ঘূর্ণিঝড় হামুনের প্রভাবে চট্টগ্রামে সকাল থেকেই বৃষ্টিপাত হচ্ছে, সমুদ্র উত্তাল রয়েছে। কক্সবাজার জেলা মঙ্গলবার বিকাল থেকেই বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় রয়েছে।
সন্ধ্যার পর থেকে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার উপকূল দিয়ে অতিক্রম করতে শুরু করেছে ঘূর্ণিঝড় হামুন।
বঙ্গোপসাগর এলাকায় অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড় হামুন উপকূল অতিক্রম করতে শুরু করায় উপকূলবর্তী জেলাসমূহে সব ধরণের প্রস্তুতি নেয়ার কথা জানিয়েছে স্থানীয় জেলা প্রশাসন।
উপকূলীয় এলাকায় মাইকিং করার পাশাপাশি আশ্রয়কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত রাখার কথা জানিয়েছেন তারা।
অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়টি মঙ্গলবার দুপুর নাগাদ কিছুটা দুর্বল হয়ে প্রবল ঘূর্ণিঝড় এবং সন্ধ্যায় আরও দুর্বল হয়ে সাধারণ ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়।
চট্টগ্রাম জেলায় সকাল থেকেই বৃষ্টিপাত চলছে তবে সন্ধ্যা থেকে বৃষ্টির তীব্রতা বাড়তে থাকে সেইসাথে সমুদ্র বেশ উত্তাল অবস্থায় আছে।
সন্ধ্যার পর থেকে উপকূল অতিক্রম করতে শুরু করলেও ঝড়টি পুরোপুরি উপকূলে উঠে আসতে আট-দশ ঘণ্টা লাগবে বলে আবহাওয়া অধিদপফতর জানিয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে প্রায় সাড়ে চারশো আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখার কথা জানান জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান।
আরও সাড়ে তিনশ আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হচ্ছে এবং প্রতিটি আশ্রয় কেন্দ্রে শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি, পানি বিশুদ্ধিকরণ ট্যাবলেট, শিশু খাদ্য ও গবাদিপশুদের খাবারের বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে তিনি জানান। প্রস্তুত রাখা হয়েছে ২৯০টি মেডিকেল টিম।
অনেক মানুষ এসব আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছেন বলে জানা যাচ্ছে।
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সন্দ্বীপ সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছে এমন আশঙ্কা থেকে সেখানে বাড়তি প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।
সারা জেলায় প্রায় নয় হাজার স্বেচ্ছাসেবক মাইকিংয়ের মাধ্যমে মানুষকে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছে।
সেইসাথে গভীর সাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলার সমূহকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।
এদিকে কক্সবাজারে সকাল থেকে গুড়ি গুড়ি থেকে হালকা বৃষ্টিপাত চললেও বিকেল থেকে বৃষ্টিপাতের বেগ বাড়তে থাকে এবং সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ তীব্র বৃষ্টি ও দমকা হাওয়া বইতে শুরু করেছে।
সন্ধ্যা থেকেই বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে কক্সবাজার শহর। এ অবস্থায় আশ্রয় কেন্দ্রগুলোয় মোমবাতি ও টর্চলাইটের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম।
ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস পেয়ে গতকাল থেকেই জেলার ৫৭৬টি আশ্রয় কেন্দ্রের মধ্যে ৯৭টি আশ্রয় কেন্দ্রে অন্তত ২৯ হাজার মানুষকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। সেখানে শুকনো খাবার ও খিচুরি রান্নার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
উপকূলীয় এলাকার মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে আসার জন্য আজ দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাইকিং করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
এদিকে ভারী বর্ষণের প্রভাবে কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলের কোথাও কোথাও ভূমিধ্বসের আশঙ্কা আছে।
আবহাওয়ার সবশেষ বুলেটিনে চট্টগ্রামের মতো কক্সবাজার সমুদ্র বন্দরকে সাত নম্বর বিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
এদিকে পটুয়াখালীর উপকূলীয় অঞ্চলের আবহাওয়া সকাল থেকে অনেকটাই শান্ত রয়েছে। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন এবং কোথাও কোথাও গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়লেও সন্ধ্যা পর্যন্ত ভারী বৃষ্টিপাত বা দমকা হাওয়া বয়ে যায়নি।
তবে সাগর ও নদী স্বাভাবিকের চাইতে কিছুটা উত্তাল রয়েছে। বিশেষ করে কুয়াকাটা সংলগ্ন বঙ্গোপসাগর বেশ উত্তাল।
সকাল থেকে বন্ধ রাখা হয়েছে পটুয়াখালী-ঢাকাসহ সব রুটের লঞ্চসহ নৌযান চলাচল। এসব নৌযানকে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলা হয়েছে।
সেইসাথে পটুয়াখালীর পায়রা বন্দর পাঁচ নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় থাকায় বন্দরের চ্যানেল থেকে মঙ্গলবার সব জাহাজ নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং বন্দরের নিজস্ব জলযান ও ইকুইপমন্টেসগুলো সর্বোচ্চ নিরাপদ অবস্থানে রাখা হয়েছে।
বেলা বাড়ার সাথে সাথে উপকূলীয় এলাকায় বাতাসের তীব্রতা বাড়তে পারে এবং ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে পটুয়াখালী জেলার ৭০৩টি আশ্রয়কেন্দ্র এবং ৩৫টি মুজিবকেল্লা ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় প্রস্তুত রাখার কথা জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মো. নূর কুতুবুল আলম।
প্রয়োজনে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেও আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। এসব আশ্রয় কেন্দ্রের জন্য ৮৩টি মেডিকেল টিম গঠনের পাশাপাশি পর্যাপ্ত ত্রাণ সামগ্রী বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
প্রথমে পায়রা ও মোংলা সমুদ্র বন্দরে সাত নম্বর সতর্ক সংকেত দেয়া হয়েছিল। কিন্তু পরে ঝড়টি চট্টগ্রামের দিকে গেলে সংকেত নামিয়ে পাঁচ নম্বর সতর্ক সংকেত দেয়া হয়।
বরগুনার পাথরঘাটার একজন স্বেচ্ছাসেবী আরাফাত সগির জানিয়েছেন, ঝড়ের খবর শুনে অনেকে আশ্রয় কেন্দ্রে গিয়েছিলেন। তবে সিগন্যাল নামিয়ে দেয়ায় মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকে তারা আবার বাড়িতে ফিরতে শুরু করেছেন।
আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে পটুয়াখালীর পাশাপাশি ফেনী, বরগুনা, ভোলা, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি এবং এর আশেপাশের দ্বীপ ও চরসমূহের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে তিন থেকে পাঁচ ফুট বেশি উচ্চতার বায়ু তাড়িত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।
এক্ষেত্রে জেলার রাঙ্গাবালী, গলাচিপা এবং কলাপাড়া বেশি দুর্যোগপূর্ণ হওয়ায় সেখানে বাড়তি প্রস্তুতি নেয়ার কথা জানান মি. আলম।
এজন্য মাঠ পর্যায়ে কাজ করেছে অন্তত আট হাজার স্বেচ্ছাসেবক। এছাড়া স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তারাও মাঠে কাজ করছেন এবং সকাল থেকে তারা মাইকিং করে মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে বলছেন। কোস্টগার্ড, পুলিশ, আনসার, ফায়ার সার্ভিসকে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড়টির সাতক্ষীরা উপকূলে আঘাত হানার আশঙ্কা না থাকলেও ঝড়ের প্রভাবে নদীতে পানির উচ্চতা বাড়তে পারে এবং বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হতে পারে।
এজন্য প্রায় তিনশ সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত রাখার পাশাপাশি পানিপথে মানুষকে পারাপার করতে বেশ কয়েকটি ট্রলারও নিয়োজিত রাখা হয়েছে। সেইসাথে ওষুধ ও শুকনো খাবারও প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
মঙ্গলবার সাতক্ষীরা জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় এসব প্রস্তুতির কথা জানানো হয়।
এদিকে খুলনা জেলায় আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলেও বৃষ্টিপাত হচ্ছে না। তবে বেলা গড়ালে দমকা বাতাস, ভারি বৃষ্টি ও নদীতে পানির উচ্চতা বাড়তে পারে, এই আশঙ্কা থেকে ৬০৪টি সাইক্লোন সেন্টার প্রস্তুত রাখার কথা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন সেখানকার জেলা প্রশাসক।
মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে পাঁচ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবক। শুকনো খাবার ও ওষুধের পাশাপাশি জেলার ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, নৌ-বাহিনী, কোস্টগার্ডকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে বলে তিনি জানান।
মঙ্গলবারের সবশেষ বুলেটিনে মংলা সমুদ্র বন্দরকে পাঁচ নম্বর বিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্যমতে, উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর এবং এর আশেপাশের দ্বীপ ও চরসমূহ সমূহ সাত নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে।
এ অবস্থায় লক্ষ্মীপুরের জেলা প্রশাসক সুরাইয়া জাহান মঙ্গলবার দুপুরে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় ২৮৫ টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখার পাশাপাশি চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে ৬৪টি মেডিকেল টিম গঠন করার কথা জানিয়েছেন।
উপকূল তীরবর্তী চারটি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিরা মাইকিং করে মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে নেওয়া জন্য কাজ করছেন।
নোয়াখালী জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকায় মাইকিং করে স্থানীয়দের আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে বলে জানিয়েছে সেখানকার জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান।
সেইসাথে মেডিকেল টিমের পাশাপাশি আশ্রয় কেন্দ্রে আসা মানুষদের জন্য শুকনো খাবারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে বলে তিনি জানান।
এদিকে ভাসানচরে ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় নৌবাহিনী সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে বলে উল্লেখ করেন মি. রহমান।
প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের অগ্রবর্তী অংশের প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় দমকা ও ঝড়ো হাওয়াসহ অতি ভারী বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে।
ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণের পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে।
আবহাওয়া দফতরের সবশেষ বুলেটিন অনুযায়ী, প্রবল ঘূর্ণিঝড়টি চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর থেকে ১৬০ কিলোমিটার, কক্সবাজার সমুদ্র বন্দর থেকে ১২০ কিলোমিটার, মংলা সমুদ্র বন্দর থেকে ২২৫ কিলোমিটার এবং পায়রা সমুদ্র বন্দর থেকে ১৩৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছে।
প্রবল ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটার যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর প্রভাবে সাগর উত্তাল রয়েছে।