বাংলাদেশের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন সময়ে। গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি-সহ আন্তর্জাতিক সংস্থা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য থেকে জানা যায়, বাংলাদেশি মুদ্রায় এই পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ কয়েক লক্ষ কোটি টাকা।
কিন্তু ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে বৈধ পথে বিদেশে অর্থ স্থানান্তর ও মুদ্রা লেনদেনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে কী ধরনের আইন বা বিধি-বিধান রয়েছে?
কেন আর কীভাবে সেগুলোকে পাশ কাটাতে চান পাচারকারীরা?
সম্প্রতি বাংলাদেশের এক সাবেক মন্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল সম্পদ থাকার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ব্লুমবার্গের প্রকাশিত খবর নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার। তারা এ ব্যাপারে অবগত বলে জানান।
সুইস ব্যাংকের ২০১৯ সালের হিসাব অনুযায়ী, সেখানে রাখা ব্যাংকগুলোয় বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ ৫ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা।
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৫ সালে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে মূল্য-জালিয়াতির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ছয় বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়ে গেছে।
তখনকার হিসেবে বাংলাদেশী মুদ্রায় এটি প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ।
ওয়াশিংটন ভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট (আইসিআইজে) বিশ্বজুড়ে বিদেশে টাকা পাচারকারীদের তালিকা প্রকাশ করেছিল। পানামা পেপারস্ বলে পরিচিত লাভ করা সেই নথিপত্রে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশির নামও ছিল।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ বা সিপিডি-র সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “অবৈধ পথে তারাই টাকা পাঠায়, যারা অবৈধ পথে টাকা রোজগার করে। কারণ, ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠাতে গেলে বৈধ আয় দেখানোর বাধ্যবাধকতা আছে।”
সবাই পাচার করছে না বলে মন্তব্য করলেও মি. রহমানের অভিমত, সুইস ব্যাংক কিংবা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির রিপোর্ট থেকেই ধারণা পাওয়া যায়, কোন পথে অর্থ পাঠানোর প্রবণতা বেশি।
বৈধভাবে টাকা পাঠানোর খাত ও প্রক্রিয়া
বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিদের সম্পদ গড়ে তোলার এত এত নজিরের ফলে বোঝা মুশকিল, আদৌ বাংলাদেশিরা বৈধ পথে অর্থ স্থানান্তর করে বিদেশে বিনিয়োগ বা সম্পদ গড়তে পারেন কি না।
এক্ষেত্রে দীর্ঘদিন কঠোর বিধিনিষেধ থাকলেও অর্থনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে গত কয়েক বছরে নীতিমালায় বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছে বাংলাদেশ।
যে সব কারণে বিদেশে অর্থ নেওয়ার প্রয়োজন হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য, বিনিয়োগ, শিক্ষা, চিকিৎসা ও ভ্রমণ।
ব্যক্তি পর্যায়ে অর্থ প্রেরণ বা বহনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন বিধিবিধানে বলা আছে, সার্কভুক্ত দেশ ও মিয়ানমারে ভ্রমণের ক্ষেত্রে উর্ধ্বসীমা বছরে ৫০০০ মার্কিন ডলার। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ভ্রমণের জন্য এই অংক ৭০০০ মার্কিন ডলার।
বিদেশে যাওয়ার সময় কোনও ব্যক্তি বাংলাদেশি মুদ্রায় অনধিক পাঁচ হাজার টাকা সঙ্গে নিতে পারেন। বিদেশ থেকে আসার সময়ও সমপরিমাণ টাকা আনা যায়।
কোনও অনিবাসী অ্যাকাউন্টের টাকা ব্যবহারকারী তার বা পরিবারের সদস্যদের জীবনধারণের প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটাতে অনুমোদিত ডিলার ব্যাংকের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন সাপেক্ষে বিদেশে পাঠাতে পারবেন।
শিক্ষাগ্রহণ এবং চিকিৎসার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় অর্থ নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করে পাঠানো যাবে। এসব ক্ষেত্রে কোনও সীমা উল্লেখ করা হয়নি।
জরুরি আমদানির জন্য অগ্রিম মূল্য প্রেরণের বিধান রাখা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিধিমালায়।
জরুরি আমদানির প্রয়োজনে বিদেশি সরবরাহকারীকে অগ্রিম অর্থ পাঠাতে হলে কোনও ব্যাংক গ্যারান্টি ছাড়াই প্রতি ক্ষেত্রে অনধিক পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার অগ্রিম হিসেবে পাঠানো যায়।
রপ্তানিকারকরা জরুরি উপকরণ আনার প্রয়োজন হলে তাদের বৈদেশিক মুদ্রা রিটেনশন কোটার জমা হতে কোনো ব্যাংক গ্যারান্টি ছাড়াই প্রতি ক্ষেত্রে অনধিক দশ হাজার মার্কিন ডলার অগ্রিম হিসেবে বিদেশে পাঠাতে পারেন।
আইটি বা সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বিশেষ বৈদেশিক মুদ্রা কোটা রয়েছে।
এ খাতের রফতানিমুখী প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিক বৈদেশিক মুদ্রা রিটেনশন কোটা সুবিধার অতিরিক্ত আরও ২০ হাজার মার্কিন ডলার অনুমোদিত ডিলার ব্যাংক থেকে কিনতে পারবে।
নীতিমালা যে কেউ কেউ মেনে চলেন, তার উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের একটি গ্রুপের যথাযথ অনুমোদন নিয়ে ইথিওপিয়ায় বিনিয়োগের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন সিপিডি ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।
যে সব শর্তে বিদেশে বিনিয়োগ করা যায়
বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের জন্য বিদেশে তাদের অর্থ বিনিয়োগ করার সুযোগ রয়েছে। যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠান রফতানির সাথে যুক্ত তারা এই বিনিয়োগ করতে পারেন।
তবে এর জন্য সাতটি শর্ত মেনে চলতে হয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অধিশাখার প্রজ্ঞাপন রয়েছে এ বিষয়ে।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বিবিসি বাংলাকে বলেন, কোনও শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে বাইরে বিনিয়োগের অনুমতি দেওয়া হয়। তবে, কোনও সম্পত্তি কেনার জন্য অনুমতি দেওয়া হয় না।
বিনিয়োগের জন্য সরকারের কাছ থেকে ব্যবসায়ীদের অনুমতি নিতে হয়। ব্যবসায়ীদের আবেদন পর্যালোচনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি বা বিডা।
এর জন্য গভর্নরের নেতৃত্বে ১৫ সদস্যের একটি কমিটি কাজ করে।
এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি কোম্পানি এ ধরনের অনুমোদন পেয়েছে বলে জানা গেছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের তরফ থেকে সুনির্দিষ্ট সংখ্যা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বিবিসিকে জানান, বিদেশে প্রেরিত অর্থের ব্যাপারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে হালনাগাদ তথ্য পেয়ে থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
অনুমতি পাওয়ার পর কোনো কারণে প্রস্তাবিত বিনিয়োগ শেষ পর্যন্ত না হলে প্রদত্ত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনতে বলা হয়েছে এ সংক্রান্ত নীতিমালায়।
সঠিকভাবে মনিটর না করা গেলে এর মধ্য দিয়েও অর্থ পাচারের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে বলে বিবিসি বাংলাকে নীতিমালা ঘোষণার পরই জানিয়েছিলেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ সিপিডি’র গবেষণা পরিচালক গোলাম মোয়াজ্জেম।
এর আগে কোনও কোনও প্রতিষ্ঠান বিদেশে বিনিয়োগ করলেও এ বিষয়ে কোনও নীতিমালা বা বিধিমালা বাংলাদেশে ছিলো না। সাধারণত কোন প্রতিষ্ঠান আবেদন করলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেটি যাচাই বাছাই করে সিদ্ধান্ত জানাত।
নীতিমালায় বিনিয়োগ গন্তব্যের ব্যাপারে শর্ত দেওয়া আছে। বলা হয়েছে, বিনিয়োগ করতে হবে এমন দেশে যেখানে বাংলাদেশের নাগরিকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে। একই সাথে, সে সব দেশেই লগ্নি করা যাবে যেখান থেকে ব্যবসায় অর্জিত অর্থ বাংলাদেশে ফেরত আনতে কোনও বিধিনিষেধ নেই।
এছাড়া যে সব দেশের সাথে দ্বৈত কর পরিহার চুক্তি আছে এবং যেসব দেশের সাথে বাংলাদেশ সরকারের দ্বিপাক্ষিক পুঁজি-বিনিয়োগ, উন্নয়ন, সম্প্রসারণ ও সংরক্ষণ চুক্তি আছে সে সব দেশেও অর্থ লগ্নি করতে পারবেন উদ্যোক্তরা।
এই প্রক্রিয়ায় কোনও বিনিয়োগকারী বিনিয়োগের আয় ও লভ্যাংশ দেশে আনতে ব্যর্থ হলে সেটি অর্থ পাচার ও মানি লন্ডারিং হিসেবে বিবেচিত হবে।
জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অফিস অব ফরেন অ্যাসেট কন্ট্রোলের পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা থাকলে সেই দেশে বিনিয়োগ করতে পারবেন না বাংলাদেশিরা।
বাংলাদেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই এমন সব দেশের ক্ষেত্রেও একই বিধান প্রযোজ্য হবে।
বিনিয়োগের যোগ্যতা ও সীমা
প্রজ্ঞাপনে কারা বিদেশে বিনিয়োগে যোগ্য বলে বিবেচিত হবে তা উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছে। এগুলো হলো:
১. রফতানিকারকের সংরক্ষিত কোটা হিসেবে পর্যাপ্ত স্থিতি আছে এমন রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান।
২.আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানকে পাঁচ বছরের নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণী অনুযায়ী সচ্ছল হতে হবে।
৩. আবেদনকারীর ক্রেডিট রেটিং অন্তত দুই হতে হবে।
৪. যে ব্যবসায় বিনিয়োগ করা হবে সেটি বাংলাদেশে আবেদনকারীর ব্যবসায়িক কার্যক্রমের অনুরূপ বা সহায়ক বা সম্পূরক হতে হবে।
৫. বিনিয়োগ প্রস্তাবটির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের ভিত্তিতে টেঁকসই হতে হবে।
৬. বাংলাদেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রায় আয় অর্জনের সম্ভাবনাময় উৎস এবং বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি বৃদ্ধিসহ অন্য সুযোগ সুবিধা সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকতে হবে। বিশেষ করে বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থানের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব থাকতে হবে।
৭. আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানের আন্তর্জাতিক ব্যবসা পরিচালনা, অর্থায়ন ও বিনিয়োগে দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনবল থাকতে হবে।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে বিনিয়োগের জন্য আবেদনকারী প্রতিষ্ঠান তার বিগত পাঁচ বছরের বার্ষিক গড় রফতানি আয়ের অনধিক ২০ শতাংশ বা সর্বশেষ নিরীক্ষিত বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনে দেখানো নিট সম্পদের ২৫ শতাংশ হবে বিনিয়োগের সীমা।
তবে এ দুটির মধ্যে যেটি কম সেটুকুই বিনিয়োগের আবেদন করা যাবে।
নীতিমালার আওতায় বাংলাদেশি কোম্পানিগুলো বিদেশে তাদের শাখা অফিস স্থাপন ও পরিচালনা করতে পারবে।
অর্থবছর শেষের ৩০ দিনের মধ্যে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক বিবরণী বাংলাদেশ ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে পাঠাতে হবে।