সম্প্রতি বাংলাদেশে জামালপুরের মেলান্দহে মসজিদের মাইকে স্ত্রীকে তালাক দেয়ার ঘোষণা দিয়ে এক ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আলোচনায় উঠে এসেছেন।
গত পাঁচই ডিসেম্বর মেলান্দহ উপজেলার চরবানিপাকুরিয়া ইউনিয়নে এ ঘটনা ঘটে। স্থানীয় একজন সাংবাদিক জানান, সেদিন আসরের নামাজের পর মসজিদে প্রবেশ করে স্ত্রীকে তালাক দেয়ার সিদ্ধান্তটি মাইকে ঘোষণা করেন ওই ব্যক্তি।
এ ঘটনার পর নানা সমালোচনার মুখে পড়লে নিজের ফেসবুকে অ্যাকাউন্টে লাইভে এসে নিজের এমন কর্মকাণ্ডের ব্যাখ্যা দেন তিনি।
ওই ব্যক্তি বলেন, এর আগেও বেশ কয়েক বার স্ত্রীকে মৌখিকভাবে তালাক দিয়েছেন। তবে বারবারই তার স্ত্রী ফিরে আসার কারণে এবার এলাকার সবাইকে জানিয়ে তালাক দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আর তাই মসজিদের মাইকে তালাকের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
তবে মৌখিক তালাক বা তিন তালাক দিলে কি আসলেই বিবাহ বিচ্ছেদ সম্পন্ন হয়?
তিন তালাকে কি বিচ্ছেদ হয়?
মৌখিক তালাক বা তিন তালাক নিয়ে ২০১৭ সালে ভারতের এক আদালত এক রায় দিয়েছিলো যেখানে, তিন তালাককে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করা হয়েছিল।
বাংলাদেশেও আইন অনুযায়ী, তিন তালাক উচ্চারণের মাধ্যমে বিয়ে বিচ্ছেদ বৈধ নয়।
আইন বিশেষজ্ঞ মিতি সানজানা বলেন, বিয়ের নিবন্ধন হয়ে থাকলে সেটির মৌখিকভাবে তালাক আইনগতভাবে গ্রহণযোগ্য নয় ।
তিনি বলেন, আইন না মেনে তালাক দিলে সেটি তালাক হয় না। কিন্তু কেউ যদি আইন মেনে তালাক দিতে চায়, তাহলে তা ঠেকানোর কোন উপায় নেই। সেক্ষেত্রে এক পক্ষ যদি তালাক দিতে নাও চায়, তারপরও তালাক কার্যকর হবে।
“কোনও পক্ষ যদি আইনের মাধ্যমে একটি সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে চায় তাহলে কোনও কারণ দেখানোরও প্রয়োজন নেই। পারস্পরিক বনিবনা হচ্ছে না, এই কারণ দেখিয়েও কেউ তালাক দিতে পারবে।”
বাংলাদেশে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনে তালাকের বিষয়টি নিয়ে পরিষ্কার ধারণা দেয়া হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী, স্বামী বা স্ত্রী যে কেউ-ই চাইলে পরস্পরকে তালাক দিতে পারে। তবে তার জন্য কিছু নিয়ম রয়েছে।
এই আইন অনুযায়ী, কোনও ব্যক্তি যদি তার স্ত্রীকে তালাক দিতে চান তাহলে তাকে তালাক উচ্চারণ করার পর তার সিদ্ধান্তের কথা স্থানীয় চেয়ারম্যানকে জানিয়ে নোটিশ দিতে হবে।
আইন বিশেষজ্ঞ মিতি সানজানা বলেন, কেউ তালাক দিতে চাইলে সে যে কোনও পদ্ধতিতে তালাক ঘোষণা করতে পারবেন। তারপর অন্য পক্ষ বা যাকে তালাক দেয়া হচ্ছে, সে যে এলাকায় বাস করেন, সেই এলাকার স্থানীয় চেয়ারম্যানকে নোটিশের মাধ্যমে জানাতে হবে।
“ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অথবা পৌরসভা মেয়র বা সিটি কর্পোরেশনের মেয়রকে লিখিতভাবে তালাকের নোটিশ দিতে হবে।”
এই নোটিশের একটি নকল কপি যাকে তালাক দেয়া হচ্ছে তার কাছেও পাঠাতে হবে।
এই নোটিশ কত দিনের মধ্যে পাঠাতে হয় এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী বলা আছে যে, তালাক ঘোষণার পর যত শীঘ্র সম্ভব এই নোটিশ পাঠাতে হবে। এটি ডাকযোগেও পাঠানো যায় বা সরাসরিও হস্তান্তর করা যায়।
মিজ সানজানা জানান, চেয়ারম্যান অথবা মেয়রের কাছে যেদিন নোটিশ পাঠানো হবে তার থেকে পরবর্তী ৯০ দিনের পর তালাক কার্যকর হয়ে যায় বা বিয়ে বিচ্ছেদ হয়।
তবে এই ৯০ দিনের মধ্যে একটি সালিশি পরিষদ গঠন করা হয়ে থাকে এবং দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা করা হয়। এই সালিশি পরিষদে একজন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং দুই পক্ষের এক জন করে প্রতিনিধি থাকেন।
“৯০ দিন সময়কে ইদ্দতকালীন সময় বলা হয়। এই সময়ের মধ্যে যদি দুই পক্ষই রাজি থাকে তাহলে তারা সমঝোতার মাধ্যমে তালাক তুলে নেয়া সম্ভব।”
তবে ৯০ দিনের মধ্যে যদি সালিশির কোন উদ্যোগ নেয়া না হয়, তাহলে সেই তালাক কার্যকর হয়ে যায়। আর তালাকের সময় যদি স্ত্রী গর্ভবতী থাকেন তাহলে প্রসব ও ইদ্দতকালীন সময় – যেটি পরে হবে সেই সময়ের পর তালাক কার্যকর হবে।
তালাক কার্যকর হওয়ার পর যে পক্ষই তালাক দিক না কেন, যে কাজী অফিসের মাধ্যমে তালাকের নোটিশ সম্পন্ন করা হয়েছে, সেখানেই তালাকটিও নিবন্ধন করাতে হবে।
তালাকপ্রাপ্তের আইনি সহায়তা
বাংলাদেশে তিন তালাকের মাধ্যমে বিয়ে বিচ্ছেদ হয়েছে এমন ভুক্তভোগীদের আইনি সহায়তা দেয়ারও কথা বলা হয়ে থাকে।
তবে আইন বিশেষজ্ঞ মিতি সানজানা বলেন, এক্ষেত্রে প্রথমেই দেখা হয় যে বিয়েটা নিবন্ধিত করা হয়েছে কি না এবং বিয়ে সংক্রান্ত দলিল আদালতে হাজির করা সম্ভব হবে কি না।
১৯৭৪ সালের মুসলিম বিবাহ ও তালাক নিবন্ধন আইনের মাধ্যমে বাংলাদেশের সব মুসলিম নাগরিকের বিয়ে নিবন্ধন করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী, কোনও প্রথা বা আচার-অনুষ্ঠানে যাই থাকুক না কেন, বিয়ে নিবন্ধন করতে হবে। একই ভাবে তালাকও কার্যকর হওয়ার পর পর তা নিবন্ধন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
মিতি সানজানা বলেন, যেসব বিয়ের নিবন্ধন করা হয় না, সেক্ষেত্রে নানা ধরণের জটিলতা দেখা দেয়।
এমন অবস্থায় বিয়ে নিবন্ধন করা না থাকলে মৌখিক তালাক দেয়া হলে, আইনি সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়। কারণ যে বিয়েই প্রমাণ করা যায় না, তার তালাকের বিষয়টি নিয়েও জটিলতা হয়।
“সেক্ষেত্রে হয়তো একটা মৌখিক তালাকের মাধ্যমে সম্পর্কটা থেকে সহজেই বের হয়ে যেতে পারে যদি না অপর পক্ষ আদালতে গিয়ে তার যে বিয়ে হয়েছে তা প্রমাণ করতে না পারে।”
আইন মেনে যদি কেউ তালাক না দেয় তাহলে সেক্ষেত্রে তাকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করার একটি সুযোগ রয়েছে বলেও জানান তিনি।
ভরণপোষণ ও দেনমোহর
মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী, কোন দম্পতির যদি সন্তান থাকে তাহলে তারা সাবালক না হওয়া পর্যন্ত তার ভরণপোষণের দায়িত্ব বাবার উপর থাকবে।
কেউ গর্ভবতী হওয়ার পর তালাক হলে সেই গর্ভের সন্তানের দায়িত্বও বাবাকেই নিতে হবে।
বিয়ের সময় যে দেনমোহর নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটি যদি বিয়ের সময় আদায় করা না হয়, তাহলে আইন অনুযায়ী, স্ত্রী যখন চাইবে, সেই সময়েই তাকে তার দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে।
তিনি যদি তালাকের সময় দেনমোহর দাবি করেন তাহলেও তা পরিশোধ করতে হবে।