বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আগামী নির্বাচন নিয়ে চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে বিরোধী দল বিএনপির সাথে সংলাপ বা সমঝোতার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন এর কোন প্রয়োজনীয়তাই তারা বোধ করছেন না।
অন্যদিকে বিরোধী দল বিএনপি সরকারের পদত্যাগের দাবিতে রোববারের হরতালের পর নতুন করে চলতি সপ্তাহেই তিনদিনের সর্বাত্মক অবরোধের কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে।
দলটির নেতারা বলছেন নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি আওয়ামী লীগ মেনে নিলেই কেবল একটি সমঝোতার পথ উন্মুক্ত হতে পারে।
আর নির্বাচন নিয়ে বিএনপির এমন অবস্থানের বিপরীতে আওয়ামী লীগ যে অবস্থানে অনড় তা হলো- আগামী সংসদ নির্বাচন হবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনেই।
যদিও নির্বাচন সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব এবং দেশের ভেতর থেকে সিভিল সোসাইটির নেতৃবৃন্দও উভয় পক্ষকে অনুরোধ করে আসছে।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অর্থায়নে ঢাকা সফর করে যাওয়া প্রাক নির্বাচনী পর্যবেক্ষক মিশন ওয়াশিংটনে ফিরে গিয়ে যে সুপারিশমালা প্রকাশ করেছিলো তাতেও ‘নির্বাচন ইস্যুতে সংলাপ’কেই সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছিলো।
কিন্তু এ সত্ত্বেও বিএনপি শুরু থেকেই ‘রাজপথেই ফয়সালা হবে’ আর আওয়ামী লীগ ‘বিএনপিকে কোন ছাড় নয়’ নীতি নিয়েই অগ্রসর হয়েছে এবং যার জের ধরে ২৮শে অক্টোবর দুই দলের পাল্টাপাল্টি মহাসমাবেশের দিনে ব্যাপক সহিংসতায় এক পুলিশ সদস্যসহ দুই জনের মৃত্যুর পর বিএনপি মহাসচিবসহ অনেককেই আটক করেছে পুলিশ।
আর উদ্ভূত এই পরিস্থিতির পর নির্বাচন নিয়ে সংলাপ বা সমঝোতার পরিবেশ তৈরির আর কোন সুযোগ আছে বলে মনে করেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন।
আরেকজন বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন দুই প্রধান রাজনৈতিক দল সবসময়ই নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকায় সমঝোতার কোন সুযোগ আগেও কখনো তৈরি হয়নি।
সংলাপ নিয়ে আওয়ামী লীগ
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন আলোচনার পথ বিএনপিই রুদ্ধ করেছে। “সংলাপের কোন প্রয়োজন নেই। আগ বাড়িয়ে সংলাপের চিন্তা করছি না,” বলছিলেন তিনি।
তিনি স্পষ্ট করেই জানান যে ক্ষমতার পরিবর্তন করতে হলে নির্বাচনের কোন বিকল্প নেই এবং দেশে সময় মতোই নির্বাচন হবে। “যদি কেউ মনে করে সহিংসতা করে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করবেন, সেটা হতে দেবো না।”
মি. কাদের বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকবেন। তিনিই নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। পার্লামেন্ট স্থিতাবস্থায় থাকবে এবং নির্বাচন কমিশন যা আছে তাই থাকবে”।
অর্থাৎ নির্বাচনকালীন সরকার ও নির্বাচন কমিশন প্রশ্নে আওয়ামী লীগ তাদের আগের অবস্থানেই অনড় থাকার কথাই প্রকাশ করলো।
যদিও বিএনপি যে সরকারবিরোধী আন্দোলন করছে তার মূলেই এই দুটি ইস্যু। বিএনপি বলেছে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন তারা গ্রহণ করবে না আর বর্তমান নির্বাচন কমিশনও পুনর্গঠন করতে হবে একটি নির্দলীয় সরকার গঠনের পর।
শনিবারের সহিংসতার পর আওয়ামী লীগকে কার্যত বিএনপির বিরুদ্ধে আরও কঠোর বলেও মনে হচ্ছে অনেকের কাছে। মিস্টার কাদের নিজেও তার দলের প্রতিটি নেতাকর্মীকে নির্বাচন পর্যন্ত বিএনপির বিরুদ্ধে সতর্ক থাকার আহবান জানিয়েছেন।
“আমরা কারও সাথে সংঘাতে যাবো না। গায়ে পড়ে সংঘাত কেন করবো ? আমরা শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চাই। সেজন্য শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করছি। কোন উস্কানি দিবো না। আমরা আমাদের কাজ করবো। কিন্তু তারা আমাদের ওপর হামলে পড়লে পরিস্থিতি যা বলবে আমরা তাই করবো,” বলছিলেন মি. কাদের।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরীন বলছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যে এটা পরিষ্কার যে তারা বিএনপির বিরুদ্ধে আরও কঠোর অবস্থান নিতে যাচ্ছেন এবং নির্বাচনকে সামনে রেখে কোন ধরণের ‘ছাড় দেয়া’র ইচ্ছেই তাদের নেই।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার ছাড়াও বিএনপি নেতাদের ঘরবাড়িতে তল্লাশি ছাড়াও সহিংসতার জন্য আরও মামলা হবে বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান যে ঘোষণা দিয়েছেন তাকে বিএনপির বিরুদ্ধে সরকারের আরও শক্ত পদক্ষেপের ইঙ্গিত হিসেবেও বিবেচনা করা হচ্ছে।
অনেকে মনে করছেন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে ও পরে বিএনপি বা বিরোধীরা যেন আর কোন অস্বস্তিকর পরিবেশ সরকারের জন্য তৈরি করতে না পারে সেটিই আসলে নিশ্চিত করতে চাইছে সরকার।
“২৮শে অক্টোবরে যে সহিংসতা হলো সেই বাস্তবতায় আওয়ামী লীগ যা বলছে তাতে আসলে সমঝোতার চিন্তা করারই আর কোন সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। পরিস্থিতি যাই হোক বিএনপির জন্য আওয়ামী লীগের সংলাপের দরজা খোলা নেই-এটিই এখন বাস্তবতা,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন জোবাইদা নাসরীন।
সংলাপ ও বিএনপি
বিএনপি মাঝে মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের কথা বললেও বরাবরই তার আগে একটি শর্ত জুড়ে দিয়ে আসছে তারা এবং সেটি হলো নির্বাচনকালীন সরকারের দাবি আওয়ামী লীগকে আগে মেনে নিতে হবে।
এটি না হলে রাজপথের আন্দোলনের মাধ্যমেই তারা বিষয়টির ফয়সালা করবেন এমন কথাই গত দু বছরেরও বেশি সময় ধরে বলে আসছেন তারা।
কিন্তু গত কিছুদিনের ধারাবাহিক আন্দোলনের পর শনিবার ঢাকার মহাসমাবেশে ব্যাপক লোকসমাগম করেও শেষ পর্যন্ত সেটি সফল করতে পারেনি দলটি। বরং সহিংসতায় মহাসমাবেশ পণ্ড হয়ে গেছে এবং দলটির মহাসচিব নিজেও বক্তৃতা করার সুযোগ পাননি।
সংঘাত সহিংসতায় একজন একজন পুলিশ সদস্যসহ দুজন মারা গেছে এবং এর জের ধরে মি. আলমগীরসহ অনেককেই আটক করেছে পুলিশ।
এর প্রতিবাদে এবং সরকারের পদত্যাগের দাবিতে তিনদিনের অবরোধের কর্মসূচি দেয়ার পর সংলাপ বা সমঝোতার আর কোন সুযোগ থাকে কি-না সেটিও বড় প্রশ্ন।
তবে দলটির যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বিবিসি বাংলাকে বলছেন তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ নমনীয় হলেই সমঝোতার পরিবেশ তৈরির পথ উন্মুক্ত হতে পারে।
“আওয়ামী লীগ বড় রাজনৈতিক দল। ভোটে না হলেও তারা তিন মেয়াদে ক্ষমতায়। তাই তাদের নমনীয় হওয়াটাই প্রত্যাশা করে সবাই। তারা যদি বলে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার হবে তাহলেই তো সমঝোতার পরিবেশ তৈরি হতে পারে,” বলছিলেন তিনি।
অর্থাৎ সংলাপ বা সমঝোতার জন্য বিএনপির দিকে থেকেও বড় শর্ত আছে এবং তা হলো আগে আওয়ামী লীগকে আলোচনায় বসার আগেই বিএনপির প্রধান দাবিটি মানা হবে- এমন নিশ্চয়তা দিতে হবে।
এর আগে ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে সরকারের সঙ্গে সংলাপে যাওয়ার যে অভিজ্ঞতা তা নিয়েও দলের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া আছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন দল দুটির এমন অনড় অবস্থানের কারণে সমঝোতার সম্ভাবনা আগে থেকেই ছিলো না।
“তারা কেউই তাদের জায়গা থেকে কখনো একটুও সরেননি। এ অবস্থায় সংলাপ হওয়ার কথাও না। আওয়ামী লীগ তো সব সময়ই বলে আসছে যে বিএনপির সঙ্গে সংলাপ করবে না,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
মি. আহমেদ বলছেন আওয়ামী লীগ নির্বাচন কমিশনের সাথে সংলাপ করার জন্য বিএনপিকে পরামর্শ দিয়েছিলো কিন্তু বিএনপি এই নির্বাচন কমিশনকেই মানছে ন।
এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি সফল হোক আর না হোক কিংবা তাদের কর্মসূচি মানুষ গ্রহণ করুক আর না করুক- বিদ্যমান বাস্তবতায় সমঝোতার কোন পরিস্থিতিই অবশিষ্ট নেই বলেই মনে করেন তিনি।
সংলাপ: আন্তর্জাতিক চাপ কাজে দেবে?
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের ত্রুটিপূর্ণ দুটি নির্বাচনের পর এবারের জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু করতে সরকারের উপর মার্কিন নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলোর চাপ আছে।
বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ এবং দেশি বিদেশি পর্যবেক্ষক এমনকি নির্বাচন কমিশনও মনে করে প্রধান দুই দলের মধ্যে নির্বাচন ইস্যুতে অর্থবহ সংলাপ প্রয়োজন। কিন্তু এ ব্যাপারে দুই দলই পরস্পরবিরোধী অনড় অবস্থান নিয়েছে।
যদিও এর মধ্যেই গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে সক্রিয় দেখা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিমা বিশ্বকে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক নির্বাচনী পর্যবেক্ষক মিশন সংলাপের ওপর গুরুত্ব দিলেও তারা কেউ সংলাপ বা সমঝোতার জন্য আলোচনা টেবিলে বসানোর চেষ্টা করবে কি-না সেটি এখনও পরিষ্কার নয়।
এর আগে ১৯৯০ পরবর্তী বাংলাদেশে নির্বাচনকালীন রাজনৈতিক সংকটে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে চারদফা আলোচনা বা সংলাপ হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৯৪ সালে কমনওয়েলথ এবং ২০১৩ সালে জাতিসংঘ মহাসচিবের প্রতিনিধি দুই দলের মধ্যে আলোচনার মধ্যস্থতা করেছিল।
কিন্তু এসব সংলাপে কার্যত সমাধান আসেনি। তবে বিদেশীদের চাপে কখনো কখনো সরকার বেকায়দায় পড়েছে এমন উদাহরণ আছে।
১৯৯০ সালে জেনারেল এরশাদের পতনের আগে মূলত আন্তর্জাতিক চাপেই সান্ধ্য আইন তুলে নিতে হয়েছিলো এরশাদকে। এরপর আর পরিস্থিতি নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেননি এরশাদ।
১৯৯৬ সালের খালেদা জিয়া সরকারের পদত্যাগের পর ওই বছরের বারই জুনের নির্বাচনের প্রেক্ষাপটেও বিদেশিদের নেপথ্য ভূমিকা ছিলো বলে মনে করা হয়।
এবারেও অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্র। নির্বাচনকে যারা বাধাগ্রস্ত করবে তাদের জন্য ভিসা নীতি প্রয়োগ করা শুরু হয়েছে বলেও তারা জানিয়েছে গত ২২শে সেপ্টেম্বর।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন জানিয়েছে তারা পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে না। শক্ত ভাষায় বাংলাদেশ ইস্যুতে প্রস্তাব নেয়া হয়েছে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে।
যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন প্রাক নির্বাচনী পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে ঢাকায় মিশন পাঠিয়েছে। তারা ফিরে গিয়ে সংলাপকেই গুরুত্ব দিয়েছে।
এসব কিছুকেই নির্বাচন ইস্যুতে গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত বলে মনে করেন বাংলাদেশের বেসরকারি নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা জানিপপ-এর চেয়ারম্যান প্রফেসর ডঃ নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ।
তার মতে রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই এবং নির্বাচন বাংলাদেশের হলেও এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এর গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার।
“আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদের মতো ঘোষণাগুলোর যে বাধ্যবাধকতা সেগুলোতে আমরা এড়াতে বা অস্বীকার করতে পারবো না। শুধু বাংলাদেশের মধ্যে এটা সীমাবদ্ধ নেই। এসব বাধ্যবাধকতা মানতে হবে। সে নিরিখে আলাপ আলোচনা বিকল্প নেই,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
মি. কলিমউল্লাহ পূর্ব তিমুর, হংকং, মিশর, নাইজেরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের আইআরআই ও এনডিআইয়ের সাথে প্রাক নির্বাচনী পর্যবেক্ষণ দলে কাজ করেছেন।
তার মতে দলগুলো না চাইলে সংলাপ বা সমঝোতার জন্য আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতা ও ইন্টারন্যাশনাল গ্যারান্টির দরকার হবে।
“আমি আশাবাদী। আর সেটিও না হলে বুঝতে হবে যে দলগুলো পয়েন্ট অব নো রিটার্ন চলে গেছে এবং এর ফল হবে মহাসংকটে নিপতিত হওয়া”, মন্তব্য করছেন তিনি।