ভারতের তামিলনাড়ু এবং পন্ডিচেরীতে ক্ষতিকারক রং ব্যবহারের কারণে সম্প্রতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে হাওয়াই মিঠাই। পরীক্ষা করে দেখা গেছে হাওয়াই মিঠাই রঙিন করে তুলতে ব্যবহার করা হয় ‘রোডামাইন বি’ নামক একটি রাসায়নিক দ্রব্য। মূলত কাপড় রং করার জন্য ব্যবহার করা হয় ওই পদার্থ।
প্রথমে পন্ডিচেরী এবং পরে তামিলনাড়ুতে সরকারী বিবৃতি জারি করে বলা হয়, স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ রোডামাইন বি-এর উপস্থিতি প্রমাণ মেলার কারণে নিষিদ্ধ করা হয়েছে হাওয়াই মিঠাই।
অভিভাবকদের এ বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে। একইসঙ্গে হাওয়াই মিঠাই-সহ যে সমস্ত খাবারে ওই রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়েছে তার বিক্রি বন্ধ করতেও বলা হয়েছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বহুল জনপ্রিয় এই মিঠাই। রঙ বেরঙের এই খাবার হাওয়াই মিঠাই, বুড়ির চুল (আকারের কারণে), কটন ক্যান্ডি বা ক্যান্ডি ফ্লস নামেও পরিচিত।
কেন নিষিদ্ধ করা হয়েছে?
পন্ডিচেরী খাদ্য সুরক্ষা দফতরের আধিকারিকরা অভিযান চালিয়ে রাস্তায় বিক্রি হওয়া হাওয়াই মিঠাইয়ের নমুনা ল্যাবরেটারিতে পরীক্ষা করতে পাঠান।
নমুনাগুলি পরীক্ষা করে জানানো হয়েছে, হাওয়াই মিঠাই রাঙাতে যে রং ব্যবহার করা হয়েছে তা ‘নিম্নমানের’ এবং ‘ক্ষতিকারক’। যে রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে ওই খাদ্য দ্রব্যে তা হল রোডামাইন বি।
পন্ডিচেরীর লেফটেন্যান্ট গভর্নর তামিলিসাই সৌন্দরাজান একটি বিবৃতি জারি করে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন ওই ক্ষতিকারক রাসায়নিকে রাঙানো মিঠাই।
তিনি জানিয়েছেন যে বিক্রেতার কাছ থেকে ওই ক্ষতিকারক রাসায়নিক ব্যবহার করে তৈরি হাওয়াই মিঠাই বা অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য পাওয়া যাবে তাদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এরপর তামিলনাড়ুতেও একই ভাবে অভিযান চালিয়ে নমুনা সংগ্রহ করেন খাদ্য সুরক্ষা দফতরের কর্মকর্তারা। যাদের কাছ থেকে ওই নমুনা নেওয়া হয়েছিল তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ক্ষুদ্র বিক্রেতা এবং নথিভুক্ত করা খাদ্যদ্রব্য উৎপাদক ফ্যাক্টরির অন্তর্ভুক্ত নন।
সেই নমুনা পরীক্ষা করেও রোডামাইন বি-এর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
তামিলনাড়ুর স্বাস্থ্যমন্ত্রী মা সুব্রমানিয়ান একটি বিবৃতি দিয়ে বলেন, “হাওয়াই মিঠাই খেতে খুব সুস্বাদু হলেও রোডামাইন বি ব্যবহারের কারণে তা শরীরের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকারক। আমি অভিভাবকদের অনুরোধ করব বাচ্চাদের এর থেকে দূরে রাখতে।”
“ফুড সেফ্টি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ড আক্টস ২০০৬ অনুযায়ী ওই দ্রব্য (রোডিয়াম বি) আছে এমন খাবার প্যাকেজিং, আমদানি, বিক্রি, বিয়ে এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানে পরিবেশন করা আইনত অপরাধ।”
দিন কয়েকের মধ্যে অন্ধ্রপ্রদেশ সরকারও হাওয়াই মিঠাইয়ের নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে খাবারের সঙ্গে রোডামাইন বি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক এবং দীর্ঘদিন ধরে এই রাসায়নিক দ্রব্য শরীরে প্রবেশ করলে তা ক্যান্সারের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিতে পারে।
রোডামাইন কী?
রোডামাইন বি একটি রাসায়নিক দ্রব্য এবং রঞ্জক।
“এটি সহজে জলে দ্রব্য বলে রোডামাইন বি কাপড়, কাগজ, রঙ এবং চামড়া-জাত দ্রব্য তৈরির কারখানায় ব্যবহার করা হয়। রোডামাইন বি-এর সঙ্গে কুইনাক্রিডোন ম্যাজেন্টার সঙ্গে মিশিয়ে গোলাপি রং তৈরি করা হয়,” বলেছেন রসায়নের শিক্ষিকা নেহা সিংহ।
বুড়ির চুল বা হাওয়াই মিঠাইকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য ব্যবহার করা হয় রঙ। অন্যান্য ‘ফুড কালারের’ তুলনায় স্বল্পমূল্য হওয়ার কারণে রোডামাইন বি ব্যবহার করা হয় রঞ্জক হিসাবে।
রোডামাইন বি-এর মানুষের শরীরে প্রভাবের কথা বলতে গিয়ে এ নিয়ে গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেছেন তিনি।
তার কথায়, “রয়্যাল কেমিস্ট্রির একটি জার্নালে বলা হয়েছে ক্রমাগত রোডামাইন বি- যুক্ত খাবার খেলে তা প্রভাব ফেলে মানুষের লঘুমস্তিষ্কে এবং লিভারে। ওই প্রভাব ক্যান্সারাস। এছাড়াও এর ফলে একাধিক শারীরিক সমস্যা দেখা যায়। তামিলনাড়ু এবং পন্ডিচেরীতে যে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে, আমি মনে করি তা পুরো দেশে চালু করা উচিৎ।”
চিকিৎসকরা কী বলছেন?
ইউরোপ এবং আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়াতে রোডামাইন বি নিষিদ্ধ।
এএমআরআই হাসপাতালের ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ তন্ময় মণ্ডল বলেন, “রোডামাইন বি মূলত কাপড় ডাই করতে ব্যবহার করা হয়। পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে এটা লিভার ইনজুরি ঘটাতে পারে। পরবর্তী ক্ষেত্রে তা থেকে লিভার ক্যান্সার হতে পারে।”
তিনি জানিয়েছেন একদিনে ওই রাসায়নিক দ্রব্যের প্রভাব দেখা যায় না।
মি. মণ্ডলের কথায়, “একদিনে এর প্রভাব দেখা যায় না। দীর্ঘদিন ধরে রোডামাইন বি মিশ্রিত খাবার খেলে বা এক সঙ্গে অনেকটা পরিমাণ শরীরে প্রবেশ করলে তার ক্ষতিকারক প্রভাব দেখা যায়।”
এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে হাওয়াই মিঠাই-সহ অন্যান্য যে সমস্ত খাবারে ক্ষতিকারক রঙ ব্যবহার করা হয় তার প্রসঙ্গও আসে।
ওই চিকিৎসক বলেন, “কটন ক্যান্ডি রোজ খাওয়া হয় এমনটা নয়। তাই হয়ত এ বিষয়ে অতটা বেশি আলোচনা হয়নি। এমন অনেক খাবার দৈনন্দিন জীবনে আমরা খেয়ে থাকি যেখানে ক্ষতিকারক রঙ ব্যবহার করা হয়। আমাদের সে বিষয়েও সতর্ক হতে হবে।”
একই কথা জানিয়েছেন চিকিৎসক ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ রুকায়া মীর। দিল্লির অ্যাপোলো হাসপাতালের ওই চিকিৎসক বলেন, “মূলত দুই ধরনের রঙ খাবারে ব্যবহার করা হয়- ভেষজ বা কৃত্রিম ভাবে তৈরি। পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে কৃত্রিম ভাবে তৈরি রঙ শরীরের পক্ষে ভাল নয়। এর বিভিন্ন ক্ষতিকারক প্রভাব রয়েছে।”
খাবার কতটা স্বাস্থ্য সম্মত ভাবে বানানো হয় বা খাদ্যদ্রব্যে যে রঙ-সহ বিভিন্ন উপাদান ব্যবহার করা হয় তা কতটা ক্ষতিকারক সে নিয়ে একাধিকবার প্রশ্ন উঠেছে।
“আজকাল রসগোল্লাও বিভিন্ন রঙের পাওয়া যাচ্ছে। খাদ্যদ্রব্য রঙিন করে তুলতে যে এজেন্ট ব্যবহার করা হয় তার মধ্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষতিকারক। হাওয়াই মিঠাইয়ের পাশাপাশি অন্যান্য খাবারও পরীক্ষা করে দেখা উচিৎ যেগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই আমরা দৈনন্দিন জীবনে খেয়ে থাকি,” বলেছেন ডাঃ তন্ময় মণ্ডল।
‘শিশুদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে’
বাজারে যে খাদ্যদ্রব্য পাওয়া যায় তাতে ব্যবহার করা ‘ফুড কালারের’ মধ্যে বেশিরভাগই ‘ফুডসেফ্টি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ডস অথরিটি অফ ইন্ডিয়া’ দ্বারা অনুমোদিত নয়। অনেক ক্ষেত্রে সস্তা ‘এজেন্ট’ ব্যবহার করা হয় খাবারে রঙ আনার জন্য।
এএমআরআই হাসপাতালের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ মণিদীপা দত্ত বলেন, “রোডামাইন বি-এর মতো অনেক এজেন্ট রয়েছে যা খাদ্যদ্রব্যে ব্যবহারের জন্য অনুমোদিত নয়। রোডামাইন বি স্টমাক বা লিভার ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। ব্রেনের ক্ষতিও করতে পারে।”
“যে সময়ে একটি শিশুর বেড়ে ওঠার সময় তখন কোনও ক্ষতি কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী হতে পারে। তাই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। বায়না করলেও শিশুদের দূরে রাখতে হবে সেই সব খাবার থেকে যাতে ক্ষতিকারক রঙ ব্যবহার হয়,” বলেন মি. দত্ত।