ্টেম্বর মাসে যখন বাঙ্কা দ্বীপে তার বাড়ির পাশেই একটা গর্তের মতো জায়গা থেকে পানি আনতে যান সারিয়া, তখন তিনি জানতেনই না যে সেখানেই একটা তিন মিটার লম্বা লবণাক্ত পানির কুমির রয়েছে এবং তার পানি ভরার দিকে নজর রাখছে।
“পানিটা ছিল একদমই শান্ত এবং কুমিরের কোন চিহ্ন চোখে পড়েনি, তাই আমি ভাবলাম যে একটু গোসল করবো। কিন্তু হঠাৎ করে এটা হাজির হয় এবং আমাকে কামড় দেয়, আমার বাম হাত কামড়ে টেনে পানির দিকে নিয়ে যায়,” বলেন ৫৪ বছর বয়সী সারিয়া।
সারা বিশ্বের মধ্যে ইন্দোনেশিয়ায় সবচেয়ে বেশি লবণাক্ত পানির কুমিরের হামলার ঘটনা ঘটে থাকে। গত এক দশকে প্রায় এক হাজার এরকম কুমিরের আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে, যাতে মারা গিয়েছে ৪৫০ জন মানুষ।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার (আইইউসিএন) বলছে, এগুলোর মধ্যে প্রায় ৯০টি হামলার ঘটনা ঘটেছে বাঙ্কা এবং পাশের বেলিতাং দ্বীপে।
বাঙ্কা দ্বীপ হল বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ টিন-মাইনিং এলাকাগুলোর একটি।
দ্বীপটির আয়তন প্রায় হাওয়াই দ্বীপের সমান এবং এর জনসংখ্যা ১০ লাখের মতো, যার ৮০ শতাংশই টিনের খনিতে কাজ করে। পরিবেশ সংরক্ষণ গ্রুপ ওয়ালহি জানায়, এই দ্বীপের ৬০ শতাংশেরও বেশি জায়গা এরইমধ্যে টিনের খনিতে রুপান্তরিত হয়েছে। যাদের অনেকগুলোই অবৈধ।
বছরের পর বছর মাটির নিচে টিনের সন্ধান এই দ্বীপের বন উজাড় করেছে, ফলে দ্বীপজুড়ে এখন অসংখ্য খানা-খন্দ যা দেখতে এখন অনেকটা চাঁদের পৃষ্ঠ বলে মনে হয়। আর এভাবে জমি যখন ফুরিয়ে আসছে শ্রমিকরা ধীরে ধীরে সাগরের দিকে এগুচ্ছেন।
যার মানে লবণাক্ত পানির কুমির, যেগুলো খোলা পরিষ্কার পানিতেও থাকতে পারে, তাদের প্রাকৃতিক আবাসও কমে এসেছে। ফলে তারা এখন পরিত্যক্ত ও চালু বিভিন্ন খনিতে মানুষের বাড়িঘরে পাশে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে, যা থেকে হামলার ঘটনাও বাড়ছে।
গত বছর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে শুষ্ক মৌসুম স্বাভাবিকের চেয়ে দীর্ঘ হয়, সারিয়ার বাড়ির সামনের কুয়ো শুকিয়ে যায়। তিন মাসের বিল বকেয়া হলে তার পানির লাইন কাটা পড়ে। ফলে পরিত্যক্ত গর্তগুলোই হয়ে পড়ে তার ও পরিবারের পানির একমাত্র উৎস।
সারিয়ার উপর কুমিরের এ হামলার পাঁচ দিন পর আরেক শ্রমিক আরেকটি গর্তের পানিতে টিন ধুতে গিয়ে কুমিরের আক্রমণে প্রায় মারাই যাচ্ছিল। তারা মাথা, কাঁধ ও হাত মারাত্মক আঘাতপ্রাপ্ত হয়।
কুমির হত্যার সংস্কৃতি
লবণাক্ত পানির কুমির হল সবচেয়ে দীর্ঘাকার সরিসৃপ জাতীয় প্রাণী। একটা পূর্ণবয়স্ক কুমির লম্বায় ৭ মিটার বা ২৩ ফিটেরও বেশি হতে পারে।
বিশ্বজুড়ে প্রায় ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজারের মতো লবণাক্ত পানির কুমির রয়েছে, আর ইন্দোনেশিয়া হল তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল। যদিও ইন্দোনেশিয়ায় ঠিক কতগুলো এরকম কুমির রয়েছে তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই।
ইন্দোনেশিয়ায় কুমির হল সংরক্ষিত প্রাণী। কিন্তু বাঙ্কা দ্বীপে যে কোন হামলার পর তাদের কোন সংরক্ষণ সংস্থার কাছে দেয়ার বদলে সাধারণত সেই কুমিরকে মেরে ফেলা হয়।
কারণ স্থানীয় অনেকের বিশ্বাস কোন কুমিরকে উদ্ধার করে এই এলাকা থেকে অন্য জায়গায় নেয়া তাদের গ্রামের জন্য অশুভ, একারণেই তারা সেটাকে হত্যা করে এবং আচার মেনে পুড়িয়ে ফেলে।
এনদি রিয়াদি, যিনি এই দ্বীপের একমাত্র বন্যপ্রাণী উদ্ধার ও সংরক্ষণ কেন্দ্র ‘আলোবি’ পরিচালনা করেন, তিনি বিবিসিকে বলেন তার দলকে প্রায়ই কুমির বাঁচাতে গিয়ে গ্রামবাসীদের সাথে বিবাদে জড়াতে হয়।
২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত আলোবি কুমির ও প্যাঙ্গোলিনসহ বেশ কয়েক ধরনের বন্যপ্রাণীকে আশ্রয় দিয়ে থাকে। এগুলোর বেশিরভাগই হয় চোরাচালানের সময় কর্মকর্তারা জব্দ করেছেন অথবা মানুষের সঙ্গে মারামারির পর উদ্ধার হয়েছে।
আলোবিতে এখন ৩৪টি উদ্ধার করা কুমির আছে, একটা টেনিস কোর্টের অর্ধেক সমান পুকুরে তাদের রাখা হয়েছে। লোহার বেড়া দিয়ে জায়গাটা ঘেরা যাতে তারা অন্যদিকে চলে যেতে না পারে ও অন্য কোন প্রাণীকে আক্রমণ না করে।
দিনের বেশিরভাগ সময় এর পানি শান্তই দেখা যায়, কুমিরগুলো বিরাট বিরাট পাথরের মতো পানিতে স্থির ভেসে থাকে। কিন্তু খাবার সময়, তারা একরকম দৌড়ে বেড়ার কাছে চলে আসে এবং তাদের দিকে ছুঁড়ে দেয়া মাংস নিয়ে কাড়াকাড়ি করে।
মি. রিয়াদি জানান, এগুলোকে এখানে রাখা বেশ খরচের ব্যাপার। আলোবি সরকারের কাছ থেকে সরাসরি কোন অর্থ পায়না এবং বিভিন্ন অনুদানের উপর নির্ভর করে। এই আশ্রয়কেন্দ্র তাই স্থানীয় গরুর খামার যারা চালান তাদের সাথে মিলে কাজ করে যাতে কম খরচে এই মাংসাশী প্রাণীদের খাবার দেয়া যায়।
“মাসে হয়তো একবার আমরা পুরো একটা আস্ত গরু পাই ওদের জন্য। যদি কোন খামারির গরু মারা যায় তাহলে সেটা আমরা এদের খাওয়াই,” বলেন মি. রিয়াদি।
তিনি জানান এরকম ধরে ধরে কুমির নিয়ে গিয়ে তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে রাখাও হয়তো সামনে সম্ভব হবে না, কারণ এরইমধ্যে অতিরিক্ত কুমিরের জায়গা দিতে হয়ে হয়েছে তাদের। আবার তাদের জঙ্গলে ছেড়ে দেয়ারও কোন সুযোগ নেই।
কিন্তু মানুষের উপর কুমিরের হামলাও বন্ধ হবে না যতদিন না তাদের নিরাপদ আবাসস্থল দেয়া যাচ্ছে। আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন এটার জন্য প্রধান দায়ী হল অবৈধ খনি। মানুষ এখন যেহেতু আরও বেশি সমুদ্রের দিকে যাচ্ছে টিনের খোঁজে, ফলে দিন দিন আরও বেশি কুমির তাদের প্রাকৃতিক নিবাস হারাবে।
ইন্দোনেশিয়ার সরকার অবৈধ মাইনিং বন্ধে একটু ভিন্ন পন্থা নিয়েছে, আর সেটা হল তারা খনির বৈধতা দিচ্ছে। সরকার খনি শ্রমিকদের একটা লাইসেন্স দিচ্ছে এই অবৈধ খনিগুলোতে কাজ করার জন্য, আর এর বদলে ঐ শ্রমিকদের দায়িত্ব নিতে হবে সেখানকার জীববৈচিত্র রক্ষার, জানান সেখানে এনার্জি ও পানির উৎস দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা আমির সায়েবানা।
এর মধ্যে আছে গাছ লাগানো থেকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পর্যন্ত নানা বিষয়। কিন্তু অনেকেই সরকারের এই কৌশল নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন।
তাদের প্রশ্ন শ্রমিকরা কি আসলেই পরিবেশ রক্ষায় কোন উদ্যোগ নেবে? আর দ্বীপের দুর্বল বিচার ব্যবস্থা তাদের এক্ষেত্রে বাধ্যও করতে পারবে না।
“এখানে সবাই টিনের খনিতে কাজ করে। তারা পরিবেশ নিয়ে চিন্তিত না,” বলেন সারিয়া, যিনি ঐ হামলার পর আর কখনোই পানির কাছে যান নি। যদি তার পরিবারের পানির দরকার হয় তাহলে অন্য স্বেচ্ছাসেবক সদস্যরা সেটা এনে দেয়।
তিনি মনে করেন তিনি সৌভাগ্যবতী যে এখনো বেঁচে আছেন, তবে তার বাম হাত ও আঙুল নাড়াতে গেলে এখনো ব্যথা অনুভব করেন।
তিনি বলেন, “মাঝে মধ্যে আমি যখন ঘুমাই, স্বপ্নে সেই হামলার ঘটনা ফেরত আসে।”