বাংলাদেশে বিএনপি ও জামায়াতের ডাকা হরতালের শুরুতে ঢাকায় একটি যাত্রীবাহী ট্রেনে আগুন দেয়া হলে মা ও শিশু সন্তানসহ অন্তত চারজনের মৃত্যু হয়েছে। মঙ্গলবার ভোরে নেত্রকোনা থেকে ঢাকাগামী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে দুর্বৃত্তরা আগুন দিলে এ ঘটনা ঘটে।
ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস তেজগাঁও এলাকা বিমানবন্দর এলাকা পার হয়ে খিলক্ষেতের দিকে এলে কয়েকটি বগিতে আগুন দেখতে পান যাত্রীরা।
তখন তারা চিৎকার করতে শুরু করলে তেজগাঁও স্টেশনে এসে চালক ট্রেনটি থামিয়ে দেন। এরপর ফায়ার সার্ভিস সেখানে এসে আগুন নেভাতে শুরু করে।
গত ১৩ই ডিসেম্বর বিএনপির অবরোধের মধ্যে গাজীপুরের ভাওয়ালে রেল লাইন কেটে ফেলায় এই মোহনগঞ্জ একপ্রেসের সাতটি বগিসহ উল্টে পড়েছিল। সেই ঘটনায় একজনের মৃত্যু হয় এবং একদিন ধরে ওই লাইনে রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়েছিল।
ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার নাজিমউদ্দিন সরকার বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “আমরা খবর পেয়ে দেড় ঘণ্টার মধ্যে আগুন নিভিয়ে ফেলি। পরে একটি বগিতে চারজনের মৃতদেহ পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে মা ও শিশু রয়েছে। অন্য দুইজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ।”
মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের একটি বগিতে আগুন দেয়া হলেও সেখান থেকে তিনটি বগিতে আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল বলে ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে। একটি বগির ভেতরে মৃতদেহগুলো পাওয়া গেছে।
তেজগাঁও থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন বিবিসি বাংলাকে বলেন, যাত্রীরা রেলের বগির ভেতরে আগুন দেখতে পেয়ে চিৎকার করতে শুরু করেন।
“ড্রাইভারের জানতে জানতে একটু সময় লেগে গেলে, তিনি তেজগাঁও স্টেশনে এসে ট্রেন থামান।”
দুর্ঘটনার কারণ
দুর্ঘটনার কারণ জানতে ইতোমধ্যে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস। তবে কর্মকর্তারা বিবিসিকে বলেছেন, তাদের ধারণা, রেলের বগির ভেতরেই পেট্রোল বা রাসায়নিক ব্যবহার করে দুর্বৃত্তরা আগুন ধরিয়ে দিয়ে অন্য বগিতে সরে পড়ে।
নিহতদের মধ্যে দুইজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলেন নাদিরা আক্তার (৩২) এবং তার তিন বছরের ছেলে ইয়াসিন। নাদিরা আক্তার গৃহবধূ ছিলেন বলে জানা যাচ্ছে।
আগুন নেভানোর পরে ট্রেনটি কমলাপুর রেলস্টেশনে পাঠানো হয়েছে।
নির্বাচনী প্রচারণা শুরুর পর সভা-সমাবেশ ও রাজনৈতিক কর্মসূচি নিষিদ্ধ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে নির্দেশনা দিয়েছে, তার বিরুদ্ধে হরতালের ডাক দিয়েছিল বিএনপি। পরবর্তীতে জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য দলগুলো তাতে সমর্থন দিয়েছে।
নির্বাচনী কার্যক্রম যাতে ব্যাহত না হয়, সেজন্য নির্বাচন কমিশনের এক প্রস্তাবের আলোকে আঠারোই ডিসেম্বর থেকেই সভা সমাবেশসহ যে কোন প্রকার রাজনৈতিক কর্মসূচির ওপর ইতোমধ্যেই নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা জানিয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
প্রথমে সোমবার হরতাল ডাকা হলেও কুয়েতের আমিরের মৃত্যুর কারণে একদিন পিছিয়ে দেয়া হয়।
নির্দলীয় সরকারের দাবিতে গত কয়েকমাস ধরে অবরোধ, হরতালের মতো অব্যাহত কর্মসূচি পালন করে আসছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো।
হরতাল বা অবরোধের দিনে বা আগের রাতে ঢাকা ও বিভিন্ন এলাকায় যানবাহনে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটেছে।
বাসে দেয়া আগুনে বাস চালক ও শ্রমিকসহ অন্তত চারজনের মৃত্যু হয়েছিল।
হরতাল অবরোধের কারণে রেলে মানুষের যাতায়াত বেড়েছে। কিন্তু রেলের ওপরেও নাশকতার চেষ্টা শুরু হয়েছে।
এর আগে ১৪ই ডিসেম্বর নীলফামারীর ডোমারে রেললাইনের ৭২টি ক্লিপ খুলে ফেলে নাশকতার চেষ্টা করা হয়েছিল।
তবে এলাকাবাসী সেটা আগেই দেখতে পাওয়ায় দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পায় সীমান্ত এক্সপ্রেস ট্রেন।
গত সপ্তাহেও একই ট্রেন দুর্ঘটনায়
গত সপ্তাহের ১৩ই ডিসেম্বর ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথে একটি ট্রেনের সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়।
ঘটনার পর পুলিশ বলছে দুর্বৃত্তরা রেললাইন গলাতে অক্সিঅ্যাসিটিলিনের ব্যবহার করেছে এবং স্লিপার কেটে ফেলায় অন্তত একশো মিটার লাইন পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে, যার ফলে লাইনটির মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে।
রেল কর্মকর্তারা বলছেন গাজীপুরের ভাওয়াল স্টেশনের কাছে ওই ট্রেনটি লাইনচ্যুত হওয়ায় একজন যাত্রী নিহত হয়েছে এবং লাইনটির যেভাবে ক্ষতি করা হয়েছে তাতে আরও বড় দুর্ঘটনার পরিস্থিতি তৈরি হতে পারত।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পুলিশের ঢাকার রেঞ্জের ডিআইজি সৈয়দ নূরুল ইসলাম বলেছেন এটি নাশকতার ঘটনা, কারণ রেললাইনকে অক্সিঅ্যাসিটিলিনের মাধ্যমে গলিয়ে ফেলা হয়েছে। এই রেললাইন গলানোর জন্য দুই হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রা দরকার হয়।
প্রসঙ্গত, অক্সিজেন ও অ্যাসিটিলিন গ্যাসের মিশ্রণে গঠিত অক্সিঅ্যাসিটিলিন লোহা বা ধাতব পদার্থ গলাতে ব্যবহার করা হয়।
তবে এ ঘটনার পর দেশজুড়ে বিস্তৃত রেললাইনের নিরাপত্তার বিষয়টি আবারো সামনে এসেছে এবং রেল কর্মকর্তারা বলছেন এ বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে আরও কিছু পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।
রেলওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোঃ দিদার আহম্মদ বিবিসি বাংলাকে বলছেন রেললাইনকে নিরাপদ রাখতে রেল কর্তৃপক্ষ যেখানে যে ধরণের ব্যবস্থা নেয়া দরকার মনে করবেন সেই আলোকেই রেলওয়ে পুলিশ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
“তবে স্থানীয়ভাবে জনগণকে সম্পৃক্ত হয়ে যারাই ক্ষতি করার চেষ্টা করবে তাদের চিহ্নিত করতে হবে। গাজীপুরে যারা লাইন কাটার সাথে জড়িত তাদের একজনকে ধরা হয়েছে। বাকিরাও ধরা পড়বে। দেশের সম্পদের ক্ষতি কাউকে করতে দেয়া হবে না,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।