বাংলাদেশের আলোচিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালি চমকপ্রদ এক অফার নিয়ে ফিরে এসে ব্যাপক সাড়া পাওয়ার পর কোম্পানিটি বলছে তারা আর আগের স্টাইলে অগ্রিম টাকা নিয়ে ব্যবসা করবে না বরং শুধুমাত্র ‘ক্যাশ অন ডেলিভারি’ মেথডে পণ্য সরবরাহ করবে।
“আমরা এখন শুধু ক্যাশ অন ডেলিভারিতে পণ্য দিচ্ছি। তবে একই পণ্য বাজারের চেয়ে এখানে অনেক কম দামেই পাবে গ্রাহক,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মাদ রাসেল।
মি. রাসেল ইভ্যালিরই গ্রাহকদের দায়ের করা প্রতারণা মামলায় ২০২১ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর আটক হয়েছিলেন। সম্প্রতি সব মামলা জামিন লাভের পর গত ১৮ই ডিসেম্বর তিনি ছাড়া পান।
তার সাথে একই দিনের প্রতিষ্ঠানটির তখনকার চেয়ারম্যান তার স্ত্রী শামীমা নাসরিনও আটক হয়েছিলেন। তিনি অবশ্য আগেই জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।
তাদের আটকের পর ইভ্যালির ব্যবস্থাপনার জন্য সাবেক বিচারপতি এএইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি অন্তর্বর্তীকালীন বোর্ড গঠন করা হয়েছিল।
মি. রাসেলের আটকের পর ইভ্যালির কার্যক্রম থমকে যায়। তখন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ডিজিটাল ই-কমার্স পরিচালন সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি জানিয়েছিল যে, গ্রাহক, মার্চেন্ট ও অন্যান্য সংস্থার কাছে ইভ্যালির দেনা মোট ৫৪৩ কোটি টাকা।
মোহাম্মাদ রাসেল অবশ্য বলছেন নিয়ম নীতি মেনে ঠিকমতো ব্যবসা চালাতে পারলে এই টাকা শোধ করতে খুব বেশী সময় তাদের প্রয়োজন হবে না।
ইভ্যালি জানিয়েছে গত শুক্রবার ‘বিগ ব্যাং’ অফারের একদিনেই আশি হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে অর্ডার পেয়েছেন তারা। মূলত এর মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠানটি আবার ব্যবসায় ফিরল।
নতুন ব্যবসায়িক মডেল
২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠার পরেই অনলাইন কেনাকাটার ক্ষেত্রে সাড়া জাগিয়েছিলো ইভ্যালি।
সব ধরণের পণ্যে ব্যাপক ছাড় এবং লোভনীয় ক্যাশব্যাক অফারের পাশাপাশি তারকাদের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর করা, টিভি চ্যানেল-সহ সব গণমাধ্যমে দর্শনীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছিলো প্রতিষ্ঠানটি।
শুরুর দিকে অনেক গ্রাহক বাজারমূল্যের অর্ধেক কিংবা কোনও কোনও ক্ষেত্রে তার চেয়েও কম দামে পণ্য পেয়ে বিস্মিত হয়েছিলেন। ফলে মাত্র তিন বছরে এর গ্রাহক সংখ্যা ৪০ লাখ ছাড়িয়ে গিয়েছিলো।
কিন্তু শুরু থেকে অনেকের অভিযোগ ছিল যে অগ্রিম দশ শতাংশ টাকা দিয়ে পণ্যের অর্ডার দেয়ার পর অনেকের পণ্য পেতে কয়েক মাসও সময় লেগেছে। আবার অনেকে শেষ দিকে অর্ডার দিয়ে পণ্যও পাননি।
এমনকি ইভ্যালি যেসব বিক্রেতা বা মার্চেন্টদের কাছ থেকে পণ্য নিতো তারাও সময়মতো তাদের বিক্রিত পণ্যের অর্থ পাননি।
মি. রাসেল ও তার ইভ্যালি তখন যে মডেলে ব্যবসাটি পরিচালনা করছিলো বিশেষজ্ঞদের মতে সেটি ছিলো ‘পঞ্জি মডেল’।
এ মডেলে কম বিনিয়োগে অধিক মুনাফা লাভের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। আর গ্রাহকের কাছ থেকে পাওয়া অর্থ ব্যবসায় বিনিয়োগ না করে কিছু মানুষকে ছাড়, পুরষ্কার বা লভ্যাংশ দিয়ে মানুষের লোভ বা আকাঙ্ক্ষাকে জিইয়ে রাখা হয়। এখানে প্রতিষ্ঠানের নিজের বিনিয়োগ থাকে একেবারেই কম।
বিবিসি বাংলাকে রবিবার মি. রাসেল জানিয়েছেন যে তিনি আর আগের পদ্ধতিতে ব্যবসা পরিচালনা করবেন না। “এখন কারও কাছ থেকে কোন অগ্রিম অর্থ নেয়া হবে না”, জানাচ্ছেন তিনি।
“গ্রাহকের হাতে পণ্য পৌঁছানোর পর টাকা গ্রহণ করা হবে। আমাদের মাধ্যমে অর্ডার পেয়ে বিক্রেতারা কুরিয়ার কোম্পানিকে পণ্য বুঝিয়ে দিবেন। কুরিয়ার সরাসরি বিক্রেতাকে তার টাকা পরিশোধ করবে। কুরিয়ার চার্জের পার্ট হিসেবে ইভ্যালি কমিশন পাবে। বিক্রেতার মূল্যের সাথে সামান্য প্রফিট রেখে পণ্য বিক্রি করবো আমরা। সে কারণে ওই একই পণ্য বাজারের চেয়ে গ্রাহক আমাদের কাছে কম দামেই পাবে,” বলছিলেন তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান আগে বিক্রেতার কাছ থেকে পণ্য নিয়ে ইভ্যালি ভর্তুকি দিয়ে ‘অবিশ্বাস্য কম দাম’ যেভাবে অফার করতো সেটি এখন থেকে ইভ্যালি আর করবে না।
এছাড়া অগ্রিম টাকা নিয়ে অর্ডার করার পরেও একজন গ্রাহকের জানার সুযোগ ছিলো না যে তিনি কবে সেই পণ্য পাবেন।
এবার প্রতিষ্ঠানটি বলছে গ্রাহক যে কোনও পণ্য অর্ডার দেওয়ার বায়াত্তর ঘণ্টার মধ্যে ই-কুরিয়ারের মাধ্যমে পেয়ে যাবে এবং সব পণ্য সিওডিতে (ক্যাশ অন ডেলিভারি) পাওয়া যাবে।
মি. রাসেল বলছেন এখন তাদের প্রধান কাজ হবে ব্যবসা সচল রেখে গ্রাহকদের আস্থা তৈরি করা।
“মানুষ যেন স্বচ্ছন্দে সঠিক দামে সঠিক পণ্য সঠিক সময়ে পায় – সেটিই হবে আমাদের একমাত্র নীতি। আগে আগে ভর্তুকি দিয়ে পণ্য গ্রাহকদের দিতাম, সেটি আর করবো না। আর প্রচার বা বিজ্ঞাপনে আমরা কোনও অর্থ ব্যয় করবো না। বরং কেউ চাইলে আমাদের প্লাটফরমে বিজ্ঞাপন দিতে পারে। এটিই এখন আমাদের ব্যবসায়িক নীতি”, বলছিলেন তিনি।
বকেয়া কীভাবে শোধ হবে?
দুই হাজার একুশ সালের সেপ্টেম্বরে মি. রাসেল ও তার স্ত্রী আটক হওয়ার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল তখন পর্যন্ত গ্রাহকদের কাছে প্রতিষ্ঠানটির দেনা ৩১১ কোটি টাকা।
আর মার্চেন্ট, অর্থাৎ যে সব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পণ্য নিয়ে সরবরাহ করার কথা তাদের কাছে দেনা ২০৫ কোটি টাকা।
মি. রাসেল বিবিসি বাংলার কাছে এ তথ্য যথার্থ উল্লেখ করে বলেছেন তাদের মোট দেনার পরিমাণ সাড়ে পাঁচশ কোটি টাকার মতো, যা পরিশোধের কার্যক্রম তারা শুরু করেছেন।
“মুনাফা থেকেই আমরা দেনা শোধ করবো। দেখুন একটি ক্যাম্পেইন থেকেই আমাদের সারা বছরের অপারেশনাল কস্ট উঠে এসেছে। আর বকেয়া শোধ এক ক্যাম্পেইন থেকেই আসছে। মুনাফা থেকে বকেয়া শোধ করবো। শোধ না হওয়া পর্যন্ত আমরা উদ্যোক্তা বা পরিচালকরা কোনও টাকা নিবো না,” বলছিলেন তিনি।
তবে দেনা কিছুটা শোধ হলেই ইভ্যালির কার্যক্রম সম্প্রসারণের জন্য বিনিয়োগকারীদের কাছে যাওয়ার পরিকল্পনা আছে প্রতিষ্ঠানটি।
“বিনিয়োগকারী পেলে বিজনেস যেমন সম্প্রসারণ করতে পারবো তেমনি বকেয়া কিছু বাকি থাকলে তাও সম্পূর্ণ শোধ করে দিতে পারবো আমরা”, বলছিলেন মি. রাসেল।
এতো অভিযোগের পরও মুক্তি কীভাবে
মি. রাসেলের বিরুদ্ধে প্রতারণার ষোলটি মামলা করেছিলেন ইভ্যালির গ্রাহকরা।পর্যায়ক্রমে সব মামলায় জামিন পেয়ে তিনি বের হয়ে আসলেও অনেকেই মনে করেন ইভ্যালিকে পুনরায় পরিচালনার জন্য সমঝোতার ভিত্তিতেই তিনি মুক্তি পেয়ে বের হয়ে এসেছেন।
মি. রাসেল অবশ্য বলছেন কোনও আলোচনা বা সমঝোতা নয়, বরং যেসব গ্রাহক মামলা করেছিল তারাই আদালতে জানিয়েছেন যে তারা মনে করেন যে ইভ্যালি ব্যবসা চালাতে পারলেই তাদের টাকা ফেরত পাবেন এবং সে কারণে তারা আর মামলা চালাতে চান না।
“গ্রাহকরা মামলা করেছিলো। তারা স্বীকারোক্তি দিয়েছে যে মামলা চললে টাকা পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে। তারা আদালতে বলেছে এ মামলা চালাতে চায় না। তারা যখন বলেছে ইভ্যালি বিজনেস রান করলে টাকা পাবো। সেটা আদালতে দেয়ার পরেই কিন্তু আমার জামিন হয়েছে। আদালত কিছু শর্ত দিয়েছে যেমন পাসপোর্ট জমা রাখতে হবে এবং লোকসান দিয়ে বিজনেস করা যাবে না,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
“আমি কোনও আলোচনা বা মুচলেকা দিয়ে জামিন পাইনি। গ্রাহকরাই বলেছেন ইভ্যালি পরিচালনায় মামলাগুলো বাধা এবং রাসেলকে মুক্তি পেলে আমাদের আপত্তি নেই।”
ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় কিংবা কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনও শর্ত দিয়েছে কি-না এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন তারা কোন লিখিত শর্ত পাননি।
“তবে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় টেকনিক্যাল কমিটি আছে। ই-কমার্স নীতিমালা আছে। এ ধরণের ব্যবসায় অন্য সবার জন্য যেটা প্রযোজ্য, সেটা আমাদের জন্যও প্রযোজ্য হবে। আমরা সেগুলো মেনে চলবো”, জানাচ্ছেন তিনি।