বাংলাদেশে সদ্য সমাপ্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয় পেয়ে টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠন করতে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাতটায় বঙ্গভবনে নতুন সরকারের মন্ত্রীসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হতে যাচ্ছে বলে বিবিসি বাংলাকে নিশ্চিত করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
তার আগে, বুধবার জাতীয় সংসদ ভবনে নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ পড়ানো হবে। বর্তমান স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী শপথ পড়াবেন।
বঙ্গভবনে মন্ত্রিসভার শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এই অনুষ্ঠানের জন্য ইতিমধ্যেই যাবতীয় প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হয়েছে বলে সাংবাদিদের জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন।
“আগামী ১১ই জানুয়ারি বৃহস্পতিবার বিকালে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি আমরা নিচ্ছি। ঐতিহ্যগতভাবেই শপথ অনুষ্ঠান বঙ্গভবনে হয়ে থাকে। আমরা সন্ধ্যা ৭টায় শপথ অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছি”, মঙ্গলবার বিকালে নিজ কার্যালয়ের সামনে সাংবাদিকদের বলেন মি. হোসেন।
অনুষ্ঠানের নিয়মানুযায়ী, রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন প্রথম প্রধানমন্ত্রীকে, তারপর অন্যান্য মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের শপথ বাক্য পাঠ করাবেন বলে জানা গেছে।
নতুন মন্ত্রিসভায় সরকার প্রধান হিসেবে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাই থাকছেন। এবার নিয়ে তিনি পঞ্চমবারের মত প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ড।
এছাড়া নতুন মন্ত্রিসভা কত সদস্যের হতে যাচ্ছে বা নতুন কারা মন্ত্রী হতে যাচ্ছেন, সে ব্যাপারে এখনও নির্দিষ্ট করে কিছু জানা যায়নি।
তবে বিগত সরকারের বেশ কয়েকজন প্রতিমন্ত্রী নির্বাচনে জিততে না পারায় এবার মন্ত্রিসভায় বেশকিছু নতুন মুখ যোগ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মন্ত্রিসভার শপথ অনুষ্ঠানের জন্য দেশি-বিদেশি মিলিয়ে প্রায় দেড় হাজার অতিথিকে দাওয়াত দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
নতুন সংসদ সদস্যদের শপথ বুধবার
বুধবার সকাল ১০টায় জাতীয় সংসদের শপথকক্ষে সদ্য বিজয়ী সংসদ সদস্যদের শপথ পাঠ করানো হবে বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন জাতীয় সংসদের বর্তমান স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী।
মিজ চৌধুরী নিজেও এবার রংপুর-৬ আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি প্রথমে নিজে দ্বাদশ সংসদের সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণ করবেন, তারপর অন্যদের শপথ পড়াবেন।
মূলত সংসদ সদস্যদের শপথ গ্রহণের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে শুরু হবে নতুন সরকার গঠনের পর্ব।
মঙ্গলবার বিকেলেই নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নামের তালিকার গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে।
জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে গত সাতই জানুয়ারি ২৯৯ আসনে ভোট হয়েছে। একজন প্রার্থী মারা যাওয়ায় নওগাঁ–২ আসনে ভোট গ্রহণ করা হয়নি।
যে ২৯৯টি আসনে ভোট হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে একমাত্র ময়মনসিংহ-৩ আসনের ফলাফল আটকে আছে।
কাজেই বুধবার ২৯৮টি আসনে নির্বাচিত নতুন জনপ্রতিনিধিদেরকেই শপথ পড়ানো হবে।
প্রথম দিকে জাতীয় পার্টির সদস্যরা বুধবার শপথ নেবেন কিনা, এ নিয়ে কিছুটা সংশয় ছিল।
তবে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের সন্ধ্যায় বিবিসি বাংলাকে নিশ্চিত করেছেন, তার দলের সবাই বুধবার শপথ নিচ্ছেন।
ইসির গেজেট
সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই এর ফলাফল গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়।
গেজেটে বিজয়ী জনপ্রতিনিধিদের পিতা-মাতার নাম, ঠিকানা-সহ প্রয়োজনীয় তথ্য থাকে।
মঙ্গলবার দুপুরে নিজেদের বৈঠক শেষে গেজেট প্রকাশের অনুমোদন দেন প্রধান নির্বাচন কমিশার কাজী হাবিবুল আউয়াল।
এরপর বিকেলে গেজেট প্রকাশ করা হয়।
বুধবার সকালে সংসদ ভবনের নিচতলায় ‘শপথ কক্ষে’ নবনির্বাচিতদের শপথ পড়াবেন স্পিকার।
বুধবারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের জন্য ইতিমধ্যেই প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন সংসদের বর্তমান স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী।
“শপথ গ্রহণের জন্য যে ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন, সবই আমরা গ্রহণ করেছি। সব ঠিক থাকলে বুধবার সকালে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে”, বিবিসি বাংলাকে বলেন মিজ চৌধুরী।
আইনে যা আছে
সংবিধান অনুযায়ী, সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলের সরকারি গেজেট প্রকাশের পর নতুন নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ পড়ান স্পিকার।
গেজেট প্রকাশের তিন দিনের মধ্যে যদি স্পিকার সংসদ সদস্যদের শপথ পাঠ পরিচালনা করতে না পারেন, তাহলে এর পরবর্তী তিন দিনের মধ্যে শপথ পড়াবেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার।
এক্ষেত্রে কোনও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর সংসদের প্রথম বৈঠকের তারিখ থেকে ৯০ দিনের মধ্যে তিনি শপথ না নিলে তার আসন শূন্য ঘোষণা করা হবে।
তবে এই ৯০ দিনের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে স্পিকার যথার্থ কারণে তা বাড়াতে পারবেন।
গত সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়েও নির্ধারিত এই সময়ের মধ্যে শপথ না নেওয়ায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের আসনকে শূন্য ঘোষণা করা হয়েছিল।
শপথ গ্রহণের পর যা হবে
বিএনপিবিহীন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে নির্বাচিত হয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটি মোট ২২২টি আসনে জয়লাভ করেছে।
এরপর সবচেয়ে বেশি আসন পেয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। তারা ৬২টি আসনে বিজয়ী হয়েছেন।
এছাড়া জাতীয় পার্টি ১১টি আসনটি আসনে এবং ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও কল্যাণ পার্টি একটি করে আসনে জয় পেয়েছে।
রেওয়াজ অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের সদস্যরাই প্রথমে শপথ নেবেন। এরপর ক্রমানুসারে অন্যরাও শপথ নেবেন ।
শপথ শেষে নতুন সংসদ সদস্যরা সংসদ সচিবের কার্যালয়ের স্বাক্ষর খাতায় সই করবেন এবং একসঙ্গে তাদের ছবি তোলা হবে।
সংসদ সদস্যদের শপথ গ্রহণের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে শুরু হবে নতুন সরকার গঠনের পর্ব।
এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাকে সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানাবেন। এরপর বঙ্গভবনে নতুন মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের আয়োজন করা হবে।
এর আগে, একাদশ সংসদ নির্বাচন হয়েছিল ২০১৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বর। এরপর ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই গেজেট প্রকাশ করা হয়।
এরপর ২০১৯ সালের ১লা জানুয়ারি শপথ নেন নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যরা। আর ৩রা জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানান।
নতুন সংসদে বিরোধী কারা?
সংসদ নির্বাচনে যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পায়, তারা সরকার গঠন করে। আর যারা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসনে জয়লাভ করে, তারাই সাধারণত সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।
বাংলাদেশে এবারের জাতীয় নির্বাচনে ২২২টি আসনে জয় পেয়ে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ।
তাদের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৬২টি আসনে জয় পেয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা, যাদের অধিকাংশই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেরই নেতা।
অন্যদিকে, গত সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি পেয়েছে মাত্র ১১টি আসন।
ফলে এবারের সংসদে কারা প্রধান বিরোধী দল হতে যাচ্ছে, সেটি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে বেশ আগ্রহ তৈরি হয়েছে।
তবে এবার সংসদের বিরোধী দল হওয়ার ক্ষেত্রে বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বড় ভূমিকা থাকবে বলে মনে করছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
“তারা কতজন কোথায় থাকতে যাচ্ছেন, কতজন স্বতন্ত্র থাকতে যাচ্ছেন- এই বিষয়গুলো যখন পরিষ্কার হবে, তখনই বোঝা যাবে কারা বিরোধী দল হবে”, মঙ্গলবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন মি. হক।
দলের নেতা হলেও নৌকা প্রতীকের বাইরে যারা নির্বাচিত হয়েছেন, তারা কেউই আওয়ামী লীগের প্রার্থী নয় বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী। কাজেই বিজয়ী স্বতন্ত্রপ্রার্থীরা চাইলে মোর্চা গঠন করে বিরোধী দল হতে পারবেন বলে মনে করছেন তিনি।
“তারা আওয়ামী লীগের, এটা মুখের কথা হতে পারে, কিন্তু আইনের কথা, বাস্তবতার কথা তা নয়। তারা স্বতন্ত্র হিসেবে জয়ী হয়েছেন। তারা যদি মনে করেন, স্বতন্ত্র হিসেবেই থাকবেন, তখন দেখা হবে, কতজন স্বতন্ত্র হিসেবে থাকলেন। আর যদি দেখা যায়, তারা একটি মোর্চা করবেন, তখন বিরোধী দল কারা হবে, সেটি পরিষ্কার হবে।”