- Author, আরওয়া হায়দার
- Role, বিবিসি কালচার
-
বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় একটি ব্যান্ডদল নব্বই দশকের মাঝামাঝিতে নিরাপদ সেক্স, এইচআইভি ও এইডস নিয়ে আলোচনার হাওয়া বেশ জোরেশোরেই বদলে দিচ্ছিল।
আটলান্টার পুরষ্কার জয়ী ব্যান্ড টিএলসির তিন সদস্য ছিলেন; টিয়োনে “টি-বজ” ওয়াটকিন্স, লিসা “লেফট আই” লোপেজ ও রোজোন্ডা “চিলি” থমাস। ১৯৯৫ সালে এই ব্যান্ড তাদের ২য় অ্যালবাম ‘ক্রেজিসেক্সকুল’ – এর সিগনেচার গান ‘ওয়াটারফলস’ প্রকাশ করে।
ওয়ালটারফলস হল হালকা মিউজিকে আরঅ্যান্ডবি ও হিপহপের মিশেলে একটা গান, যেটা যৌথভাবে লিখেছিলেন গীতিকার মার্কুইজ এথরিজ ও প্রযোজক সংস্থা অর্গানাইজড নয়েজ, সাথে ছিলেন লোপেজ।
এই গানটি খুব দারুণভাবে টিএলসির তিন সদস্যের কন্ঠের প্রতিভাকে কাজে লাগায়: ওয়াটকিন্সের একটু কর্কশ বর্ণনা, থমাসের মিষ্টি সুর; সঙ্গে লোপেজের চমৎকার ও অভিনব ছন্দ।
এটার মূল ভাবনা ছিল সচেতনতা-নিজেকে ধ্বংসের যে ইচ্ছা সেটার বিরুদ্ধে একটা সতর্কতা, আবার একই সাথে এর সুরটা ছিল সহানুভূতিশীল এবং কাউকে কোন কিছু দিয়ে বিচার করা নয়।
গানটির প্রথম অংশে একজন ‘নি:সঙ্গ মা’ তার প্রিয় ছেলেকে মাদকের জগতে হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়ে।
পরের অংশে আমরা একজন পুরুষের কথা শুনি যে “প্রাকৃতিক চাহিদা থেকে প্রলোভনে পরে” অরক্ষিত যৌন মিলন করে এবং কান্নাকাটিতে শেষ হয়। “তিনটি বর্ণের শব্দ তাকে তার শেষ গন্তব্যে পৌঁছে দেয়।”
“অরক্ষিত যৌন মিলন, বাছবিচারহীন এবং ভুল মানুষের সাথে চলাফেরার বিষয়ে আমাদের গানে একটা শক্ত বার্তা দিতে চেয়েছিলাম আমরা,” ২০১৮ সালে গার্ডিয়ানকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ব্যাখ্যা করেন থমাস।
“ওয়াটারফলসের বার্তাটা সবার ঘরে পৌঁছে গিয়েছিল। আমি মনে করি সেকারণেই এটি এখন পর্যন্ত আমাদের সবচেয়ে হিট গান।”
ওয়াটারফলসের এই চমকপ্রদ ও হৃদয়গ্রাহী অভিব্যক্তি টিএলসির জন্য ছিল খুবই স্বাভাবিক। এই তিনজন সবসময়ই নিরাপদ যৌন মিলন, যৌন মিলনের সুখ এসব নিয়ে ছিল সোচ্চার, যা তাদের মূলধারার স্রোতের বাইরেও উজ্জ্বল করে রেখেছিল।
টিনএজ বয়সে যখন তাদের ১৯৯২ সালের সফল একক, আই অ্যাম নট টু প্রাউড টু বেগ, আবিষ্কার করি তখন আমি নিজেও খুব উত্তেজিত বোধ করি এবং একটু অবাকও হই। কারণ এই গানে তারা অলংকার হিসেবে বিভিন্ন রংয়ের কনডম ব্যবহার করে, যেখানে লোপসকে একটা কনডম তার চশমার লেন্সের জায়গায় পড়তে দেখা যায়।
“আমি নিজেকে একজন দূরদর্শী এবং ভিন্ন চিন্তার মানুষ মনে করি,” ১৯৯৮ সালে ম্যাড রাইমস ম্যাগাজিনকে বলেন লোপেজ। “উজ্জ্বল রং, কনডম, এসব সামান্য জিনিসই কিছু কিছু না কিছু যোগ করেছিল।”
নিষ্ঠুর ও বাস্তব সত্য
টিএলসি তাদের গানে সবসময় নিষ্ঠুর ও বাস্তব সব সত্যকে তুলে এনেছে, যার মধ্যে একটা ছিল যে এইচআইভি সবচেয়ে বেশি কৃষ্ণাজ্ঞ ও লাতিন আমেরিকার মানুষদের আক্রান্ত করেছিল।
যে বছর ওয়াটারফলস প্রকাশ হয়, সে বছর যুক্তরাষ্ট্রে এইডসে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ মারা যায়। ইউএস ডিপার্টমেন্ট অফ হেলথ অ্যান্ড পাবলিক সার্ভিসের প্রকাশিত এইচআইভি/এইডস সার্ভিলেন্স রিপোর্টে বলা হয়, “১৯৯৫ সালে কৃষ্ণাজ্ঞ ও হিস্পানিক পুরুষ (৫৪ শতাংশ) ও নারীদের (৭৬ শতাংশ) মধ্যে সবচেয়ে বেশি এইডস শনাক্ত হয়।”
টিএলসি এখন আলোচনায় কারণ তাদের নিয়ে একটা তথ্যচিত্র সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের ডক ‘এন’ রোল চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছে।
“টিএলসি এমন একটা প্রকল্প যেটা দিয়ে আমি আমার শৈশবের সমস্ত স্বপ্ন পূরণ করেছি,” হাসিমুখে বলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা ও গানের ভক্ত ম্যাট কে।
“এত মানুষের সাথে কথা বলেছি, সবার মধ্যেই টিএলসির মৌলিকতা, তাদের আদর্শ ও শিল্প যেটা তারা তৈরি করে গেছে, সেসব নিয়ে দারুণ শ্রদ্ধা দেখতে পেয়েছি। আর আমার মনে হয় এটা করে আমিও কিছু প্রশংসা পেয়েছি।”
টিএলসি ফরএভার নামের এই তথ্যচিত্রে ব্যান্ডের সদস্যদের চমৎকার বন্ধন; বিভিন্ন আর্কাইভ ফুটেজ ও ইন্টারভিউ থেকে ওয়াটকিন্স, থমাস এমনকি লোপেজেরও (যিনি ২০০২ সালে এক গাড়ি দুর্ঘটনায় আকস্মিক মারা যান) নতুন চিন্তাভাবনার কথা বেশ প্রাণবন্তভাবেই উঠে এসেছে।
একইসাথে তরুণী হিসেবে তারা নিজেদের ব্যক্তিগত জীবন ও মিউজিক ইন্ড্রাস্ট্রিতে যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন সেটাও উঠে এসেছে এই ডকুমেন্টারিতে।
প্রেমিকের সাথে ঝগড়া ও তা থেকে বাড়িতে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ১৯৯৪ সালে লোপেজকে আটক হতে হয়, বিচারক তাকে মাদকাসক্তের চিকিৎসা নিতে নির্দেশ দেন এবং পারিবারিক সহিংসতার শিকার হিসেবে তার কাউন্সেলিংয়ের আদেশ দেন।
প্রচন্ড খ্যাতি ও সফলতা সত্ত্বেও, চুক্তির দুর্বলতা ১৯৯৫ সালে টিএলসিকে দেউলিয়া করে দেয়, অথচ ওয়াটারফলস তখন আন্তর্জাতিকভাবে সাফল্যের চূড়ায়।
পরের কয়েক দশকে এইচআইভির চিকিৎসার ব্যাপক উন্নতি হলেও, ওয়াটারফলস কখনোই তার আবেদন ও আবেগের শক্তি হারায়নি। এই গানটি আশির দশকে এইচআইভি ও এইডসের বিষয়ে নানান রকম গুজব ও হোমোফোবিয়া থেকে মানুষের নজর এই বিষয়ে সচেতনতা ও নিরাপদ যৌন মিলনের দিকে ঘুরিয়ে দেয়।
স্পষ্টভাষী পপ কালচার থেকে টিএলসির মতো উঠে আসা শিল্পীরা (আরও আছেন ম্যাডোনা, প্রিন্স ও ফ্র্যাঙ্কি গোজ টু হলিউড) – এবং রেড হট ও দ্যা টেরান্স হিগিন্স ট্রাস্টের মতো কিছু সংস্থা যারা এগুলো নিয়ে কাজ করেছে; সে সময়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নে তাদের অবদান ছিল বিশাল।
নিজেদের অবস্থানকে ব্যবহার
“একটা শিল্পীর তার অবস্থান থেকে যে প্রভাবটা তৈরি হয়, অনেকে সেখান থেকে নিজেদের দায়িত্ব এড়াতে পারে, কিন্তু টিএলসি এটাকে পুরো হৃদয় দিয়ে ব্যবহার করেছে এবং তা ছড়িয়ে দিয়েছে দারুণভাবে,” নির্মাতা মি. কে বলেন।
“এটাই তাদের মৌলিকত্ব এবং সহজাত, এমন একটা জায়গা থেকে উঠে আসা যেখানে ভালোবাসার গুরুত্ব অনেক এবং এটা জানার পরও যে বিভিন্ন জায়গা থেকে তাদের বিরুপ প্রতিক্রিয়া পেতে হতে পারে, তারপরও তারা যে চিন্তাটা করেছে সেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।”
“তাদের এই ভয়ডরহীনতা কিন্তু কোন পাগলামো ছিল না, এটা ছিল এমন একটা কিছু যেটার জন্য তারা শক্তভাবে দাঁড়িয়ে ছিল এবং সারাজীবন রুখে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। তারা সেভাবেই পোশাক পরছিল যেভাবে তারা পড়তে চেয়েছিল এবং সেসবই বলছিল যেটা তারা বলতে চায়।”
ওয়াটারফলসের প্রভাবটা আরও বেড়ে গিয়েছিল বিগ বাজেটের নানা পুরষ্কার জেতা অভূতপূর্ব ভিডিওর কারণে, যেটা পরিচালনা করেছিলেন এফ গ্যারি গ্রে। হাইপার রিয়েল ইফেক্টের সাহায্যে গানের শক্তিশালী সব দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়, আর সেই সাথে ছিল তিনজনের অবিস্মরণীয় নাচ, পানির মধ্যে জলতরঙ্গের মতো কাঁধ দোলানো ভঙ্গিমা এসব।
কে বলেন, “ওয়াটারফলস হল একেবারে প্রথম দিকের একটা গান যেটা আইকনিক হয়ে আছে বিষয়ের সঙ্গে চমৎকারভাবে দৃশ্য ফুটিয়ে তোলার জন্য, ফলে এটার বার্তা আরও পরিষ্কার হয়েছে।”
“টিএলসির মতো দল তাদের অবস্থান দিয়ে যেভাবে মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছিল, সেটা সরকার বা রাজনীতিবিদরাও করেনি,” বলেন টেরান্স হিগিন্স ট্রাস্টের প্রোডাকশন ম্যানেজার অ্যান্ডি ডায়ার।
“অল্প বয়সী মেয়েদের স্বনির্ভর করা, এমনকি তাদের কনডম বহন করার মতো বিষয়ে সচেতন করা, সবমিলে নিজেদের খেয়াল রাখার যে ব্যাপারটা খুবই দারুণ। আমার মনে আছে টিএলসির ওয়াটারফল ভিডিও ঘুরেফিরেই এমটিভিতে দেখানো হত। এই ভিডিওর প্রযুক্তি এত আধুনিক ছিল এবং যেভাবে গল্পটা দেখানো হয়েছে এককথায় – ওয়াও। এটা একেবারে সেইসব প্রথম ভিডিওও একটি যেখানে সামাজিক সচেতনতার বিষয়টি উঠে আসে, খুবই আধুনিক। এখন হয়তো এটা খুবই সাধারণ, কিন্তু সে সময় ছিল ভীষন সৎ একটা কাজ।”
বেটে মিডলার, ডেথ ক্যাব ফর কিউটি থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের রিয়েলিটি টিভি শো দ্য ভয়েসে অনেকেই ওয়াটারফলসের কভার ভার্শন করেছে, কিন্তু আসল গানটা একেবারেই অবিকৃত এবং ব্যক্তিগত থেকে গিয়েছে।
“টিএলসি কখনোই পুরনো মনে হয় না। তাদের সুর, স্টাইল ও গানের মধ্য দিয়ে বার্তা দেয়া সবসময়ই যেন সতেজ। টিএলসি আমাদের সবরকম বাঁধা ঠেলে দিতে আশা যোগায় এবং সবসময় দায়িত্বশীল রাখে,” বলেন কে।
যুক্তরাষ্ট্রে রোগীদের এইচআইভির তথ্য ও নিজে নিজে যত্ন নেয়ার যে প্রকল্প আছে সেটার মুখপাত্র হিসেবে ওয়াটকিন্স এবং থমাস দুজনই এইচআইভি ও এইডসের বিষয়ে সচেতনতা ছড়াতে কাজ করে যাচ্ছেন। ২০১৮ সালে গার্ডিয়ানকে ওয়াটকিন্স বলেন, “যদি আমি কিছু বিশ্বাস করি এবং সেটা নিয়ে কথা বলতে চাই, তাহলে আমি সেটাই এখন করছি। আমি খুবই খুশি যে আমরা যেটা করতে চেয়েছিলাম, একটা পার্থক্য তেরি করতে-সেটা শেষ পর্যন্ত পেরেছি।”
লোপেজের মারা যাবার পরপরই প্রতিষ্ঠিত লিসা লোপেজ ফাউন্ডেশন এখনও পিছিয়ে পড়া তরুণদের সহায়তা দিতে কাজ করে যাচ্ছে।
তার লেখা ওয়াটারফলসের কথাগুলো অবিশ্বাস্যভাবে কাব্যিক এবং কখনো ভুলে যাবার নয়: “স্বপ্ন হল নিরাশ আকাঙ্খা, কোন কিছু সত্যি হওয়ার আশা/নিজের উপর বিশ্বাস রাখো, বাকি সব তোমার আর আমার উপর।।”
টিএলসি নিয়ে এই ভাবনাটা আমাদের সাথে থেকে যায়, যেখানে আমরা লোপেজকে তার থেরাপি থেকে ওয়াটারফলস রেকর্ড করতে স্টুডিওতে যাওয়া পর্যন্ত যে ঘটনাপ্রবাহ তার সাথে মিলিয়ে বলতে শুনি: “আমার এই ভ্রমণে আমি রাস্তা, ভবন, গাছ ও আকাশ দেখে মুগ্ধ হই, আমি উপরে তাকাই এবং সেখানে রঙধনু দেখতে পাই। আমি অনেকটা ঝড়ের মতো আমার জীবনকে সামনে প্রতিফলিত হতে দেখতে শুরু করি…আমার হৃদয় থেকে আমি গানটি লিখি।”