বাংলাদেশের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া অন্তত পাঁচ জনের মনোনয়নপত্র নানা কারণে চূড়ান্তভাবে বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন, তবে এসব প্রার্থীরা কমিশনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এখন উচ্চ আদালতে যেতে পারবেন।
মূলত দ্বৈত নাগরিকত্ব ও ঋণ খেলাপি হওয়ার কারণেই তারা প্রার্থিতা হারিয়েছেন।
এর বাইরে আওয়ামী লীগের জোটের অংশ হিসেবে একাদশ সংসদে এমপি হওয়া বিকল্প ধারার মহাসচিব মেজর (অব) আব্দুল মান্নানের মনোনয়নপত্রও এবার বাতিল হয়েছে।
এছাড়া আওয়ামী লীগ শুরুতে মনোনয়ন দিয়ে পরে নতুন প্রার্থী বেছে নেয়ায় মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে ঝালকাঠি-১ আসনের এমপি বজলুল হক হারুনের।
এছাড়া দলের কমিটি নিয়ে বিরোধের জের ধরে গণতন্ত্রী পার্টির সব প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। দলটির বারটি আসনে এবার প্রার্থী দিয়েছিলো। ১৪-দলীয় জোটের অংশ হিসেবে দলটির প্রার্থীরা আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে আগ্রহী ছিলেন।
যেসব প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে তাদের বেশিরভাগেরই মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে রিটার্নিং অফিসারের প্রাথমিক বাছাইয়ের সময়েই। আর কয়েকজনের বাতিল হয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর আপিলের কারণে।
এসব প্রার্থীর মনোনয়নপত্র প্রাথমিক পর্যায়ে রিটার্নিং অফিসার বৈধ বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন।
প্রসঙ্গত, আগামী সাতই জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি ছাড়া বিশটির বেশি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল অংশ নিচ্ছে। আওয়ামী লীগ তার শরীক তিনটি দলকে সাতটি আসন ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
অন্যদিকে বিরোধী দল বিএনপিসহ অনেকগুলো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল নির্বাচন বর্জন করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছে।
ওদিকে যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়া শেষে এখন দুই হাজার ২৬০ প্রার্থী নির্বাচনী লড়াইয়ে প্রার্থী হিসেবে আছেন।
তফসিল অনুযায়ী ১৭ই ডিসেম্বর প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন।
কারা কেন প্রার্থিতা হারালেন
আওয়ামী লীগ এবারের সংসদ নির্বাচনের জন্য তিনশ আসনের বিপরীতে ২৯৮টি আসনের জন্য প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছিলো। কুষ্টিয়া ও নারায়ণগঞ্জের দুটি আসনে দলটি কোন প্রার্থী দেয়নি।
চলতি একাদশ সংসদের দলটির সংসদ সদস্য হিসেবে আছেন এমন একাত্তর জনকে দলটি এবার মনোনয়ন দেয়নি। পরে এই বাদ পড়াদের অনেকে আবার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন।
এছাড়া আওয়ামী লীগ এবার দলের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেয়ার ক্ষেত্রে কোন বাধা না থাকার কথা জানানোর পর দলের অনেক নেতা বিভিন্ন জায়গায় দলের মনোনীত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র নির্বাচন করছেন।
মূলত স্বতন্ত্র প্রার্থীদের আপিলসহ কয়েকটি কারণে ক্ষমতাসীন দলটির ছয় জন প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল হলো নির্বাচন কমিশনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে। তবে কমিশনের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তারা আদালতে যেতে পারবেন।
আওয়ামী লীগের মনোনীত যেসব প্রার্থীর মনোনয়নপত্র চূড়ান্তভাবে বাতিল হয়েছে তারা হলেন – বরিশাল-৪ আসনের শাম্মী আহমেদ, ফরিদপুর -৩ আসনের শামীম হক, যশোর-৪ আসনের এনামুল হক বাবুল, কক্সবাজার -১ আসনের সালাউদ্দিন আহমেদ, ময়মনসিংহ-৯ আসনের মেজর জেনারেল (অব:) আব্দুস সালাম এবং ঝালকাঠি-১ আসনে বজলুল হক হারুন।
এর মধ্যে ঝালকাঠি-১ আসনের বজলুল হক হারুন বর্তমান একাদশ সংসদের সদস্য এবং এবার শুরুতে তিনিই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন। কিন্তু পরে বিএনপি নেতা মেজর (অব) শাজাহান ওমর আওয়ামী লীগে যোগ দিলে আওয়ামী লীগ তাকেই প্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত করে নির্বাচন কমিশনকে জানিয়ে দেয়।
বাকিদের মধ্যে দ্বৈত নাগরিকত্ব সম্পর্কিত ঝামেলায় পড়ে প্রাথমিক বাছাইয়ে বৈধ হয়েও চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রার্থিতা হারিয়েছেন বরিশাল-৪ আসনের শাম্মী আহমেদ এবং ফরিদপুর-৩ আসনের শামীম হক। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে এমন ব্যক্তিদের সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হবার সুযোগ নেই।
বরিশাল-৪ আসনের আওয়ামী লীগের বর্তমান এমপি পঙ্কজ দেবনাথ এবার দলের মনোনয়ন পাননি। তার জায়গায় আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দিয়েছে শাম্মী আহমেদকে।
কিন্তু দ্বৈত নাগরিকত্বের অভিযোগে রিটার্নিং অফিসার তার মনোনয়নপত্র বাতিল করে। এর বিরুদ্ধে আপিল করেন তিনি। একই সাথে তিনি মি. দেবনাথের বিরুদ্ধে হলফনামায় তথ্য লুকানোর অভিযোগ করে প্রার্থিতা বাতিলের আবেদন জানান।
উভয় পক্ষের বক্তব্য শোনার পর কমিশন পঙ্কজ দেবনাথের প্রার্থিতা বহাল রাখে এবং শাম্মী আহমেদের প্রার্থিতা অবৈধ ঘোষণা করে। শাম্মী আহমেদের ঘনিষ্ঠ স্থানীয় পৌর মেয়র কামাল উদ্দিন খান জানিয়েছেন কমিশনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তারা উচ্চ আদালতে আপিল করবেন।
ফরিদপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত শামীম হকের প্রার্থিতা শুক্রবার সকালে বাতিলের সিদ্ধান্ত জানায় নির্বাচন কমিশন। দ্বৈত নাগরিকত্বের অভিযোগে তার মনোনয়নপত্র বাতিলের দাবিতে আপিল করেছিলেন ওই আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী এ. কে. আজাদ। নির্বাচন কমিশন সেই আপিল মঞ্জুর করেন।
মি. হকও এ. কে. আজাদের হলফনামায় দ্বৈত নাগরিকত্বের তথ্য গোপন, সম্পদবিবরণী ও নির্ভরশীলদের বিষয়ে ‘মিথ্যা তথ্য’ দেওয়ার অভিযোগ এনে ইসিতে আপিল করেছিলেন। কিন্তু কমিশন তার এ আপিলও নামঞ্জুর করে।
একে আজাদের আইনজীবী মুস্তাফিজুর রহমান সাংবাদিকদের বলেছেন শামীম হকের পক্ষে নির্বাচন কমিশনে যেসব কাগজপত্র দেয়া হয়েছে সেখানেই বলা হয়েছে ১৪ই ডিসেম্বর পর্যন্ত ওনার নাগরিকত্ব বাতিল হয়নি।
এছাড়া যশোর -৪ আসনের এনামুল হক বাবুল, কক্সবাজার -১ আসনের সালাউদ্দিন আহমেদ এবং ময়মনসিংহ-৯ আসনের মেজর জেনারেল (অব:) আব্দুস সালামের প্রার্থিতা বাতিল হয়েছে ঋণখেলাপি হওয়ার কারণে।
যশোর -৪ আসনের বর্তমান এমপি রণজিৎ কুমার রায়ের পরিবর্তে এবার এনামুল হক বাবুলকে মনোনয়ন দিয়েছিলো আওয়ামী লীগ।
কিন্তু ঋণখেলাপির অভিযোগে তার মনোনয়নপত্র বাতিলের পর তার আইনজীবী হারুনুর রশিদ খান জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তারা উচ্চ আদালতে যাবেন।
ময়মনসিংহ-৯ আসনের মেজর জেনারেল (অব:) আব্দুস সালামের প্রার্থিতা বাতিলের জন্য আবেদন করেছিলেন ওই আসনের আওয়ামী লীগের বর্তমান এমপি ও স্বতন্ত্র প্রার্থী আনোয়ারুল আবেদীন খান। আপিলে অভিযোগ প্রমাণিত হলে কমিশন মি. সালামের প্রার্থিতা বাতিল করে দেয়।
কক্সবাজার -১ আসনেও বর্তমান এমপি জাফর আলমকে মনোনয়ন না দিয়ে প্রার্থী হিসেবে সালাউদ্দিন আহমেদের নাম ঘোষণা করেছিলো আওয়ামী লীগ। মি. আলম স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন।
মি. আহমেদ প্রার্থিতা ফিরে পেতে কমিশনে আপিল করলেও শুনানি শেষে শেষ পর্যন্ত বাতিলের সিদ্ধান্তই বহাল রাখে নির্বাচন কমিশন।
আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বাইরে দলটি থেকে নির্বাচিত বরিশালের সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর প্রার্থিতা বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন। তিনি বরিশাল-৫ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলেন।
দ্বৈত নাগরিকত্বের অভিযোগে তার প্রার্থিতা বাতিল চেয়ে আপিল করেন একই আসনের আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য জাহিদ ফারুক। এ আবেদন মঞ্জুর হওয়ায় সাদিক আব্দুল্লাহর প্রার্থিতা বাতিল হলো।
মি. আব্দুল্লাহও এর বিরুদ্ধে আদালতে যাবেন বলে তার ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন।