ভারতে তৃণমূল কংগ্রেসের সংসদ সদস্য মহুয়া মৈত্রকে পার্লামেন্ট থেকে বহিষ্কারের সুপারিশ বৃহস্পতিবার সংসদের এথিক্স কমিটিতে গৃহীত হয়েছে। মিজ মৈত্রর বিরুদ্ধে অর্থের বিনিময়ে পার্লামেন্টে প্রশ্ন উত্থাপন করার অভিযোগ উঠেছিল।
এথিক্স কমিটির চেয়ারম্যান অবশ্য জানিয়েছেন, তাদের এই সুপারিশের ভিত্তিতে লোকসভার স্পিকারই এখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন মহুয়া মৈত্রর সদস্যপদ থাকবে কি থাকবে না।
একজন সংসদ সদস্যের পক্ষে মিজ মৈত্র অত্যন্ত গর্হিত একটি কাজ করেছেন, এই অভিযোগ পাওয়ার পরে এথিক্স কমিটি তদন্ত শুরু করে। সেখানেই বৃহস্পতিবার মিজ মৈত্রকে সংসদ থেকে বহিষ্কার করার সুপারিশ গৃহীত হয় সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে।
মিজ মৈত্র অবশ্য অর্থের বদলে প্রশ্ন তোলার অভিযোগ প্রথম থেকেই অস্বীকার করে আসছেন।
তবে মিজ মৈত্র এবং এথিক্স কমিটির একাধিক সদস্য বৃহস্পতিবার প্রশ্ন তুলেছেন, যে ভাবে ওই কমিটির সুপারিশটি সংবাদ মাধ্যমে আগেই প্রকাশ করে দেওয়া হয়েছে, সেটাও অনৈতিক কাজ। মিজ মৈত্র এ নিয়ে লোকসভার স্পিকারের কাছে বৃহস্পতিবার চিঠিও পাঠিয়েছেন।
অন্য দিকে অর্থের বদলে প্রশ্ন করার অভিযোগ ওঠার পরে বৃহস্পতিবারই প্রথমবার তৃণমূল কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব মহুয়া মৈত্রর পাশে দাঁড়ানো বার্তা দিয়েছে।
কী বলা হয়েছে বহিষ্কারের সুপারিশে?
ভারতের সংসদের নিম্ন কক্ষ লোকসভার এথিক্স কমিটিতে বৃহস্পতিবার বিকেলে ছয়-চার ভোটে ওই সুপারিশ গৃহীত হয়।
মহুয়া মৈত্র বলছেন তার জানাই ছিল যে কমিটি কী সুপারিশ করবে। বৃহস্পতিবার তিনি সারাদিনই তার লোকসভা কেন্দ্রে নানা কর্মসূচীতে ব্যস্ত ছিলেন।
এথিক্স কমিটি যখন তাকে প্রশ্ন করার জন্য ডেকে পাঠিয়েছিল গত সপ্তাহে, সেখান থেকে মাঝপথেই বেরিয়ে চলে আসেন মিজ মৈত্র।
তিনি তখন বলেছিলেন যে ‘ব্যক্তিগত এবং অনৈতিক’ প্রশ্ন করা হয়েছে ওই বৈঠকে। লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লাকে চিঠি লিখে তিনি অভিযোগ করেন, এথিক্স কমিটির বৈঠকে মৌখিক ভাবে তাঁর ‘বস্ত্রহরণ’ করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবারের বৈঠকের পরে এথিক্স কমিটির চেয়ারম্যান, বিজেপি সংসদ সদস্য ভিনোদ সোনকর সংবাদ সংস্থা এএনআইকে বলেছেন, “মহুয়া মৈত্রর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলি নিয়ে একটা খসড়া রিপোর্ট পেশ করা হয়েছিল আজকের বৈঠকে। সেই রিপোর্টের পক্ষে ছয়জন ছিলেন আর চারজন তাদের অসম্মতি নথিভুক্ত করেছেন।”
“বিস্তারিত সুপারিশ আগামীকাল লোকসভার স্পিকারের কাছে পাঠিয়ে দেব। স্পিকারই সিদ্ধান্ত নেবেন এর পরে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে,” জানিয়েছেন এথিক্স কমিটির চেয়ারম্যান মি. সোনকর।
ঘটনাচক্রে বিজেপি-বিরোধী ‘ইণ্ডিয়া’ জোটের বড় শরিক কংগ্রেসের একজন সংসদ সদস্য মিজ মৈত্রের বহিষ্কারের বিপক্ষে ভোট দিলেও অন্য এক কংগ্রেস সদস্য বহিষ্কারের পক্ষে ভোট দিয়েছেন।
মহুয়া মৈত্রকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে যারা ভোট দিয়েছেন, তারা বলছেন ওই কমিটি নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করে নি।
জনতা দল ইউনাইটেডের সংসদ সদস্য ও এথিক্স কমিটির অন্যতম সদস্য গিরিধারী যাদব বৃহস্পতিবার পার্লামেন্ট ভবনে বৈঠক থেকে বেরিয়ে সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন যে রিপোর্টটি নিয়ে কোনও আলোচনাই হয় নি।
“এটা চূড়ান্ত বেনিয়ম। একজনকে পাল্টা প্রশ্ন করা হয়েছে শুধু। তারপরে তো আলোচনা করা দরকার ছিল। তাদের (বিজেপির) সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে কমিটিতে, তাই তারা যা খুশি করতে পারে,” মন্তব্য মি. যাদবের।
মহুয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ কী?
মহুয়া মৈত্রর বিরুদ্ধে তার প্রাক্তন বন্ধু জয় অনন্ত দেহাদ্রাই এবং বিজেপি সংসদ সদস্য নিশিকান্ত দুবে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন যে দুবাই ভিত্তিক শিল্পপতি দর্শন হিরানন্দানির কাছ থেকে উপহার ও অর্থের বিনিময়ে তিনি পার্লামেন্টে নরেন্দ্র মোদীর ঘনিষ্ঠ শিল্পপতি গৌতম আদানির সংস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন।
মি. হিরানন্দানিকে পার্লামেন্টের ওয়েব সাইটে লগইন আইডি এবং পাসওয়ার্ডও দিয়ে রেখেছিলেন মিজ মৈত্র।
ওই আইডি এবং পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে মি. হিরানন্দানি মহুয়া মৈত্রর হয়ে প্রশ্ন পোস্ট করেছিলেন বলেও অভিযোগ।
এই দুটি কাজই একজন সংসদ সদস্যর পক্ষে চূড়ান্ত অনৈতিক বলে অভিযোগ উঠেছিল।
অর্থ ও উপহারের বদলে প্রশ্ন তোলার অভিযোগ প্রথম থেকেই অস্বীকার করে আসছিলেন মিজ মৈত্র, তবে দুবাই ভিত্তিক শিল্পপতিকে ওয়েবসাইটে লগইন আইডি ও পাসওয়ার্ড দেওয়ার কথা মেনে নিয়েছিলেন তিনি।
মিজ মৈত্র এর আগে বিবিসিকে বলেছিলেন, ভারতের সবথেকে বড় শিল্পপতিদের অন্যতম গৌতম আদানিকে নিয়ে লাগাতার প্রশ্ন তোলার কারণেই তাকে চুপ করিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা হচ্ছে।
সংবাদমাধ্যমে রিপোর্ট ফাঁস
লোকসভার এথিক্স কমিটি যে পশ্চিমবঙ্গে কৃষ্ণনগর থেকে নির্বাচিত তৃণমূল কংগ্রেস সংসদ সদস্য মহুয়া মৈত্রকে বহিষ্কার করার সুপারিশ করতে চলেছে, তা বুধবারই একটি জাতীয় টেলিভিশন চ্যানেল প্রকাশ করে দেয়।
যদিও এরকম একটা রিপোর্ট, যা সর্বপ্রথম এথিক্স কমিটির সদস্যদের হাতে পাওয়ার কথা এবং তা নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হওয়ার কথা, সেটা একটি সংবাদ মাধ্যমের কাছে কী করে ফাঁস হয়ে গেল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
মিজ মৈত্র বৃহস্পতিবার দুপুরে তার এক্স (আগেকার টুইটার) হ্যাণ্ডেলে একটি চিঠি পোস্ট করেন।
লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লার কাছে ওই চিঠিটি তিনি পাঠিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, যে আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মিজ মৈত্র বারবার সরব হয়েছেন, সেই গোষ্ঠীর মালিকানাধীন একটি টিভি চ্যানেলের কাছে এথিক্স কমিটির রিপোর্ট কী করে ফাঁস করা হল!
এথিক্স কমিটির এক বিরোধী দলীয় সদস্য দানিশ আলিও বলছেন, “এই দেশে দুরকম আইন তো থাকতে পারে না। এথিক্স কমিটির চেয়ারম্যান বারবার নিয়ম ভাঙ্গছেন, তিনি এ বিষয়ে টিভি চ্যানেলে সাক্ষাতকার দিচ্ছেন।“
প্রথমবার মহুয়ার পাশে দল
তৃণমূল কংগ্রেসের সংসদ সদস্য মহুয়া মৈত্রর বিরুদ্ধে অর্থের বদলে প্রশ্ন তোলার অভিযোগ ওঠার পর থেকে এতদিন তার দল আনুষ্ঠানিকভাবে তার সমর্থনে এগিয়ে আসে নি।
তবে দলের সংসদ সদস্য ও সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক ব্যানার্জী বৃহস্পতিবারই প্রথমবার মিজ মৈত্রর সমর্থনে মুখ খুলেছেন।
তিনি কলকাতায় বৃহস্পতিবার বলেন, “যদি কেউ সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে চায়, সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে, আদানিদের নিয়ে প্রশ্ন তোলে, তাঁদের কী ভাবে সাংসদ পদ থেকে সরানোর চেষ্টা করা হয়।”
তৃণমূল কংগ্রেসের সেকেন্ড-ইন-কমাণ্ড এই প্রশ্নও তোলেন যে এর আগে বিজেপির সংসদ সদস্যরা পার্লামেন্টের ভেতরে নোংরা কথা বলেছিলেন, কিন্তু সেই ঘটনায় কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয় নি।
“মহুয়া নিজের লড়াই নিজেই লড়তে পারেন” বলেও মন্তব্য করেছেন মি. ব্যানার্জী।
কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস প্রথম থেকে কেন মহুয়া মৈত্রর পাশে দাঁড়াল না, তা নিয়ে একাধিক ব্যাখ্যা দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক শুভাশিস মৈত্র বলছেন, “এর দুটো কারণ থাকতে পারে। প্রথমত আদানি গোষ্ঠী পশ্চিমবঙ্গে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করছে। তারা গভীর সমুদ্র বন্দর বানাতে চলেছে।”
“সরকার চায় আদানিরা এই রাজ্যে বিনিয়োগ করুক। অন্যদিকে মহুয়া লাগাতার আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মুখ খুলে চলেছেন। সেই জন্যই সম্ভবত দল বিষয়টা থেকে দূরে থাকতে চাইছে।
“দ্বিতীয়ত তিনি যে জেলা থেকে সংসদ সদস্য, সেই নদীয়াতে স্থানীয় তৃণমূল কংগ্রেস সংগঠনের সঙ্গে তার বিরোধ রয়েছে। স্থানীয় নেতৃত্বের একাংশের সঙ্গে তার সম্পর্কও ভাল না,” বলছিলেন মি. মৈত্র।