‘ফ্যান্টাস্টিক টিম। ম্যাসিভ গেম। গ্রেট বোলিং অ্যাটাক। ওয়েল রাউন্ডেড। দারুণ সব স্পিনার। সিমাররাও খুব ভাল করেছে।’
বক্তার নাম এইডেন মারক্রাম – দক্ষিণ আফ্রিকার মারকুটে ব্যাটার। এতগুলো বিশেষণ দরাজভাবে যাদের সম্বন্ধে প্রয়োগ করলেন, তারা আর কেউ নয় – বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম।
মঙ্গলবার মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে-তে বিশ্বকাপে দু’দলের ম্যাচের ঠিক আগের বিকেলে।
বিশ্বকাপে যে কোনও ম্যাচের আগে প্রতিপক্ষ যারাই হোক, তাদের সমীহ করে ভাল ভাল কথা বলার রেওয়াজ আছে। মারক্রামের কথাগুলোকেও সেভাবে নিলেও চলত, কিন্তু কথাগুলো যে তিনি বিশ্বাস করেই বলছেন তা বুঝতে কোনও অসুবিধা হযনি।
আসলে বিশ্বকাপে বাংলাদেশ আর দক্ষিণ আফ্রিকার যখনই মুখোমুখি দেখা হয়েছে, সে সব ম্যাচ এমনই ওঠাপড়া দেখেছে যে কোনও দলেরই প্রতিপক্ষকে হালকা করে দেখার সুযোগ নেই।
কুড়ি বছর আগে ২০০৩য়ে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে স্বাগতিকদের কাছে শোচনীয় পরাজয়ের ঠিক চার বছর বাদে বাংলাদেশ তার দারুণ বদলা নিয়েছিল ক্যারিবিয়ানে।
এরপর ২০১১ সালের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ হেরে গেলেও আট বছর বাদে লন্ডনের ওভালে কিন্তু সেই দক্ষিণ আফ্রিকাকেই আবার হারায় তারা। ফলে এই টুর্নামেন্টের ইতিহাসে দুই দলের স্কোরলাইন দুই – দুই।
এই মুহুর্তে অবশ্য দক্ষিণ আফ্রিকা দারুণ ফর্মে – ইংল্যান্ডকে ২২৯ রানে বিধ্বস্ত করে হারিয়ে তাদের মনোবলও তুঙ্গে। নেদারল্যান্ডেসের বিরুদ্ধে হোঁচট খাওয়ার ইতিহাস দ্রুত মুছে ফেলতে মরিয়া।
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মঙ্গলবার জিততে পারলে তারা উঠে আসবে পয়েন্ট টেবিলের দু’নম্বরে – ভারতের ঠিক পরেই।
উল্টো দিকে হারের হ্যাটট্রিকে কোণঠাসা বাংলাদেশের জন্য শেষ চারে যাওয়ার সম্ভাবনা টিঁকিয়ে রাখতে এই ম্যাচটায় জেতা ভীষণ ভীষণ জরুরি।
বিশ্বকাপের আসরে এই প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হওয়া বাংলাদেশ ক্যাপ্টেন সাকিব আল হাসানও সেটা কার্যত স্বীকারই করে নিলেন সোমবার সন্ধ্যায়।
ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের প্রেস কনফারেন্স হলে সাকিব জানালেন, “ক্রিকেটে এসব ওঠাপড়া থাকেই। বিশেষত বিশ্বকাপের মতো টুর্নামেন্টে!”
নেদারল্যান্ডস যেভাবে দক্ষিণ আফ্রিকার ‘উড়ান’ থামিয়ে দিয়েছিল কিংবা আফগানিস্তান চমকে দিয়েছিল ইংল্যান্ডকে – ঠিক সেভাবেই মঙ্গলবার দিনটাও অনায়াসে বাংলাদেশের হতেই পারে, এই আত্মবিশ্বাসই ঝরে পড়ল সাকিবের গলায়।
‘টুর্নামেন্টের মাঝপথে’ দলের পারফরম্যান্স নিয়ে তিনি যে মতামত দেবেন না এবং কোনওভাবেই হাল ছাড়বেন না – বারে বারে স্পষ্ট করে দিলেন সেটাও।
তাসকিন বিশ্রামে, সাকিব ইন?
বাংলাদেশের সিম বোলিংয়ের সেরা অস্ত্র তাসকিন আহমেদকে পুনে-তে ভারতের বিরুদ্ধে ম্যাচে পাওয়া যায়নি, মুম্বাইতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধেও তিনি খেলতে পারছেন না।
প্রাক-ম্যাচ সাংবাদিক বৈঠকে এ খবর নিশ্চিত করে সাকিব জানালেন, “তাসকিন আসলে কাঁধের একটা সমস্যায় ভুগছে। ডাক্তাররা বলেছেন এক-দুটো ম্যাচ বিশ্রাম পেলে ও আবার পুরোপুরি ফিট হয়ে মাঠে ফিরতে পারবে।”
তাসকিনকে তাই ঝুঁকি নিয়ে খেলানোর চেয়ে দু’টো ম্যাচে বিশ্রাম দিয়ে টুর্নামেন্টের শেষ ভাগে আবার ফিরে পেতে চাইছে বাংলাদেশ।
সাকিবের কথা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া গেল, কলকাতায় নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে ম্যাচেই (২৮শে অক্টোবর) হয়তো তাসকিন আবার প্রথম এগারোতে ফিরবেন।
কিন্তু তার নিজের চোটের অবস্থা কেমন? দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে তিনি কি নামছেনই?
“রবিবার তো প্র্যাকটিস করলাম, তখন কিছু্ই (যন্ত্রণা বা অস্বস্তি) টের পাইনি। আজকেও (রবিবার সন্ধ্যায়) প্র্যাকটিস করব, আশা করছি কোনও অসুবিধা হবে না। যদি না-হয়, কালকে মনে হয় আমি ‘গুড টু গো’!”, খেলার ইঙ্গিত দিয়ে জানালেন সাকিব নিজেই।
বিশ্বকাপের মতো টুর্নামেন্টে একটা ম্যাচ ‘মিস’ করাও যে আফসোস ও আক্ষেপের, সেটাও স্বীকার করলেন নির্দ্বিধায়।
বোঝা গেল, ভারতের বিরুদ্ধে ম্যাচটা খেলতে না-পারার যন্ত্রণা তাকে ভোগাচ্ছে।
“ব্যাটিং তো করেছি কোনও সমস্যা ছাড়াই। এখন একটু রানিং করব – কোনও ইস্যু না-থাকলে কাল খেলছি আলহামদুলিল্লাহ্”, সোমবার সন্ধ্যায় এই আপডেট পাওয়া গেল সাকিবের নিজের মুখ থেকেই।
গরম, ঘাম, আর্দ্রতা আর টস
মুম্বাইয়ে মঙ্গলবার বিকেলে তাপমাত্রা প্রায় ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছবে বলে আবহাওয়া বিভাগের পূর্বাভাস।
সঙ্গে বাতাসের আর্দ্রতা থাকবে প্রায় ৬০ শতাংশ – মানে যাকে বলে একেবারে গরম আর ঘাম-জ্যাবজ্যাবে কন্ডিশন।
মুম্বাইয়ের বিখ্যাত মেরিন ড্রাইভ থেকে ওয়াংখেড়ের দূরত্বও বড়জোর একশো বা দুশো মিটার – কাজেই আরব সাগরের লোনা বাতাসও ক্রিকেটারদের ভোগাবে।
শুক্রবার এই মাঠেই ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ঝোড়ো ইনিংস খেলা হেনরিক ক্লাসেন যে পরিমাণ ঘেমেছেন আর কাহিল হয়েছেন – তা থেকে ‘ক্লাসি’ যে এখনও পুরোটা সেরেই উঠতে পারেনি, সে কথা জানালেন মারক্রাম।
“ক্লাসি এমনিতেই বেশি ঘামে। তার ওপর এই মারাত্মক গরম আর আর্দ্রতা – খেলার সময় এমনিতেই আপনার ভেতর থেকে সব এনার্জি যেন শুষে নেয়!”, ঠিক অভিযোগের সুরে না-হলেও অনুযোগই যেন শোনা গেল দক্ষিণ আফ্রিকান ব্যাটারের কণ্ঠে।
সাকিব নিজে এ মাঠে আইপিএলের ম্যাচ খেলেছেন বছর পাঁচেক আগেও।
তার উপলব্ধি হল, “এখানে যতই জল খান না কেন, প্রচুর ঘাম হয় বলে শরীরে পানির স্বল্পতা বা ডিহাইড্রেশন হয়েই যায়। ওটা ঠেকানো খুব মুশকিল।”
এর পরও যে দলের ক্রিকেটাররা এই আর্দ্রতার সমস্যা মোকাবিলা করে নিজেদের হাউড্রেটেড ও এনার্জেটিক রাখতে পারবে, তাদের একটা ‘আপারহ্যান্ড’ যে থাকবে, সেটা স্বীকার করতে কোনও দ্বিধা নেই বাংলাদেশ ক্যাপ্টেনের।
ওয়াংখেড়েতে এই সময় দিন রাতের ম্যাচ হলে গরমে কাহিল বোলারদের বিরুদ্ধে প্রথমে ব্যাট করা দল একটা বাড়তি সুবিধা পায়ই।
বস্তুত গত ১০টা ওয়ান-ডেতে এই মাঠে প্রথমে ব্যাট করা দলের গড় রান তিনশোর ওপরে – যা প্রায় অভাবনীয়।
আবার সন্ধ্যার পর ফিল্ডিং টিমের বোলাররা সুবিধে পায় কন্ডিশন থেকে – যেটা ইংল্যান্ড-দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচেও দিব্বি দেখা গেছে।
সাকিব আর হাসান বাংলাদেশি সাংবাদিকদের উদ্দেশে তাই এক গাল হেসে বলেই ফেললেন, “দোয়া করবেন কাল যেন টসটা জিততে পারি!”
‘অন্য দলগুলো হেল্প করছে’
পরপর ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড আর ভারতের কাছে বড় ব্যবধানে হেরে বাংলাদেশের সেমিফাইনালে যাওয়ার সম্ভাবনা কতটা অবশিষ্ট আছে, তা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হচ্ছে।
কাগজে-কলমে এখনও সম্ভব হলেও কাজটা যে আসলে কতটা কঠিন, ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা সেটাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন।
সাকিব আল হাসান কিন্তু জোর গলায় বলছেন, “আমরা হয়তো বিশ্বকাপে খুব একটা বেশি জিতিনি, তার পরেও পয়েন্টস টেবিল দেখলে দেখবেন বাংলাদেশ কিন্তু মোটেও খুব একটা খারাপ অবস্থায় নেই।”
বরং সেমিফাইনালে যাওয়ার ‘এখনও খুব ভালো সম্ভাবনাই আছে’ বলে তিনি মনে করছেন।
“আসলে অন্য টিমগুলো এক্ষেত্রে আমাদের খুব হেল্প করছে। সেই কারণেই আমাদের এখনও ভালো সম্ভাবনা আছে – এখন আমাদের দায়িত্ব (বাকি ম্যাচগুলোয় জিতে) সেটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া”, জানালেন সাকিব।
বিশ্বকাপে যেভাবে অনেকগুলো ‘অঘটন’ ঘটেছে এবং অপ্রত্যাশিতভাবে এক একটা টিম তাদের তুলনায় র্যাঙ্কিংয়ে অনেক ওপরে থাকা টিমকে হেলায় হারিয়েছে – সে দিকে ইঙ্গিত করেই যে তিনি কথাটা বললেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
দিনকয়েক আগে বাংলাদেশের হেড কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহেও এই কথাটাই একটু অন্যভাবে বলেছিলেন, “টুর্নামেন্টটা এখন অনেক ‘ওপেন’ হয়ে গেছে। মানে যে কোনও দল যে কোনও জায়গায় পৌঁছে যেতে পারে।”
ঠিক সেই বাস্তবতা থেকেই দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচের আগে বাংলাদেশ অধিনায়কও তাই জানালেন, বাংলাদেশ সমর্থকদের এখনই হতাশ হওয়ার কোনও কারণ ঘটেনি।
“যদি জিততে না-পারি, বিশ্বকাপের পরে হতাশা দেখানোর অনেক সময় পাবেন। কিন্তু এখনই প্লিজ হতাশ হবেন না!”