ভারতে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের উদ্দেশ্য ‘দুর্নীতির তদন্ত নয়’, তাকে গ্রেপ্তার করে ‘কার্যসিদ্ধি’ করা। “আমাদের দল ভাঙতে’ এই কৌশল প্রয়োগ করছে বিজেপি”, এমনটাই অভিযোগ করছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল, যার সম্ভাব্য গ্রেপ্তারকে ঘিরে বুধবার রাত থেকে সরগরম ছিল ভারতের রাজধানী শহর।
কথিত আবগারি দুর্নীতির অভিযোগে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টোরেট (ইডি)-এর সমন তৃতীয়বার এড়ানোর পর তেসরা জানুয়ারী গভীর রাতে আম আদমি পার্টির (আপ) নেতাদের তরফে আশঙ্কা জানানো হয়, পরদিন সকালেই মি কেজরিওয়ালের বাড়িতে তল্লাশি চালানো হবে।
তারপর তাকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে এমন তথ্য রয়েছে বলে দাবি করেন আতিশি মারলেনা এবং সৌরভ ভারদ্বাজের মতো আপ-এর নেতারা।
অন্যদিকে, বিজেপি-র তরফে এই অভিযোগ নস্যাৎ করে উল্টে মি কেজরিওয়ালকে ইডি-র মুখোমুখি হওয়ার ‘উপদেশ’ দেওয়া হয়।
প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার ইডি-র দপ্তরে আসার জন্য মি কেজরিওয়ালকে সমন পাঠানো হয়েছিল। তার উত্তরে তিনি জানিয়েছিলেন, “ওই সমন বেআইনি।”
ঠিক কী অভিযোগ?
আবগারি নীতি বদলে ২০২১-২২ সালে কয়েকটি সংস্থাকে বেআইনি ভাবে বিশেষ সুযোগ পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে দিল্লির আপ সরকারের বিরুদ্ধে।
বেসরকারি মদ ব্যবসায়ী সংস্থাগুলিকে খুচরো মদ বিক্রেতাদের আওতায় নিয়ে আসা হয়। কয়েকটি কম্পানিকে লাইসেন্স ফি কমিয়ে দেওয়া-সহ বিশেষ সুযোগ পাইয়ে দিতে আবগারি নীতিতে এই রদবদল বলে অভিযোগ ওঠে। উপ মুখ্যমন্ত্রী মনীশ সিসোদিয়ার আওতায় ছিল আবগারি বিভাগ। শুরু হয় প্রবল বিতর্ক।
আপ সরকারের তরফে দাবি করা হয় এই পরিবর্তনের ফলে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় করা হয়েছে।
বিতর্কের জেরে নয়া আবগারি নীতি বাতিল করার কথা ঘোষণা করেছিল আপ সরকার। তবে তার আগেই এই বিষয়ে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেন দিল্লির লেফটেন্যান্ট গভর্নর ভিকে সক্সেনা। এই মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত হিসাবে নাম ছিল তৎকালীন উপমুখ্যমন্ত্রী মি সিসোদিয়া এবং সাংসদ মি সঞ্জয় সিং।
গত বছর এপ্রিল মাসে ওই মামলায় অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে নয় ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই। একই সঙ্গে এই মামলায় বেআইনি আর্থিক লেনদেনের অভিযোগের তদন্ত শুরু করে ইডি।
পরে আবগারি দুর্নীতির মামলায় গত বছর মি সিসোদিয়া এবং মি সিংকে গ্রেপ্তার করা হয়। ইডি-র চার্জশিটে মি কেজরিওয়ালয়ের নামও যোগ হয়। সে সময়েও গুঞ্জন ওঠে মি কেজরিয়ালকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে। তবে তিনি তখন গ্রেপ্তার হননি।
গ্রেফতারি ঘিরে জল্পনা
দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীকে এ পর্যন্ত তিনবার তলব করেছে ইডি। প্রথমে দোসরা নভেম্বর ডাকা হলে, পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা ভোটের প্রচারের কাজে ব্যস্ত থাকার কারণ দেখিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে হাজির হননি মি কেজরিওয়াল। তার অভিযোগ ছিল, এই তলব বেআইনি এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
২১শে ডিসেম্বরে হাজির না হয়ার পর তেসরা জানুয়ারি তাকে আবার তলব করে ইডি। ওই দিনও জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হননি আপ প্রধান। বরং ওই নোটিশের আইনি বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি।
এরপর বিজেপি তার বিরুদ্ধে তোপ দাগে।
বুধবার (তেসরা জানুয়ারি) রাতে, আপ-এর অতিশি মারলেনা এবং সৌরভ ভারদ্বাজ-সহ একাধিক আপ নেতা সমাজমাধ্যমে মি কেজরিওয়ালকে গ্রেফতারের আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করেন। মুহূর্তে সেই পোস্ট ভাইরাল হয়ে যায়।
যদিও ওই আশঙ্কার কোনও ভিত্তি নেই বলে দাবি করা হয় বিজেপির পক্ষ থেকে। এ প্রসঙ্গে বিজেপির হরিশ সুরানা সংবাদ সংস্থাকে বলেন, “জানি না এমন তথ্য ওরা কথা থেকে পেলেন। যদি অন্যায় না-ই করে থাকে তাহলে ভয় কীসের?”
বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই এই রাজনৈতিক তরজাকে ঘিরে ভারতের রাজধানীর পারদ ঊর্ধ্বমুখী ছিল। সকাল থেকে ‘আপ’-এর নেতা ও সমর্থকেরা দিল্লির পার্টির অফিসে সমবেত হন। জল্পনা চলতে থাকে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী সত্যিই গ্রেফতার হচ্ছেন কি না?
এরই মাঝে, এদিন বেলা ১২টায় একটি ভিডিও বার্তায় মি কেজরিওয়াল সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, “গত দু’বছরে আপনারা একাধিকবার এই দুর্নীতির অভিযোগের কথা শুনেছেন। বিভিন্ন সময় আমাদের নেতা-মন্ত্রীদের বাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়।”
“আমাদের তিনজন মন্ত্রী জেলে আছেন। যদিও তাদের বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ মেলেনি। এখন বিজেপি আমাকে জেলে পাঠাতে চায়। আমাকে পাঠানো এই সমন বেআইনি।”
অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দাবি
আসন্ন লোকসভা নির্বাচনকে ঘিরে শাসক ও বিরোধীদলগুলির মধ্যে অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ যখন তুঙ্গে, সে সময়ে তিনি সরাসরি বিজেপির বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন।
তার অভিযোগ, “এখন তারা কোনও মামলার তদন্ত করে না। অন্য দলের নেতা-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে ইডি বা সিবিআই পাঠানো হয়।”
“উদ্দেশ্য হল অন্য দলের নেতাদের বিজেপি তে সামিল করা। এক-দু’টো নয় এমন বহু ঘটনা আছে যেখানে অন্যদলের নেতাদের বিরুদ্ধে ইডি বা সিবিআই-এর তদন্ত চলছিল বা গুরুতর অভিযোগ ছিল, কিন্তু বিজেপি তে যোগ দিতেই, সমস্ত মামলা দফা রফা হয়ে গেল। ঠাণ্ডা ঘরে চলে যায় সেগুলো। আর যারা ওদের দলে যায় না, তারা জেলে যায়।”
“মনীশ সিসোদিয়া, সঞ্জয় সিং এবং বিজয় নায়ার দুর্নীতির জন্য জেলে নেই। ওরা জেলে বন্দি কারণ বিজেপি-তে যোগ দেননি।”
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের অভিযোগ করেন তিনি।
“প্রকাশ্যে গুন্ডামি চলছে। যাকে খুশি জেলে ভরে দেওয়া হচ্ছে। বিজেপি আমায় গ্রেপ্তার করতে চায়। সততাই আমার সবচেয়ে বড় সম্পত্তি এবং শক্তি। মিথ্যে অপবাদ দিয়ে, বেআইনি সমন পাঠিয়ে আমাকে বদনাম করতে চাইছে ওরা। আমার সততাকে আঘাত করতে চায়,” মি কেজরিওয়াল এদিন বলেছেন।
ইডির পাঠানো সমনের আইনানুগ কোনও ভিত্তি নেই, তাই তিনি তাদের দপ্তরে যাননি বলে দাবি করেছেন। কিন্তু তদন্তে সহযোগিতা করবেন এই আশ্বাসও দিয়েছেন তিনি।
একই সঙ্গে এই আশঙ্কার কথাও জানিয়েছেন, যে বিজেপি তাকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে গ্রেপ্তার করতে চায়। “আমার আইনজীবীরা জানিয়েছেন, ইডির পাঠানো সমন বেআইনি। এবং ওই সমনের উত্তরে আমি ইডিকে বিস্তারিত ভাবে লিখে জানিয়েছি কেন তাদের সমন বেআইনি। কিন্তু ওরা সে বিষয়ে কোনও জবাব দেননি। তার মানে ওদের কাছে আমার তোলা প্রশ্নের কোনও জবাব নেই। তার মানে ওরাও মেনে নিচ্ছে এই সমনের কোনও আইনি ভিত্তি নেই।”
দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, আইন মেনে সমন পাঠানো হলে, তিনি নিশ্চয়ই ইডির দপ্তরে যাবেন।
একই সঙ্গে তিনি বলেছেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে তাকে লোকসভা নির্বাচনের আগেই ডাকা হয়েছে। মি কেজরিওয়াল প্রশ্ন করেন, “এই তদন্ত তো দু’বছর ধরে চলছে। এখনই কেন আমাকে ডেকে পাঠানো হচ্ছে। আট মাস আগে, আমাকে সিবিআই ডেকেছিল, আমি গিয়েছিলাম। সম্পূর্ণ সহযোগিতাও করেছি। এখন লোকসভা নির্বাচনের দু’মাস আগে কেন ডাকছে?”
বিজেপির বক্তব্য
শুধু আবগারি দুর্নীতি নয়, মি কেজরিওয়ালের বিলাসবহুল বাংলো, দিল্লিতে ‘মহল্লা ক্লিনিক’ সংক্রান্ত একাধিক বিষয়ে সরব হয়েছে বিজেপি।
বুধবার (তেসরা জানুয়ারি) বিজেপির গৌরব ভাটিয়া সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেছিলেন, “আমরা তো প্রথম থেকেই বলে আসছি, যদি অরবিন্দ কেজরিওয়াল নির্দোষ হয়ে থাকেন, তাহলে কেন তিনি ইডি তলব করলেও যাচ্ছেন না?”
অন্য দিকে, কেজরিওয়ালের মন্তব্য প্রকাশ্যে আসার পর দিল্লির বিজেপি প্রধান বীরেন্দ্র সচদেবা সংবাদসংস্থা এএনআই কে বলেন, “আপনি (অরবিন্দ কেজরিওয়াল) তদন্তকারী সংস্থা থেকে পালাতে চাইছেন। ইডি তিনবার আপনাকে ডেকেছে। কিন্তু আপনি যাননি। এখন গ্রেপ্তার হওয়ার কথা বলে শোক প্রকাশ করছেন। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী, আপনার আইন মেনে চলা উচিত। কিন্তু আপনি নিজেই আইন মানছেন না।”
বৃহস্পতিবার দিল্লির লেফটেন্যান্ট গভর্নর ভি কে সাক্সেনা দিল্লি সরকারের নেতৃত্বে চালানো মহল্লা ক্লিনিকগুলিতে ভুয়ো প্যাথলজি এবং রেডিওলজি পরীক্ষার তদন্তের জন্যও সিবিআই তদন্তের সুপারিশ করেছেন। অভিযোগ রয়েছে, শহরের বেসরকারি ল্যাবগুলিকে সাহায্য করতে লক্ষ লক্ষ ভুয়ো রোগীর নথি বানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে বিজেপির মি ভাটিয়া বলেন, “আবগারি কেলেঙ্কারি ছাড়াও মহল্লা ক্লিনিকে প্যাথলজি ও রেডিওলজির নাম করে ভুয়ো বিল বানানোর অভিযোগও রয়েছে ওর বিরুদ্ধে। ধীরে ধীরে প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে, এই পুরো দলটাই কতটা দুর্নীতিগ্রস্ত। ”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের চোখে
দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী নিজে অঙ্গীকার করেছিলেন তার সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়বে। কিন্তু তার দলের বিরুদ্ধে একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায়, আপ এখন বেশ অস্বস্তিতে বলেই মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
“অরবিন্দ কেজরিওয়াল দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান চালাবেন এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। অথচ ওর বিলাসবহুল বাড়িই কয়েক কোটি টাকা দিয়ে তৈরি, আবগারি দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে, মনীশ সিসোদিয়ার বিরুদ্ধে প্রমাণ আছে বলে আদালত জানিয়েছে। একটার পর একটা দুর্নীতির অভিযোগে আপের একাধিক নেতা জেলে আছেন,” বিবিসি বাংলাকে বলেছেন অধ্যাপক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী।
তবে, কার বিরুদ্ধে তদন্ত হবে এবং কার বিরুদ্ধে হবে না, সেটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এ কথাও মনে করেন বিশ্লেষকরা।
“এ কথাটা যেমন ঠিক যে বিজেপিতে থাকলে হয়তো তদন্ত হত না, তেমন এটাও ঠিক যে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের কথা আমরা মেনে নিতে পারতাম যদি ওদের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ না উঠত,” বলছিলেন মি চক্রবর্তী।
এখন প্রশ্ন হল, মি কেজরিওয়াল গ্রেফতার হতে পারেন কি না।
আইনজ্ঞদের মতে, একাধিকবার হাজিরা না দেওয়ার কারণে গ্রেফতার হতে পারেন কোনও ব্যক্তি।
এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে, সুপ্রিম কোর্টের প্রবীণ আইনজীবী রেবেকা মাম্মেন জন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ইডি চাইলে তাকে গ্রেপ্তার করতেই পারে। আবার চতুর্থবার সমনও পাঠাতে পারেন। পুরোটাই নির্ভর করছে ইডি-র উপর।”