শনিবার ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ স্থলের কাছে সংঘর্ষ ও সহিংসতায় এক পুলিশ সদস্যের মৃত্যুর জের ধরে সমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর, নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও সহিংস হয়ে ওঠার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বিএনপি মহাসমাবেশ পণ্ড করার জন্য পুলিশ ও সরকারকে দোষারোপ করে জনগণকে ‘রুখে দাঁড়াতে এবং প্রতিরোধের’ আহবান জানিয়েছে।
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ স্পষ্ট করে বলেছে বিএনপিকে আর কোন ছাড়ই তারা দেবে না, বরং প্রতিহত করবে।
বিএনপি রোববার যে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে, তাতে সমমনা কয়েকটি দলও হরতালের ঘোষণা দিলেও আওয়ামী লীগ বলছে, ‘রাজপথেই তারা বিএনপিকে প্রতিহত’ করবে এবং হরতালের বিপরীতে দেশব্যাপী শান্তি সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে দলটি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, উভয় দলের কথাবার্তা ও পরস্পরের প্রতি হুমকিসুলভ বক্তৃতা থেকে আরও সহিংসতারই আভাস পাচ্ছেন তারা এবং নির্বাচনের আগে পরিস্থিতি আরও জটিল হওয়ার আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে বলে তারা মনে করেন।
প্রসঙ্গত, নভেম্বরের মাঝামাঝি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার কথা নির্বাচন কমিশনের এবং তাদের প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ভোট গ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করা হতে পারে।
বিএনপি আসন্ন এই নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনে আয়োজনের দাবিতে অনেকদিন ধরেই আন্দোলন করে আসছে এবং শনিবারের সমাবেশের পরই তাদের চূড়ান্ত কর্মসূচি ঘোষণার কথা ছিলো।
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ বরাবরই বলে আসছে আগামী নির্বাচন শেখ হাসিনা সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে এবং সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তারা বিএনপির সমাবেশের দিনেই পাল্টা কর্মসূচি পালন করে আসছে।
তবে শনিবার ঢাকায় আওয়ামী লীগের সমাবেশে দলটির সিনিয়র নেতারা বলেছেন এখন থেকে তারা বিএনপিকে রাজপথে ‘প্রতিহত’ করবেন।
ওদিকে ঢাকায় পুলিশ সদস্যের মৃত্যুর জন্য বিএনপির সহযোগী সংগঠন ছাত্রদলের এক নেতাকে দায়ী করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল।
‘সহিংস আচরণ চেপে রাখা গেলো না’
ঢাকায় দুপুরে নয়াপল্টনে বিএনপির সমাবেশের আশেপাশে যখন ব্যাপক সংঘর্ষ চলছিলো তখনও নেতারা বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছিলেন।
কিন্তু বেলা তিনটার পরপরই টিয়ারশেল আর সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে দলটির সমাবেশে।
এক পর্যায়ে মাইক বন্ধ হয়ে যায় এবং হুড়োহুড়ি শুরু হলে হ্যান্ড মাইকেই রোববার সারাদেশে সকাল সন্ধ্যা হরতালের ঘোষণা দেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
কিন্তু মঞ্চ থেকে নামার আগে কয়েক মিনিটের বক্তৃতায় তিনি বারবারই সরকারকে রুখে দেয়া বা প্রতিরোধের জন্য জনগণের কাছে আহবান জানিয়েছেন।
রোববার বিএনপি যখন সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করবে তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে যোগ দেয়ার কর্মসূচি রয়েছে।
বিএনপির সমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেইটে আরও কড়া ভাষায় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ দলটির সিনিয়র নেতারা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচনকে সামনে রেখে ভিসা নীতি ঘোষণার পর থেকে সরকার ও বিরোধী দল সহিংসতায় না জড়িয়ে এক ধরণের সংযম প্রদর্শন করে আসছিলো কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটি তারা আর ধরে রাখতে পারেনি।
গত ২৭শে মে বাংলাদেশের উদ্দেশে ভিসা নীতি ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র।
গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে মনে করলে সেই ব্যক্তি ও তার পরিবারের সদস্যদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞার কথা জানানো হয় সেসময়।
পরে গত ২২শে সেপ্টেম্বর সেই ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ শুরুর কথা জানায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন বলছেন, নানা চাপে দুই দলই এতদিন সহিংসতা চেপে রেখেছিলো, কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না বলেই মনে করেন তিনি।
“বিএনপির নেতৃত্বের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে শনিবারের ঘটনায়। আবার সরকার নানা চাপে রয়ে সয়ে থাকলেও শেষ পর্যন্ত সহিংস উপায়ে হলেও সহিংসতা ঠেকানোর পথ বেছে নিতেও দ্বিধা যে করবে না, সেটিই বুঝিয়ে দিয়েছে। এ থেকে সামনের দিনগুলোতে সহিংসতারই আভাস পাচ্ছি,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের নানা চাপের কারণে বিরোধী দল বিশেষ করে বিএনপিকে সভা সমাবেশের ক্ষেত্রে এতদিন যে সহযোগিতা পুলিশ-প্রশাসন করে আসছিলো সেটি আর অব্যাহত থাকবে-না বলেই মনে করছেন অনেকে।
‘হয় সহিংসতা, নয় একপেশে’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন তার ধারণা বিএনপি রুখে দাঁড়াতে সক্ষম হলে সহিংসতার আশঙ্কা আছে। কিন্তু সে সম্ভাবনা কম, বরং নির্বাচনকালীন পরিস্থিতি একপেশে হয়ে পড়বে বলেই তার ধারণা।
বিবিসি বাংলাকে মি. আহমেদ বলেন, “রাষ্ট্র ও সরকারি দল এক হয়ে কাজ করছে। তাই স্বতঃস্ফূর্ত গণঅভ্যুত্থান ছাড়া কারও পক্ষে শক্ত বিরোধিতা করে টিকে থাকা কঠিন। কিন্তু বিএনপি তেমন পরিস্থিতি আদৌ তৈরি করতে পেরেছে কি-না সেই প্রশ্ন আছে।
বরং শনিবার সমাবেশ তো করতেই পারলো না দলটি, পাশাপাশি পুলিশ সদস্য ও বাসে আগুনের দায়ও নিতে হচ্ছে তাদের।”
অর্থাৎ শনিবার বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে যে সহিংসতা হয়েছে তাতে একজন পুলিশ সদস্যকে হত্যার ঘটনা ছাড়াও বাসে আগুন দেয়ার ঘটনাগুলোর জন্য সরকার যে বিএনপিকেই দায়ী করছে, তার জেরে সামনের দিনগুলোতে পুলিশকে আরও কঠোর অবস্থানে দেখতে পাবেন বলেও অনেকে ধারণা করছেন।
আবার হরতাল কর্মসূচি দিয়ে বিএনপির যথাযথ রাজনৈতিক পরিপক্বতার প্রমাণ দিতে পারেনি বলে মনে করেন মি. আহমেদ।
“আমার ধারণা আওয়ামী লীগ এ সুযোগও নেবে, কারণ মানুষ হরতাল পছন্দ করে না বহুকাল ধরেই। আগেও সহিংসতা করে হরতাল সফল করা হতো। কিন্তু এখন তেমনটাও সম্ভব হবে না। এসব জেনেও বিএনপি এই কর্মসূচিই দিয়েছে, যাতে আরও সহিংসতার পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে,” বলছিলেন তিনি।
ওদিকে, পুলিশ সদস্য হত্যার ঘটনা ছাড়াও ঢাকায় রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে হামলার ঘটনা অনেকে মনে করেন বিএনপিকে পুলিশের আরও মুখোমুখি করে দিয়েছে। এটিই হয়তো নির্বাচন পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে বলে মনে করেন কেউ কেউ।
মি. আহমেদ বলছিলেন, “বিএনপি আসলে অনেকটাই ফেঁসে গেছে। তারা সমাবেশই করতে পারেনি, কিন্তু তার আগেই সহিংসতায় জড়িয়ে গিলো। পরিস্থিতি যেদিকে গেছে সেখানে বিএনপির বিরুদ্ধে আগুন সন্ত্রাসের যে প্রচার আছে সেটিই সরকারও আরও জোরেশোরে প্রচার করবে।”
অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন বলছেন, শনিবারের সহিংসতার রেশ খুব দ্রুত কেটে যাবে বলে মনে হয় না তার কাছে।
“বরং এর রেশ ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আরও সহিংসতা জায়গা করে নিতে পারে বলে মনে হচ্ছে,” বলছিলেন তিনি।