পাকিস্তানের রাজনীতি এখন এক এমন অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে যা আগে কখনও দেখা যায়নি। ওই দেশের মানুষের মধ্যে রাজনীতি নিয়ে ক্ষোভ ও হতাশা যেমন আছে, তেমনই তারা আশার আলোর কথাও বলছেন।
২৪ কোটি জনসংখ্যার দেশ পাকিস্তানে এই নিয়ে একটানা তৃতীয়বার সাধারণ নির্বাচন হচ্ছে। সামরিক শাসন ও স্বৈর শাসনের ইতিহাসের নিরিখে দেখতে গেলে এটা সে দেশের জন্য একটা বড় বিষয়।
যদিও পাকিস্তানে আগামী আটই ফেব্রুয়ারির আসন্ন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে সামরিক হস্তক্ষেপে।
সে দেশে এখনও পর্যন্ত এমন কোনও নির্বাচন হয়নি, যা বিতর্ক এড়িয়ে যেতে পেরেছে।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে পাকিস্তানের এক সাবেক প্রধানমন্ত্রী কারাগারে আর আর একজন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরেছেন স্বেচ্ছা নির্বাসন শেষে।
পাকিস্তানে এই রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে দীর্ঘদিন ধরে। এই পরিস্থিতিতে সে দেশের ভবিষ্যতের জন্য এই নির্বাচন কেন গুরুত্বপূর্ণ, তা জেনে নেওয়া যাক।
ভারতের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের সীমান্ত ইরান এবং তালেবান-নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তানের লাগোয়া। আমেরিকার আর পাকিস্তানের সম্পর্ক ‘লাভ অ্যান্ড হেট’-এর। পাশাপাশি চীনেরও ঘনিষ্ঠ পাকিস্তান।
ক্ষমতায় আসাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানে নেতাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে গত বছর থেকেই। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে সরিয়ে ২০২২ সালে ক্ষমতায় আসে জোটের সরকার।
এরপর গত বছর অনির্বাচিত ‘কেয়ারটেকার সরকার’ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসে। তাদের তত্ত্বাবধানে গত নভেম্বরের মধ্যে দেশে নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও তা পিছিয়ে যেতে থাকে।
পাকিস্তানের অনেকেই মনে করেন, এই মুহূর্তে সে দেশে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন একটা স্থিতিশীল সরকার, যাতে নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক বিষয়ে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়।
তবে নির্বাচনী দৌড়ে থাকা নেতাদের পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, সেই স্থিতিশীলতা কিন্তু এখনও বেশ দূরে।
নওয়াজ শরিফ, পিএমএল (এন)
পাকিস্তানে আবারও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন নওয়াজ শরিফ। তবে, ২০১৮ সালের নির্বাচনে তিনি প্রার্থী ছিলেন না। সে সময় তিনি জেলে ছিলেন।
কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় সে বছর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেননি।
শারীরিক সমস্যার কারণে ২০১৯ সালে চিকিৎসার জন্য তিনি লন্ডনে যান। নিজের দেশে ফিরে আসেন গত বছর। এর মাঝে, ২০২২ সালে ইমরান খান ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর নওয়াজ শরিফের ভাই শাহবাজ শরিফ দেশের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।
নওয়াজ শরিফকে সমস্ত অভিযোগ থেকে মুক্ত করা হয় ২০২৪ সালের নির্বাচনের কয়েক মাস আগে। একই সঙ্গে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়ে তার উপরে থাকা আজীবন নিষেধাজ্ঞাকেও অসাংবিধানিক বলে আখ্যা দেওয়া হয়।
পাকিস্তানের অনেকেই মনে করেন, নওয়াজ শরিফের চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য প্রতিযোগিতায় আসার পথটাকে প্রশস্ত করেছে ইমরান খানের সঙ্গে সেনাবাহিনীর ক্রমবর্ধমান দূরত্ব।
নওয়াজ শরিফ অবশ্য জানেন, সেনাবাহিনীর জন্য কিন্তু পালা বদলে যেতে পারে। তৃতীয় মেয়াদের (২০১৩) সময় থেকে নওয়াজ শরিফের সঙ্গে সেনাবাহিনীর তুমুল টানাপোড়েন শুরু হয়। এবং নওয়াজ শরিফও কিন্তু ক্ষমতা থেকে সরে যান।
এর আগে তার আমলে ১৯৯৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থান হয়।
ইমরান খান, পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ
ক্রিকেট দুনিয়া থেকে রাজনীতিতে আসা পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) ইমরান খান এখন কারাগারে। যদিও তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগকে তিনি ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসা’ এবং ‘ষড়যন্ত্র’ বলে দাবি করেছেন।
তার ক্ষমতায় আসা এবং সরে যাওয়ার গল্প কিন্তু সেই সেনাবাহিনীরই সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালে সমালোচকরা তাকে ‘সামরিক বাহিনীর মুখোশধারী’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। আর এখন তিনি জেলে থাকাকালীন ইমরান খানের সমর্থকরা অভিযোগ করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কারাগারে থাকার পিছনে সেনাপ্রধানই দায়ী।
অন্যদিকে, ২০১৮ সালে ইমরান খানের ভাবমূর্তি তৈরি হচ্ছিল এমন একজন নেতা হিসেবে, যিনি পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ বদলে দিতে পারেন।
ইমরান খান তার ভাষণে রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের অবসান, দুর্নীতিতে যুক্ত নেতাদের জেলে পাঠানো, বিচার ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা, যুবকদের চাকরি দেওয়ার পাশাপাশি অর্থনীতিকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার কথা বলেছিলেন।
কিন্তু তার শাসনকালে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হয়, জিনিসের দাম বেড়ে যায় এবং অনেক বিরোধী নেতাকে জেলে যেতে হয়। গণমাধ্যমের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়, সাংবাদিকদের উপর হামলা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে।
পাকিস্তানের সঙ্গে তালেবানের শান্তি আলোচনায় স্বাক্ষর হোক বা আফগানিস্তানে তালেবান শাসনকে সমর্থন করা, একাধিক বিষয়কে কেন্দ্র করে ইমরান খানকে নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে।
সাম্প্রতিককালে ইমরান খানের জনপ্রিয়তা কমছে, এমনটাই বলেছেন পাকিস্তানের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে। তাদের মতে, জেলের বাইরে থাকলেও ২০২৩ সালে ইমরান খানের পরাজয় নিশ্চিত ছিল।
কিন্তু ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ‘গ্যালপের’ একটা সমীক্ষায় বলা হয়, ইমরান খান এখনও পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা।
তবে গত ছয় মাসে নওয়াজ শরিফের জনপ্রিয়তাও বেড়েছে।
পাকিস্তানে নির্বাচনী প্রচারের জন্য পিটিআইকে ন্যায্য সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না এমন আশঙ্কাও রয়েছে। দলের অনেক বড় নেতা হয় জেলে আছেন কিংবা দলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন।
পিটিআই নেতারা এখন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটে লড়তে বাধ্য হচ্ছেন। এমন কী ক্রিকেট ব্যাটের নির্বাচনী প্রতীকও দলের হাত থেকে চলে গিয়েছে।
বিলাওয়াল ভুট্টো, পিপিপি
গত নির্বাচনে তিন নম্বরে ছিল বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি)। তিনি দলটির চেয়ারম্যান। পাকিস্তানের মন্ত্রীও ছিলেন বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি।
সে দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো ও সাবেক রাষ্ট্রপতি আসিফ আলী জারদারির ছেলে তিনি। ২০০৭ সালে বেনজির ভুট্টোকে হত্যা করা হয়।
বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির দল লম্বা-চওড়া প্রতিশ্রুতি নিয়ে নির্বাচনে নেমেছে। এর মধ্যে রয়েছে দ্বিগুণ বেতন, সরকারি ব্যয় কমানো, বাজেট বাড়ানো-সহ একাধিক বিষয়।
তার দল এই নীতি বাস্তবায়নের সুযোগ পাবে বলে মনে হয় না। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জোট সরকার তৈরি হলে তিনিই ‘কিংমেকার’ হতে পারেন।
বিবিসির সঙ্গে আলাপচারিতায় বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি বলেছিলেন, পিএমএল(এন) ও পিটিআইয়ের মধ্যে কোনও একজনকে বেছে নেওয়াটা বেশ কঠিন।
পাকিস্তানের রাজনীতি যারা কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন, তাদের মতে সেখানে বর্তমান পরিস্থিতি কিন্তু গত ছয় বছরের তুলনায় খুব একটা বদলায়নি।
এবারও কয়েক ডজন প্রার্থীকে ‘অযোগ্য’ ঘোষণা করা হয়েছে। অনেকে জেলে আছেন অথবা বাধ্য হয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন না।
পাকিস্তানের নাগরিকেরা এম্ন একটা সরকারকে ক্ষমতায় চায় যারা অস্থিতিশীলতা, মুল্যবৃদ্ধি, ভেঙে পড়া অর্থনীতি এবং নিরাপত্তার অবনতি থেকে তাদের রক্ষা করতে পারবে।