রাজশাহী শহরে থেকে সড়কপথে প্রায় দেড়ঘন্টার দুরত্ব বাগমারা উপজেলার হাট গাঙ্গোপাড়া বাজার। বাজার অতিক্রম করার সময় দেখা গেল নির্বাচনে প্রতিন্দ্বন্দ্বিতাকারী কয়েকজন প্রার্থীর পোস্টার।
এদের একজন বর্তন সংসদ সদস্য এনামুল হক এবং অপরজন আওয়াম লীগ মনোনীত প্রার্থী আবুল কালাম আজাদ।
রাজশাহী জেলার ছয়টি আসনের মধ্যে যে জায়গায় মোটামুটি প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে সেটি হলো রাজশাহী-৪ আসন।
এর বড় কারণ হচ্ছে, এনামুল টানা তিনবার সংসদ সদস্য থাকলেও এবার তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি।
একতরফা নির্বাচন?
হাট গাঙ্গোপাড়া থেকে আরো কিছুটা ভেতরের দিকে বাড়িগ্রাম। এখানে কথা বলছিলাম আফজাল হোসেনের সাথে। তিনি মূলত কৃষক হলেও যখন কৃষিকাজ থাকে না তখন তিনি ভ্যান চালক হিসেবে কাজ করেন।
নির্বাচন প্রসঙ্গে কথা উঠতেই তিনি জানালেন, বিষয়টি নিয়ে তার তেমন একটা আগ্রহ নেই। কারন এই নির্বাচনকে তিনি ‘একতরফা নির্বাচন’ হিসেবে দেখছেন। তার মতে ‘ভোট দেয়া এবং না দেয়া সমান কথা’।
“বাংলাদেশে মূল দল দুইটা। আওয়ামী লীগ আর বিএনপি। বিএনপি তো নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেনা। একতরফা নির্বাচনের তো সুষ্ঠু আর অ-সুষ্ঠু নাই। সেখানে সেন্টারে গেলেও সমস্যা নাই না গেলও সমস্যা নাই,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন আফজাল হোসেন।
গ্রামের চায়ের দোকান কিংবা বাজারে নির্বাচন নিয়ে মানুষের মধ্যে কোন আলোচনা দেখা গেলনা। বেশিরভাগ মানুষ তাদের নৈন্দন্দিন কাজ নিয়ে ব্যস্ত।
এছাড়া অনেকে মনে করেন, নির্বাচন নিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করলে তিনি হয়তো ‘বিপদে পড়বেন’।
হাট গাঙ্গোপাড়া থেকে আরো পাঁচ কিলোমিটার দুরত্বে নরদাশ বাজার। এই বাজারের পাশে কথা হচ্ছিল আমজাদ হোসেনের সাথে।
আমজাদ হোসেন মনে করেন, বিএনপি নির্বাচনের মাঠে না থাকার কারণেই নির্বাচনী আমেজে ভাটা পড়েছে।
“বিএনপি নাই এখন একতরফা। এরাই তো আওয়ামী লীগ, এরাই তো আবার অন্যরকম। এ রকমই তো দেখা যাচ্ছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন আমজাদ হোসেন।
বাগমারা উপজেলার বহু মানুষ কৃষিকাজ, মৎস্য কিংবা ভ্যান চালানোর সাথে জড়িত। এখানকার নারীরাও নানা ধরণের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত।
বিভিন্ন গ্রামে বেশ কয়েকজন নারীর সাথে কথা বলেছেন বিবিসি বাংলা সংবাদদাতা। বোঝার চেষ্টা করেছেন নির্বাচন নিয়ে নারীদের ভাবনা কী?
নির্বাচনের মাঠে কী হচ্ছে? প্রার্থী কারা? এসব বিষয় নিয়ে বেশিরভাগ নারীর কোন ধারণা নেই। তারা দৈনন্দিন জীবন সংগ্রামে ব্যস্ত।
তারা ভোট দিতে যাবেন কি না সেটি নির্ভর করছে স্বামী কিংবা পরিবারের সিদ্ধান্তের ওপর।
“হামার (আমার) কাছে কোন সিদ্ধান্ত নাই। আর ওগুলা হামার (আমরা) লেখাপড়া জানিনা তো ভালো করে বুইঝবার পারিনা,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন সায়েদা নামে এক নারী।
প্রতিযোগিতা হবে?
রাজশাহী জেলার অন্যান্য আসনের চেয়ে রাজশাহী-৪ আসনে আলাদা কিছু বিষয় জড়িত আছে। এই বাগমারা উপজেলায় এক সময় সর্বহারা পার্টির দোর্দন্ড প্রতাপ ছিল। এরপর এখানেই উত্থাণ ঘটে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামাতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ বা জেএমবি নেতা সিদ্দিকুল ইসলামের, যিনি ‘বাংলা ভাই’ নামে পরিচিক হয়ে উঠেছিলেন।
এই এলাকায় এখন ‘সর্বহারা পার্টি’ এবং জঙ্গিদের কোন তৎপরতা নেই।
রাজশাহী-৪ আসনে প্রার্থিরা হলেন – এনামুল হক ( বর্তমান এমপি ও স্বতন্ত্র), আবুল কালাম আজাদ (আওয়ামী লীগ), আবু তালেব (জাতীয় পার্টি), বাবুল হোসেন (স্বতন্ত্র), সাইফুল ইসলাম রায়হান (বিএনএম), জিন্নাতুল ইসলাম (ন্যাশনাল পিপলস পার্টি)।
এনামুল হক বিবিসি বাংলাকে বলেন, যেসব স্বতন্ত্র পার্থী নির্বাচনের মাঠে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে এবং জয়ের সম্ভাবনা তৈরি হয়, তাদের জন্য টিকে থাকা কঠিন।
“তাদের বক্তৃতা একটাই – নৌকায় ভোট না দিলে কেউ যাতে কেন্দ্রে না যায়,” বলছিলেন মি. হক।
তিনি অভিযোগ করেন, প্রতীক বরাদ্দ হবার পরের দিন থেকে বিভিন্ন জায়গায় তার নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুর করেছে নৌকা মার্কা প্রার্থীর সমর্থকরা।
তবে কোন ধরণের নির্বাচনী সহিংসতার কথা অস্বীকার করলেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী আবুল কালাম আজাদ। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তাদের জোটের শরীক ও জাতীয় পার্টির সাথে আসন বন্টন নিয়ে ইতোমধ্যে সমঝোতা করেছে।
আওয়ামী লীগ প্রার্থি আবুল কালাম আজাদ বলছেন, আসন নিয়ে সমঝোতা হলেও রাজশাহী-৪ আসনের চিত্র ভিন্ন রকম।
“আসন ভাগাভাগি জাতীয়ভাবে শরিকদের সাথে। মাঠে যারা নির্বাচন করছে তাদের সাথে তো আসন ভাগাভাগি হয় নাই। আমি আওয়ামী লীগের প্রার্থী, দিনরাত ২৪ ঘণ্টা নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত আছি। এবং আমার সাথে শক্ত প্রতিপক্ষও আছে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন আবুল কালাম আজাদ।
এমনিতেই নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহ কম। অনেকে মনে করেন, মাঠে প্রার্থী যারা আছেন তাদের মধ্য থেকে একজনকে বেছে নিতে হবে।
“ নিজেরা নিজেরা করুক আর যাই করুক, নির্বাচন তো নির্বাচনই। যেহেতু স্বতন্ত্র প্রার্থী আছে। আমাদের দেখতে হবে এলাকার উন্নয়ণ করবে যে তাকে বেছে নিতে হবে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন কোয়ালীপাড়া গ্রামের মুরশেদ আলী।
প্রার্থীর ছড়াছড়ি
রাজশাহী জেলায় পাঁচটি সংসদীয় আসনে মোট ৪০জন প্রার্থী রয়েছেন। প্রতিটি আসনে ছয়জন করে প্রার্থী আছেন। শুধু একটি আসনে নয়জন প্রার্থী।
রাজশাহীতে বিভিন্ন পক্ষের সাথে কথা বলে বোঝা গেল কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থী ছাড়া অধিকাংশ প্রার্থী হয়তো আওয়ামী লীগের মিত্র, নয়তো তাদের উপর আওয়ামী লীগের প্রভাব রয়েছে।
যারা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন তারা কোন না কোনভাবে আওয়মী লীগের আর্শিবাদপুষ্ট বলে মনে করেন ভোটাররা।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বুধবার রাজশাহীর পাঁচটি সংসদীয় আসনের প্রার্থীদের সাথে মতবিনিময় করেছেন জেলা সার্কিট হাউজে।
নির্বাচনে অংশগ্রহনকারী বড় দলগুলো নিজেদের মধ্যে আসন ভাগাভাগি করার ফলে নির্বাচন প্রতিন্দ্বন্দ্বিতাহীন হয়ে পড়েছে কি না?
বিবিসি বাংলার এ প্রশ্নের জবাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, “ প্রতিন্দ্বন্দ্বিতা কতটা হবে সেটা এই মুহূর্তে বলা যাবে না। কিন্তু আমরা, প্রার্থীরা সকলে মিলে প্রতিন্দ্বন্দ্বিতার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্ট করছি।”
“আমরা বিশ্বাস করি প্রতিন্দ্বন্দ্বিতা হবে এবং ভোটাররা ভোট দিতে আসবেন,” বলেন মি.আউয়াল।
‘শেষ পরিণতি’ দেখতে চায় বিএনপি
১৯৯১ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন প্রতিন্দ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে দেখা গেছে রাজশাহী অঞ্চলে বিএনপির ভালো ভোট ব্যাংক রয়েছে। কিন্তু এবার নির্বাচনে বিএনপি নেই।
রাজশাহীতে দলটির নেতারা মনে করেছেন, নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি ‘যথার্থ সিদ্ধান্ত’ নিয়েছে। তারা মনে করেন, বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে পরিণতি ২০১৮ সালের মতোই হতো।
নির্বাচনের নানা আয়োজনের মধ্যে বিএনপি এখন সরকারবিরোধী কর্মসুচী চালিয়ে যাচ্ছে।
রাজশাহীতে বিএনপির নেতা-কর্মীরা মনে করেন, সাতই জানুয়ারি নির্বাচনে পাঁচ থেকে ১০ শতাংশের বেশি ভোট পড়বে না। সেজন্য তারা আন্দোলন চালিয়ে যেতে চান।
বিএনপি নেতা ও রাজশাহী সিটি করর্পোরেশনের সাবেক মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল বলেন, নির্বাচন ও আন্দোলনের ‘শেষ পরিণতি’ তারা দেখতে চান।
“পালিয়ে থোকলেও আমরা থাকবো। এটা ছয় মাস হতে পারে, তিন মাস হতে পারে, চারমাস হতে পারে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন
তিনি বলেন কর্মসূচি আরো আসবে এবং সেসব কর্মসূচি তারা ‘সফলভাবে’ পালন করবেন।
আওয়ামী লীগের কয়েকজন প্রার্থীর সাথে কথা বলে বোঝা গেল, নির্বাচনে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ ভোটার কেন্দ্রে আনার টার্গেট রয়েছে তাদের।
তবে সেটি কতটা সম্ভব হবে তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত।