শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অসহযোগিতা, সাংগঠনিক দুর্বলতা-সহ নানা কারণ দেখিয়ে সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবির জন্য জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব পরিবর্তনের দাবি জানাচ্ছেন দলের এক শ্রেণীর নেতা-কর্মী। এমন কী নেতৃত্ব পরিবর্তনের জন্য ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটামও দিয়েছেন তারা, যদিও দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, “এমন দাবি তোলার নৈতিক ও গঠনতান্ত্রিক কোনও অধিকারই তাদের নেই!”
“গঠনতান্ত্রিকভাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া”র কথাও জানিয়েছেন তিনি। যদিও বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরা চাইছেন দলের শীর্ষ নেতারা ব্যর্থতার দায় নিয়ে পদত্যাগ করুন।
বৃহস্পতিবার দলটির মহাসচিব মজিবুল হক চুন্নু বাংলাদেশের কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিকদের এক ব্রিফিংয়ে বলেছেন, “তবে যে কোনও কর্মী জি এম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির বাইরে গিয়ে আরেকটা পার্টি করতে চাইলে আমরা বাধা দিতে পারি না। এই অধিকার তাদের আছে।”
“কিন্তু জাতীয় পার্টি জি এম কাদেরের নেতৃত্বে আছে, এর ক্ষতি করার কোনও সুযোগ নেই”, মন্তব্য করেন তিনি।
“যারা ইলেকশন করেননি, মনোনয়ন পাননি তারা নির্বাচন যারা বর্জন করেছে তাদের পক্ষে এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে এই কর্মকাণ্ডটি করছে। আমাদের বিতর্কিত করতে তারা এটা করেছে। তাদের বিরুদ্ধে গঠনতান্ত্রিক ভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে” আরও জানান তিনি।
“আমরা কোন শরিক না, জোট বা মহাজোট ও না। আওয়ামী লীগ ২৬টি আসন ছাড় দিয়েছে তাদের স্বার্থে। এসব আসনে দেশের স্বার্থে, দলের স্বার্থে তারা ছাড় দিয়েছে। আমাদের স্বার্থে না”, বলেন মুজিবুল হক চুন্নু।
এসব আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জাতীয় পার্টির বিপরীতে কাজ করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “কাজেই একদিকে ছাড় দিয়েছে, আবার আরেক দিকে ছাড় দেয়নি।”
নির্বাচনে বিপর্যয় হয়েছে স্বীকার করে তিনি জানান , “নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অর্থ, প্রশাসনের সহায়তার কারণে ইলেকশনে সুবিধা করতে পারি নাই এটা সত্য।”
“মোহের বিষয় নাই, দলীয় আইডেন্টিটি নিয়ে আমরা আছি। জনগণের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে, দলের স্বার্থে আমরা জাতীয় সংসদে বিরোধী দল হিসেবে যা যা করার সব করবো।”
“সেখানে কোন আপোষ নাই” বলেও মন্তব্য করেন দলটির মহাসচিব।
জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা দলের বিক্ষুব্ধদের একজন। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “সারা দেশে বিভিন্ন জেলায় নেতা-কর্মীরা বলির পাঁঠা হয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নিজেরা নেগোশিয়েশন করেছে দুই একজনের মধ্যে। আলাপ আলোচনা সেভাবে করেনি।”
“নমিনেশনের পর তারা সাহায্য করেনি। বিভিন্ন জেলায় নেতারা যারা ডিপ্রাইভড হয়েছে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নির্বাচনের আগে তাদের অর্থ দেয়নি, খোঁজ খবর নেয়নি কীভাবে নির্বাচন হচ্ছে।” বলেন মি. হোসাইন।
বুধবার পার্টি অফিসে গিয়েছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, “নেতা হিসেবে তাদের যা করা উচিত ছিলো, চেয়ারম্যান বা মহাসচিবরা তা করেননি।”
এই পটভূমিতে পরবর্তী কী পদক্ষেপ তারা নেবেন এ বিষয়ে অবশ্য কোনও কথা বলেননি তিনি।
দলীয় সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ আরেকজন নেতা লিয়াকত আলী খোকা।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “নেতৃত্বে যারা ছিলেন তারা ব্যর্থ। কারণ তারা একেকবার একেক ধরনের সিদ্ধান্ত নেন। একবার যাবে, আরেকবার যাবে না।”
“আওয়ামী লীগের সাথে জোটে যেতে হলেও আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। দলীয় নেতৃত্ব। তারা এ জায়গায় ব্যর্থ”, বলছিলেন তিনি।
“জোটের সিট ছাড়া অন্য সিটে নির্বাচন চলাকালীন পার্টির মহাসচিব ও চেয়ারম্যান সারা দেশের নেতাকর্মীদের সহযোগিতা করেননি। নির্বাচনে নামালো , কিন্তু তারা কোন খোঁজ খবর করেনি। আমি অনেকবার যোগাযোগ করেছি কিন্তু সাড়া পাইনি”, অভিযোগ করেন মি. খোকা।
তিনি মনে করেন অতীতে ‘৯১ সালে যখন জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে হামলা-মামলা হয়, তখনো দলে এমন অবস্থা ছিল না।
“তারা সময়মতো সিদ্ধান্ত নেয়নি, এমন একটা সময় সিদ্ধান্ত হয় যখন নেতাকর্মীরা হতাশ। আমার নামও এলায়েন্স থেকে শেষের দিন উইথড্র করা হয়। ফলে দলীয় নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নিতে একেবারেই ব্যর্থ”, অভিযোগ জানাচ্ছেন তিনি।
“নির্বাচন সুষ্ঠু হলে এলাকায় পাস করবো, সে আশাতেই নির্বাচন করছি। কিন্তু নেতৃত্বের ব্যর্থতায় জাতীয় পার্টির ভরাডুবির জন্য সারা দেশে নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ” যোগ করেন লিয়াকত আলী খোকা।
“জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর কেন্দ্রীয় রাজনীতি করার আগে কোনও অভিজ্ঞতা ছিলো না” উল্লেখ করে তিনি বলেন, “দলের প্রতি যে ফিলিংস, সারা দেশের নেতাকর্মীদের প্রতি তার দুর্ব্যবহারে সবাই কষ্ট পায়। মহাসচিব হিসেবে তিনি ব্যর্থ।”
এ ধরণের পরিস্থিতিতে অনেকে নেতৃত্বও ছেড়ে দেয় বলে ইঙ্গিত করেন তিনি।
লিয়াকত আলী খোকা আরও বলেন, এগারোজন (এমপি) ছাড়া দলের বাকিরা ক্ষুব্ধ। সিদ্ধান্ত নিতে যে রাজনৈতিক দূরদর্শিতা থাকা দরকার তা এখানে হয়নি।
সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা নিজে ঢাকা–৪ আসন থেকে লড়াই করে হেরে যান। তার ওই আসনে জাতীয় পার্টিকে ছাড় দেয়নি আওয়ামী লীগ।
সারা দেশেই জাতীয় পার্টির ক্ষুব্ধ ও হতাশ নেতা-কর্মীরা ইতোমধ্যেই নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ শুরু করেছেন।
“আজকের (বৃহস্পতিবার) মধ্যেই শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কথা বলেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে”, জানাচ্ছেন তিনি।
তবে, দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে একাধিকবার ফোন করলেও রিসিভ করেননি তারা।
এরই মধ্যে বুধবার সাতই জানুয়ারি জাতীয় পার্টির নির্বাচিত ১১জন সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছেন।
গত বছরের ২২শে নভেম্বর নির্বাচনে অংশ নেয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয় জাতীয় পার্টি।
পরে ১৭ই ডিসেম্বরে আসন সমঝোতা করে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে ২৬টি আসন ছেড়ে দেয়। এসব আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।
তবে পরে ওই ২৬টি আসনের বাইরে বিভিন্ন আসনে দলীয় সমর্থন বা সহযোগিতার অভাব, সাংগঠনিক নেতৃত্বে অদক্ষতা, সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচনে যাওয়ার বিপক্ষে থাকা-সহ নানা অভিযোগ এনে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান জাতীয় পার্টির একাধিক প্রার্থী।
কিন্তু, সমঝোতার মাধ্যমে যেসব আসন জাতীয় পার্টির জুটেছিল, সেখানে কেউ সরে না দাঁড়ালেও ভোটে টিঁকতে পারেন নি অনেকেই।
সে সময় যেসব প্রার্থী সরে দাঁড়ান তাদের সম্বন্ধে পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেছিলেন, “কোনও প্রার্থী যদি নির্বাচন করতে না চায় তবে, সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা ওই প্রার্থীর রয়েছে।”
তবে, আওয়ামী লীগের সাথে আসন ভাগাভাগি করলেও জাতীয় পার্টি কোন জোটে নেই।
বাংলাদেশের ৪৪ টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৯টি দল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগই জনসমর্থনে শক্ত ছিলো।
শুরুতে আওয়ামী লীগ সারা দেশে ২৯৮টি আসনে দলীয় মনোনয়ন দিয়েছিলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভোটের মাঠে টিকেছেন তাদের ২৬৩ জন প্রার্থী।
এর মধ্যে ঋণ-খেলাপি ও দ্বৈত নাগরিকত্ব-সহ নানা অভিযোগে পাঁচটি আসনে ওই দলের প্রার্থীদের মনোনয়ন বাতিল হয়েছে।
বাকি ৩২ টি আসন থেকে দলীয় প্রার্থী প্রত্যাহার করে নিয়েছিল আওয়ামী লীগ।
বিএনপির অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের পর জাতীয় পার্টিকেই একমাত্র রাজনৈতিক দল বা প্রতিপক্ষ মনে করেছিলেন অনেকে।
কিন্তু গত দুই জাতীয় নির্বাচনের মতো এবারও আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচনে যায় জাতীয় পার্টি। যা দলের ভেতরেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে।
এছাড়া দলটি এককভাবে খুব বেশি আসন না-পাওয়ায় আদৌ বিরোধী দল হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
যদিও বুধবার শপথ নিয়েই দলটির চেয়ারম্যান বিরোধী দলে থাকার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের অবর্তমানে এবারই প্রথম দলীয় চেয়ারম্যান হিসেবে জি এম কাদেরের নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল দলটি।
২৮৩ আসনে প্রার্থী, ২৬ আসনে সমঝোতা হলেও নির্বাচিত হন দলের মাত্র এগারোজন।
এর আগে, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক দল হিসেবে ২৭টি আসনে জয় পেয়েছিল জাতীয় পার্টি।
২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে জেনারেল এরশাদ প্রাথমিকভাবে অংশগ্রহণ করতে না চাইলেও শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগের সাথে থাকতে হয়েছিল।
এরপর সমঝোতার মাধ্যমে ২০১৪ সালে ২৯টি এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে ২২টি আসনে জয়লাভ করে দলটি।
সে সময় দলটির নেতাদের অনেকের কথায় সেই সমঝোতা নিয়ে অস্বস্তি চাপা থাকেনি। তখন দলটিকে ঘিরে নানা ধরনের তৎপরতাও দেখা গিয়েছিল রাজনৈতিক অঙ্গনে।