মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক এক শিখ নেতাকে হত্যার ষড়যন্ত্রের যে পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছে সে দেশের অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তর, সেখানে বারে বারেই উঠে এসেছে এক ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তার কথা।
ওই হত্যার চক্রান্তের অভিযোগ পত্রে ওই অফিসারের নাম অ্যাটর্নি জেনারেলর দপ্তর প্রকাশ করে নি, কিন্তু তিনি গোটা তদন্ত প্রক্রিয়া চলাকালীন যে ভারত সরকারের বেতন পেয়েছেন, সেটা উল্লেখ করা হয়েছে।
অভিযোগপত্রের কোথাও শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা গুরপতওয়ান্ত সিং পান্নুই যে ওই ষড়যন্ত্রের লক্ষ্য ছিলেন, সেটা উল্লেখ করা নেই। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ আগে যুক্তরাজ্যের সংবাদপত্র ফিনান্সিয়াল টাইমস এক খবরে জানিয়েছিল যে মি. পান্নুকে হত্যার একটি ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করেছে মার্কিন প্রশাসন।
মি. পান্নু ২০২০ সাল থেকে ভারতে ঘোষিত সন্ত্রাসী।
অন্যদিকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রক বলছে যে এটা যথেষ্ট উদ্বেগের, কিন্তু এরকম ঘটনায় কোনও অফিসারের জড়িত থাকা সরকারী নীতির পরিপন্থী।
মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তর তাদের পুরো অভিযোগপত্রে বেশ কিছু সাঙ্কেতিক নাম ব্যবহার করেছে মূল ব্যক্তির পরিচয় আড়াল করতে। একমাত্র ব্যতিক্রম গ্রেপ্তার হওয়া ভারতীয় নাগরিক নিখিল গুপ্তা। তার নাম প্রথম থেকেই উল্লেখ করা হয়েছে।
আর তাকে নির্দেশ দিতেন যে “ভারত সরকারের কর্মচারী”, তার সাঙ্কেতিক নাম দেওয়া হয়েছে ‘সিসি-১’।
কে এই ‘সিসি-১’?
মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তর নিউ ইয়র্কের সাদার্ন ডিস্ট্রিক্ট আদালতে যে ১৫ পাতার অভিযোগপত্র দায়ের করেছে, সেখানে ওই ভারতীয় অফিসার ‘সিসি-১’-এর পরিচয় দিয়েছে এভাবে :
“তিনি ভারতীয় সরকার নিযুক্ত একজন ‘সিনিয়ার ফিল্ড’ অফিসার, যার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে ‘নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা’ আর ‘গুপ্তচরবৃত্তি’। ‘সিসি-১’ উল্লেখ করেছিলেন যে আগে তিনি ভারতের কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ বাহিনীতে (সিআরপিএফ) কর্মরত ছিলেন এবং ‘যুদ্ধবিদ্যা’ ও ‘অস্ত্রশস্ত্র’-এর ‘অফিসার প্রশিক্ষণ’ নিয়েছেন।
“এই অভিযোগপত্রে পুরো সময়কালে ‘সিসি-১’ ভারত সরকারের কর্মচারী ছিলেন, তিনি ভারতেই বসবাস করছিলেন, এবং ভারত থেকেই হত্যার ষড়যন্ত্রে নির্দেশ দিয়েছেন,” লেখা হয়েছে ওই অভিযোগপত্রে।
তবে ভারত সরকার বলছে তাদের কোনও কর্মচারীর বিরুদ্ধে এরকম ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ খুবই উদ্বেগের, কিন্তু এটা সরকারের নীতি নয়।
বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী বলেন আমেরিকা ওই ষড়যন্ত্রের যে অভিযোগ করেছে, তা খতিয়ে দেখতে ইতিমধ্যেই একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে।
“একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে মার্কিন আদালতে দায়ের করা মামলায় যেখানে ভারতীয় কর্মকর্তার সঙ্গে যোগের অভিযোগও করা হয়েছে সেটা উদ্বেগের বিষয়। আমরা আগেও বলেছি আবারো বলছি, এটা সরকারি নীতির পরিপন্থী,” বলেন মি. বাগচী।
ষড়যন্ত্রের শুরু যেভাবে
অ্যাটর্নি জেনারেলর দপ্তরের পেশ করা অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে যে ষড়যন্ত্রের শুরু হয় এবছর মে মাসের গোড়ার দিকে, আর ৩০শে জুন নিখিল গুপ্তা নামে এক অভিযুক্ত চক্রান্তকারী, যিনি আবার আন্তর্জাতিক মাদক ও অস্ত্র পাচারের সঙ্গেও যুক্ত বলে অভিযোগ, তাকে যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধের চেক প্রজাতন্ত্রের পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এই দু মাস ধরে হত্যার চক্রান্ত চলছিল।
চক্রান্তকারীদের মধ্যে কী কী কথা হয়েছে, প্রতিটির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দেওয়া হয়েছে অভিযোগপত্রে।
ছয়ই মে, ২০২৩: একটি এনক্রিপ্টেড মেসেজিং অ্যাপ্লিকেশনে ‘সিসি-১’ (ভারতীয় যে অফিসারের কথা অভিযোগপত্রে লেখা হয়েছে) নিখিল গুপ্তাকে লেখেন :”আমি (‘সিসি-১’ নিজের নাম লেখেন)… আমার নামটা এই নামে (ওই অফিসারের ছদ্মনাম) সেভ করে রাখুন। মি. গুপ্তার সেই নামেই নম্বরটি সেভ করেন।
কয়েক মিনিট পরেই ওই ভারতীয় অফিসার মি. গুপ্তাকে মেসেজ করে জানান যে একটি নিউ ইয়র্কে এবং আরেকটি ক্যালিফোর্নিয়ায় দুটি ‘টার্গেট’ আছে তার।
মি. গুপ্তা উত্তর দেন : “আমরা সব টার্গেটকে আঘাত করব।“
অভিযোগপত্রে লেখা হয়েছে যে ‘সিসি-১’ যে টেলিফোন নম্বরটি ব্যবহার করছিলেন, সেটা ভারতের ‘কান্ট্রি কোড’-এর এবং এমন একটি ইমেল অ্যাকাউন্টের সঙ্গে যুক্ত, যেটি এই ষড়যন্ত্র চলাকালীন নতুন দিল্লির আশেপাশের এলাকা থেকে ইন্টারনেট ব্যবহার করে এক্সেস করা হচ্ছিল।“
১২ই মে, ২০২৩: ‘সিসি-১’ নিখিল গুপ্তাকে জানায় যে তার ফৌজদারি মামলাটির ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে গেছে এবং “গুজরাট পুলিশ থেকে কেউ ফোন করবে না।“
২৩শে মে, ২০২৩: ‘সিসি-১’ মি. গুপ্তাকে তার ‘গুজরাট’-এর বিষয়টি নিয়ে আবারও আশ্বস্ত করেন। তিনি জানান, গুজরাট মামলা নিয়ে “বসের সঙ্গে কথা বলেছেন” এবং বিষয়টি এখন “অল ক্লিয়ার”। “কেউ আপনাকে আর কখনও বিরক্ত করবে না” এমনও জানান ‘সিসি-১’ নামে অভিযোগপত্রে উল্লেখিত ব্যক্তি।
পুলিশের একজন ডেপুটি কমিশনারের সঙ্গে নিখিল গুপ্তার একটি বৈঠকেরও ব্যবস্থা করার প্রস্তাব দেন ওই ‘সিসি-১’ ব্যক্তি।
২৯শে মে, ২০২৩: এই দিন চক্রান্তে এক নতুন ব্যক্তির আগমন ঘটে। গোটা ঘটনাক্রম পড়ে মনে হয় যে এই নতুন ব্যক্তিটি, যার সাঙ্কেতিক নাম দেওয়া হয়েছে ‘সিএস’, তার জন্য পুরো চক্রান্তটির খোঁজ পান মার্কিন এজেন্সিগুলি। ‘সিএস’ ব্যক্তি মার্কিন গোয়েন্দা দপ্তরের এক নির্ভরযোগ্য সূত্র।
মি. গুপ্তা টেলিফোনে এদিন ‘সিএস’কে জিজ্ঞাসা করেন, যে তিনি এমন কোনও ‘ভাড়াটে খুনি’র খোঁজ দিতে পারেন কী না। ‘সিএস’ জবাবে বলেন যে তিনি তার পরিচিতদের মধ্যে খোঁজ করে দেখবেন। সম্ভবত এই ‘সিএস’ ব্যক্তিটিই মার্কিন গোয়েন্দাদের খবর দেন চক্রান্তের ব্যাপারে।
২৯শে মে, ২০২৩: নিখিল গুপ্তা মার্কিন গোয়েন্দা দপ্তরের নির্ভরযোগ্য সূত্র ওই ‘সিএস’কে জানান যে কাকে খুন করতে হবে, তার সম্বন্ধে অন্যান্য তথ্যও পাঠান। উত্তরে, ‘সিএস’ মি. গুপ্তার কাছে লক্ষ্যবস্তু সম্পর্কে অতিরিক্ত তথ্য এবং হত্যার জন্য কীভাবে অর্থ দেওয়া হবে, সে ব্যাপারে বিশদে জানতে চান।
২৯শে মে, ২০২৩: ‘সিএস’ এর সঙ্গে যে কথোপকথন হয়, সেটা মি. গুপ্তা ‘সিসি-১’ কে টেক্সট মেসেজের স্ক্রিনশট হিসাবে পাঠান। কীভাবে হত্যাকারীকে তার ‘ফি’ দেওয়া হবে, সে ব্যাপারেও ‘সিসি-১’এর কাছে জানতে চান নিখিল গুপ্তা।
‘সিসি-১’ জবাবে বলেন “আমরা দেড় লাখ মার্কিন ডলার দিতে রাজি।… কাজের মানের উপর নির্ভর করে অর্থ বাড়ানো যেতে পারে… এবং যদি কাজটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করা হয়”।
মি. গুপ্তা এরপরে ‘সিএস’এর পাঠানো একটি মেসেজের স্ক্রিনশট পাঠান, যেখানে লেখা ছিল ‘১১০ কে’, অর্থাৎ দশ লক্ষ। ‘সিসি-১’ উত্তর দিয়েছিলেন “ঠিক আছে” এবং তারপরে যোগ করেছিলেন যে অগ্রিম অর্থ প্রদান করা সম্ভব নয়, “কাজ শেষ হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পুরো টাকা দেওয়া হবে।
জুন মাসে ষড়যন্ত্র পাকাপোক্ত রূপ নিচ্ছে
তেসরা জুন, ২০২৩: মার্কিন আদালতে পেশ করা অভিযোগপত্রে লেখা হয়েছে, তেসরা জুন একটি অডিও কলের মাধ্যমে নিখিল গুপ্তা ‘সিএস’কে তার সহযোগীদের শীঘ্রই খুন করার কথা জানিয়ে বলেন: “তাকে খতম করুন ভাই, তাকে শেষ করুন, খুব বেশি সময় নেবেন না … এই লোকদের চাপ দিন, এই লোকদের চাপ দিন … কাজটি শেষ করুন।“
চৌঠা জুন, ২০২৩: সিএস মি. গুপ্তাকে ‘লক্ষ্যবস্তু’র একটি সার্ভেইল্যান্সের ছবি পাঠিয়ে প্রমাণ দেন যে তার নিউ ইয়র্কের সহযোগীরা লক্ষ্যবস্তুর ওপরে নজর রাখছে। ২৫ হাজার মার্কিন ডলার অগ্রিম পেলেই খুন করা হবে। “
ছয়ই জুন, ২০২৩: মি. গুপ্তা ‘সিএস’কে মেসেজ করে নিউইয়র্কে তার সহযোগীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করিয়ে দিতে বলেন। এদিনই, নিখিল গুপ্তার সঙ্গে ইলেক্ট্রনিক বার্তার মাধ্যমে পরিচয় হয় আরেক অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে।
এই ব্যক্তিকেই চক্রান্তকারীরা ‘ভাড়াটে খুনি’ হিসাবে ‘নিয়োগ’ করেছিলেন। কিন্তু আদতে তিনি ছিলেন ছদ্মবেশী মার্কিন গোয়েন্দা। অভিযোগপত্রে এই ছদ্মবেশী গোয়েন্দাকে বলা হয়েছে ‘ইউসি’, অর্থাৎ ছদ্মবেশী বা আণ্ডারকভার।
নয়ই জুন, ২০২৩ : এদিনই নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনে ‘ছদ্মবেশী গোয়েন্দা’ বা ‘ইউসি’র গাড়িতে বসে সম্পূর্ণ অন্য এক ব্যক্তি অগ্রিম হিসাবে নগদে ১৫ হাজার ডলার তুলে দেন। ভাড়াটে খুনি ছদ্মবেশে থাকা ‘ইউসি’ সেই ছবি তুলে রাখেন, যেটা অভিযোগপত্রের সঙ্গে দেওয়া হয়েছে আদালতে।
১৮ই জুন, ২০২৩: এর মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ থেকেছে পুরো চক্রান্তের অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে। তবে এদিন কানাডার ভ্যানকুভারের একটি গুরুদুয়ারার বাইরে ‘লক্ষ্যবস্তু’র সহযোগী এবং খালিস্তান আন্দোলনের আরেক নেতা হরদীপ সিং নিজ্জারকে গুলি করে হত্যা করে।
এদিন সন্ধ্যায় ‘সিসি-১’ নিখিল গুপ্তাকে একটি ভিডিও ক্লিপ পাঠান, যেখানে দেখা যায়, মি. নিজ্জারের রক্তাক্ত দেহ তার গাড়িতে পড়ে আছে। ওই ভিডিও ক্লিপটি পাওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই মি. গুপ্তা ‘সিএস’ এবং ‘ইউসি’র কাছে সেটি ফরোওয়ার্ড করে দেন।
১৯শে থেকে ২৯শে জুন, ২০২৩: যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়ের করা অভিযোগপত্রে এই দিন দশেকের ঘটনাক্রম নিয়ে খুবই বিস্তারিত ভাবে লেখা হয়েছে। এটাই ছিল হত্যার চূড়ান্ত প্রস্তুতির দিনগুলি। সেই সব তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে যে কানাডায় খুন হওয়া মি. নিজ্জারও এই চক্রান্তকারীদের তালিকায় ছিলেন।
ওই ঘটনার পরে মি. পান্নু, অর্থাৎ আমেরিকার ‘লক্ষ্যবস্তু’ সাবধান হয়ে যেতে পারেন এই আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল, তাই যত দ্রুত সম্ভব ‘কাজ’ শেষ করতে বারবার চাপ দেওয়া হচ্ছিল।
একই সঙ্গে লক্ষ্যবস্তুর ওপরে নজরদারির ছবি এবং তথ্যও পাঠানো হচ্ছিল ‘সিসি-১’, অর্থাৎ সেই ভারতীয় অফিসারকে যিনি ভারতে বসে গোটা অপারেশন পরিচালনা করছিলেন, এমনটাই লেখা হয়েছে অভিযোগপত্রে।
৩০শে জুন, ২০২৩: নিখিল গুপ্তা ভারত থেকে চেক প্রজাতন্ত্রে পৌঁছন, আর সেখানেই যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধে তাকে গ্রেপ্তার করে চেক পুলিশ।
এখানেই ষড়যন্ত্রের বিস্তারিত শেষ হয়েছে অভিযোগপত্রে। এরপরের শেষ অংশে কোন ধারায় নিখিল গুপ্তার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ তোলা হচ্ছে, সেসবের বিস্তারিত লেখা হয়েছে।