প্রথমবারের মতো নাইট্রোজেন গ্যাস ব্যবহার করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দোষী সাব্যস্ত হওয়া এক খুনির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।
এছাড়াও জাপানি এক ব্যক্তিকেও ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আগুন জ্বালিয়ে ৩৬ জনকে হত্যার ঘটনায় তাকে এই শাস্তি দেয়া হয়।
অনেক দেশ মৃত্যুদণ্ডের বিধান বাতিল করলেও বিশ্বব্যাপী এই সর্বোচ্চ শাস্তি কার্যকরের সংখ্যা বাড়ছে।
যে কারণে নাইট্রোজেন গ্যাস ব্যবহার করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর
শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামাতে কেনেথ ইউজিন স্মিথ নামে এক ব্যক্তিকে প্রথমবারের মতো নাইট্রোজেন গ্যাস ব্যবহার করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।
এর আগে, ২০২২ সালের নভেম্বরে প্রাণনাশক ইনজেকশনের মাধ্যমে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সিদ্ধান্ত হয়।
তবে দুই শিরায় ইনজেকশন দেয়ার কথা থাকলেও কারাগারের লোকজন একটি শিরায় সেটি প্রয়োগ করে।
আরেকটি ইনজেকশন দেয়ার ঘণ্টাব্যাপী প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে পরে তা বন্ধ করা হয়।
শেষ পর্যন্ত নাইট্রোজেন গ্যাস দিয়ে সেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
১৯৮৮ সালে একজন যাজকের স্ত্রীকে হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে তাকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয় আদালত।
মি. স্মিথের আইনজীবীরা অপরীক্ষিত এই পদ্ধতিকে “নিষ্ঠুর এবং অস্বাভাবিক” শাস্তি বলে আখ্যায়িত করেছেন।
আলাবামাসহ দেশটির আরও দুইটি রাজ্য মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে নাইট্রোজেন ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে।
সাধারণত এক্ষেত্রে যে প্রাণনাশক ওষুধ ইনজেকশনে ব্যবহার করা হয় সেগুলো পাওয়া কঠিন হয়ে যাওয়ায় এই গ্যাস ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়েছে।
প্রাণনাশক ওষুধের ঘাটতি যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হ্রাসে ভূমিকা রেখেছে।
নাইট্রোজেন গ্যাস দিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা নিয়ে অনেক সমালোচনা রয়েছে। তবে এবারই প্রথম এই পদ্ধতির ব্যবহার করা হলো।
যদিও সময়ের সঙ্গে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড প্রথার জনপ্রিয়তা ক্রমাগত কমছেই, তবু এর ফলে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার মাধ্যম হিসেবে নতুন একটি পথ তৈরি হয়েছে।
বর্তমানে বিশ্বের কয়টি দেশে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর আছে?
মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ২০২২ সালের সবশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী:
• বিশ্বের ৫৫টি দেশে মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে
• এরমধ্যে নয়টি দেশে একাধিক হত্যা বা যুদ্ধাপরাধের মতো গুরুতর অপরাধের জন্যই কেবল মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে
• আর ২৩টি দেশে মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকলেও গত ১০ বছরে তা প্রয়োগ করা হয়নি
প্রতি বছর কত মানুষের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়?
সরকারি পরিসংখ্যান, গণমাধ্যমের প্রতিবেদন, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি এবং তাদের পরিবার ও প্রতিনিধিদের কাছ থেকে নেয়া তথ্যের ভিত্তিতে উপাত্ত তৈরি করে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
সংস্থাটির ধারণা, প্রতি বছর হাজার হাজার অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে এক্ষেত্রে শীর্ষস্থানে আছে চীন। তবে দেশটি যেহেতু এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করে না, তাই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া ব্যক্তিদের নির্ভরযোগ্য সংখ্যা পাওয়াও সম্ভব না।
চীন বাদে ২০২২ সালে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বিশ্বব্যাপী ৮৮৩টি মৃত্যুদণ্ড নথিভুক্ত করেছে, যা ২০১৭ সালের পর সর্বোচ্চ।
তবে এই সংখ্যা ১৯৮৮, ১৯৮৯ বা ২০১৫ সালের পরিসংখ্যানের তুলনায় অনেক কম। এই সালগুলোতে কেবল এক বছরেই ১ হাজার ৫০০ জনেরও বেশি ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল আরও বলছে, ২০২২ সালে ৫২টি দেশে কমপক্ষে ২ হাজার ১৭ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল।
সংস্থাটির বিশ্বাস, ২০২২ সালে বছর শেষে বিশ্বব্যাপী অন্তত ২৮ হাজার ২৮২ জন মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি পেয়েছিল।
অনেক বন্দী তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবার আগে বছরের পর বছর এমনকি কয়েক দশক পর্যন্ত জেলে কাটায়।
কোন দেশ সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে থাকে ?
২০২২ সালে ২০টি দেশ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে, যেখানে ২০২১ সালেই এই সংখ্যা ছিল ১৮।
চীন ছাড়াও সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য দেশের মধ্যে আছে ইরান, সৌদি আরব, মিশর এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
অ্যামনেস্টির তথ্যমতে, ২০২২ সালে ইরানে কমপক্ষে তিনটি মৃত্যুদণ্ড প্রকাশ্যে কার্যকর করা হয়েছে।
এমনকি অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৮ বছরের কমবয়সী অন্তত পাঁচজনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে ইরান।
বিভিন্ন দেশে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সংখ্যা যেভাবে পরিবর্তিত হয়েছে
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনে বিশ্বের ১১টি দেশের কথা উল্লেখ করা হয়েছে যারা প্রতি বছর নিয়মিতভাবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে।
এই তালিকায় রয়েছে চীন, মিশর, ইরান, ইরাক, সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্র, ভিয়েতনাম এবং ইয়েমেন।
উত্তর কোরিয়া “সম্ভবত একটি নির্দিষ্ট হারে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে”- এমন একটি ধারণা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের থাকলেও সংস্থাটি স্বাধীনভাবে তা যাচাই করতে পারেনি।
২০২২ সালে সালে সৌদি আরবে যে পরিমাণে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে তা গেল ৩০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
বাহরাইন, কমোরোস, লাওস, নাইজার এবং দক্ষিণ কোরিয়া – এই পাঁচটি দেশে বেশ কয়েক বছর ধরে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর না করলেও ২০২২ সালে তা করেছে।
২০২১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুদণ্ডের সংখ্যা বাড়লেও ১৯৯০ সালের তুলনায় সেটি অনেক কম।
মাদক-অপরাধে কতজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে?
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্যমতে, ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী মাদক সংশ্লিষ্ট অপরাধে ৩২৫টি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। এরমধ্যে-
• ইরানে ২৫৫টি
• সৌদি আরবে ৫৭টি
• সিঙ্গাপুরে ১১টি
২০২৩ সালে প্রায় ২০ বছরে প্রথম কোনো মহিলার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে সিঙ্গাপুর। ২০১৮ সালে হেরোইন পাচারের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন সেই নারী।
কয়টি দেশ মৃত্যুদণ্ড বাতিল করেছে?
যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, ইতালি, তুরস্ক, নেদারল্যান্ডস, আর্জেন্টিনা পর্তুগাল, ডেনমার্কসহ ১১২টি দেশে মৃত্যুদণ্ডের বিধান একেবারেই তুলে দেয়া হয়েছে। ১৯৯১ সালে এই সংখ্যা ছিল ৪৮।
২০২২ সালে ছয়টি দেশ মৃত্যুদণ্ড সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে বাতিল করে দিয়েছে।
কাজাখস্তান, পাপুয়া নিউ গিনি, সিয়েরা লিওন এবং সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক – এই চারটি দেশ মৃত্যুদণ্ডের বিধান সম্পূর্ণরূপে বাতিল করেছে।
তবে একুয়াটোরিয়াল গিনি এবং জাম্বিয়া শুধুমাত্র গুরুতর অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখেছে।
২০২৩ সালের এপ্রিলে হত্যা এবং সন্ত্রাসসহ ১১টি গুরুতর অপরাধের জন্য বাধ্যতামূলক মৃত্যুদণ্ড বাতিলের পক্ষে ভোট দেয় মালয়েশিয়ার সংসদ।
একই বছর জুলাইয়ে মৃত্যুদণ্ড সম্পূর্ণভাবে বাতিল করার পক্ষে ভোট দেয় ঘানার পার্লামেন্ট।
নাইট্রোজেন গ্যাস দিয়ে কীভাবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়?
আপাতভাবে নাইট্রোজেন বিষাক্ত কোনো গ্যাস নয়। এমনকি বায়ুমণ্ডলের এক-তৃতীয়াংশ জুড়ে আছে এই নাইট্রোজেন গ্যাস।
কিন্তু ঘনীভূত আকারে থাকা অবস্থায় এই গ্যাসে শ্বাস নিলে মস্তিষ্কে অক্সিজেন যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় নাইট্রোজেন হাইপোক্সিয়া।
এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামাসহ তিনটি রাজ্যে এই প্রক্রিয়ায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের বিধান করা হয়েছে।
তবে নাইট্রোজেন ব্যবহার করে ‘অপরীক্ষিত’ ও ‘অপ্রমাণিত’ হওয়ার অভিযোগ আছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ডেথ পেনাল্টি ইনফরমেশন সেন্টারের (ডিপিআইসি) তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৯৯ সালের পর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।
সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক রবিন মেহের বলেন, “আমরা মৃত্যুদণ্ড সমর্থনের বিষয়ে আমেরিকানদের দৃষ্টিভঙ্গিতে একটি বড় পরিবর্তন দেখছি”।
পোলিং সংস্থা গ্যালাপ প্রায় এক শতাব্দী ধরে মৃত্যুদণ্ড নিয়ে জনসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গি ট্র্যাক করছে। তারা বলছে, ৫৩ শতাংশ আমেরিকান খুনের ঘটনায় দোষী সাব্যস্তদের মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে।
এই সংখ্যাটি ৩০ বছর আগের তুলনায় অনেকটাই কম। কারণ সেসময় ৮০ শতাংশ আমেরিকান মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে ছিল ।
মিজ মেহের বলেন, বিভিন্ন অপরাধের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার প্রবণতা কমে গেছে।
“আমি আশা করি এই ধারা অব্যাহত থাকবে”।
মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আরও যত পদ্ধতি
শিরশ্ছেদের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পদ্ধতি চালু আছে কেবল সৌদি আরবে।
তবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি ফাঁসি যেটি বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে প্রচলিত আছে।
এছাড়া প্রাণঘাতী ইনজেকশন প্রয়োগ, গুলি করে এমনকি বৈদ্যুতিক চেয়ারে শক দিয়েও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে থাকে অনেক দেশ।
মৃত্যুদণ্ডের উপাত্ত নিয়ে কাজ করা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ডেথ পেনাল্টি ইনফরমেশন সেন্টারের (ডিপিআইসি) তথ্যমতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামা রাজ্য এবারই প্রথমবারের মতো নাইট্রোজেন গ্যাস ব্যবহার করে কেনেথ স্মিথ নামে একজন দোষী সাব্যস্ত খুনির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে।