বাংলাদেশের নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের জামিনকে ঘিরে রোববার সারাদিনই আদালতে বিদেশি কূটনীতিকদের উপস্থিতি ছিলো চোখে পড়ার মতো।
সকাল থেকেই অধ্যাপক ইউনূসের দুটি মামলার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল ও মহানগর দায়রা জজ আদালতে বাংলাদেশে অবস্থিত বিভিন্ন দূতাবাসের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের চারজন প্রতিনিধিকে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে দেখা যায় এ দিন। এজলাসে বসে জামিন আবেদনের শুনানি পর্যবেক্ষণ করতে দেখা যায় তাদের। তবে গণমাধ্যমের সাথে কোনও কথা বলেননি তারা।
এরপর দুপুরেও বিচারিক আদালতে অর্থপাচার মামলায় ড. ইউনূস-সহ সাতজনের জামিন আবেদনের শুনানিতে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের দুইজন প্রতিনিধি এজলাসে উপস্থিত ছিলেন।
রোববার ঢাকার কাকরাইলে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় ছয় মাসের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ চার আসামির হাজিরার দিন নির্ধারিত ছিলো।
এ দিন জামিনের মেয়াদ বাড়াতে ট্রাইব্যুনালে আসেন ড. ইউনূস-সহ চারজন। আর অর্থপাচার মামলায় তিনি আত্মসমর্পণ করে জামিন নিতে যান ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে।
শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে যা হয়েছে
সকাল দশটা ৪৫ মিনিটে শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় ছয় মাসের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস-সহ চারজন কাকরাইলের শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে হাজির হন।
দশটা ৫০ মিনিটে আদালতের কার্যক্রম শুরু করেন শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের বিচারক এম এ আউয়াল।
এ দিন এ মামলায় জামিনের মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করেন ড. ইউনূস-সহ চারজন। ৩রা মার্চই শেষ হচ্ছে তাদেরকে আগে দেওয়া জামিন।
প্রায় পৌনে এক ঘন্টাব্যাপী শুনানি হয় এ ট্রাইব্যুনালে। অধ্যাপক ইউনূস-সহ চারজনই এজলাসে একই বেঞ্চে বসে শুনানি শুনেন।
তাদের পেছনের দুই সারিতে বিদেশী কূটনীতিকরা বসে মামলার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করেন।
শুনানির শুরুতে অধ্যাপক ইউনূসের আইনজীবী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, “ড. ইউনূস তাকে দেওয়া জামিনের অপব্যবহার করেননি কখনো।”
আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত জামিনের মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করে তিনি বলেন, “ড. ইউনূস পলাতক হবেন এমন মানসিকতা তার নেই।”
“এ ধরনের মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে জামিন পাওয়া তার অধিকার”, বলে শুনানিতে উল্লেখ করেন এই আইনজীবী।
তবে, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান আপিল নিষ্পত্তি পর্যন্ত জামিন দেওয়ার বিরোধিতা করেন। তিনি ড. ইউনূসকে সীমিত সময়ের জন্য জামিন দেয়ার আবেদন করেন।
শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে তিনি জানান, “শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে ড. ইউনূসের ছয় মাসের কারাদণ্ডের রায় স্থগিত করে দেওয়া এই আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে তারা এর আগে রিভিশন আবেদন করেছেন”।
“হাইকোর্ট শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের আদেশ স্থগিত করে দেয়। একইসাথে রুলও দেয়া হয়। ওই রুলের শুনানি হাইকোর্টে ৬ই মার্চ হবে” বলে আদালতকে জানান খুরশিদ আলম খান।
শুনানিতে আদালত বলেন, “নিয়মানুযায়ী বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হলে তা মঞ্জুর করলে সাজা স্থগিত করা হয়। তবে দণ্ড কখনো স্থগিত করা যায় না।”
আদালত এ সময় গণমাধ্যমের সমালোচনা করে বলেন, “ড. ইউনূসকে স্থায়ী জামিন তখন দেওয়া হয়নি। কিন্তু টেলিভিশনে দেখেছি এ ধরনের আদেশের কথা বলা হচ্ছে। এগুলো ক্লিয়ার হওয়া প্রয়োজন।”
পরে উভয়পক্ষের শুনানি শেষে ড. ইউনূসসহ চার জনের জামিনের মেয়াদ বাড়ায় শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল।
তবে কত তারিখ পর্যন্ত এ জামিনের মেয়াদ, পরে তা জানানো হবে বলে উন্মুক্ত আদালতে বলেন বিচারক এম এ আউয়াল।
একইসাথে ১৬ই এপ্রিল এ মামলার পরবর্তী শুনানির দিন নির্ধারণ করা হয়।
এ দিন অধ্যাপক ইউনূসের মামলার বিচারিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে বেশ কয়েকটি দূতাবাসের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
এদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা কাকরাইলের শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে আসেন।
আদালতের এজলাসে উপস্থিত থেকে তাদের প্রায় পৌনে একঘন্টার শুনানি পর্যবেক্ষণ করতে দেখা যায়। তবে গণমাধ্যমের সাথে কোনও কথা বলেন নি তারা।
এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, মানবাধিকার কর্মী শারমিন মুরশিদকেও আদালতের এজলাসে দেখা যায়।
আদেশের পর অধ্যাপক ইউনূস ন্যায় বিচার পাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
তিনি বলেন, “আইনি প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকুক, এর মধ্যেই আমরা আমাদের কাজগুলো করছি। বিচারিক প্রক্রিয়ায় ন্যায় বিচার পাওয়া যাবে।”
গত পহেলা জানুয়ারি এ মামলায় মুহাম্মদ ইউনূসসহ চারজনকে ছয় মাসের কারাদণ্ড ও ৩০ হাজার টাকা করে জরিমানা করে ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালত।
শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে ২০২১ সালের নয়ই সেপ্টেম্বর মামলাটি করেছিল কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর।
এ মামলার অভিযোগের মধ্যে রয়েছে, অনিয়মের মাধ্যমে শ্রমিক কর্মচারীদের মধ্যে বণ্টনের জন্য সংরক্ষিত লভ্যাংশের পাঁচ শতাংশ না দেওয়া এবং ১০১ জন শ্রমিকের চাকরি স্থায়ী না করা।
এছাড়া গণছুটি না দেয়া, শ্রমিকদের কল্যাণ তহবিল এবং অংশগ্রহণ তহবিল গঠন না করাও অন্যতম অভিযোগ এই মামলার।
পরে ২৮শে জানুয়ারি এ রায়ের বিরুদ্ধে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে আপিল করা হলে শুনানির জন্য তা গ্রহণ করা হয়। একই সাথে তাদের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দেয় ট্রাইব্যুনাল।
রোববার এই জামিনের মেয়াদ বাড়ানোর আদেশ দেয় শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল।
অর্থপাচার মামলায় শুনানি
শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল থেকেই দুর্নীতি দমন কমিশনের করা অর্থপাচার ও আত্মসাতের মামলায় আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করতে বিচারিক আদালতে যান ড. মুহাম্মদ ইউনূস-সহ অন্যান্যরা।
এ মামলায় দুদক ২৫ কোটি ২২ লাখ টাকার বেশি অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ এনেছে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস-সহ মোট ১৪ জনের বিরুদ্ধে।
গত বছরের ৩০শে মে গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক – কর্মচারী কল্যাণ তহবিল থেকে এ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার মামলাটি করেন। গত পহেলা ফেব্রুয়ারি অভিযোগপত্র দেয় দুদক।
এই মামলায় আত্মসমর্পণ করতে দুপুর দুইটা বিশ মিনিটে মহানগর সিনিয়র স্পেশাল বিচারক আস সামছ্ জগলুল হোসেনের আদালতে হাজির হন ড. ইউনূস-সহ অন্যান্যরা।
এ সময় আদালতকক্ষে প্রচুর ভিড় ছিলো।
আইনজীবী আব্দুল্লাহ আল মামুন শুনানিতে ড. ইউনূস-সহ সাতজন আত্মসমর্পণ করেছেন উল্লেখ করে জামিন আবেদন করেন। তবে, দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল এ জামিন আবেদনের বিরোধিতা করেন।
তিনি বলেন, “গ্রামীণ টেলিকমের কর্মচারীদের পাওনার লভ্যাংশ বিতরণে শ্রমিক ইউনিয়ন ও গ্রামীণ টেলিকমের মধ্যে ২০২২ সালের ২৭ এপ্রিল একটি সমঝোতা চুক্তি হয়।”
“ওই বছরের ৮ই মে ব্যাংক হিসাব খোলা হয়, যা বাস্তবে অসম্ভব। কাগজপত্র নকল করে এটা করা হয়েছে। কারণ আগে ব্যাংক একাউন্ট করতে হবে, পরে চুক্তি। ৪৩৭ কোটি টাকা এভাবে হস্তান্তর হয়েছে। ১৬৪ শ্রমিককে ২৬ কোটি টাকা না দিয়ে তা আত্মসাৎ ও পাচার করা হয়েছে”, বলেন মি. কাজল।
প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে এই জামিন আবেদন নিয়ে শুনানি হয়। পরে উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আদালত জামিন দেয় ড. ইউনূস-সহ সাত জনকে।
বাকি সাতজনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে।
এ মামলায় আগামী ২রা এপ্রিল অভিযোগপত্র গ্রহণ করা হবে কি না সে বিষয়ে শুনানির দিন ঠিক করেছে আদালত।
এটিই ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের একমাত্র মামলা।
এ মামলায় জামিন পাওয়ার পর তিনি সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আদালতের এখানকার ছবি তুলে রাখুন। এটা যুগ যুগ ধরে নানা বইতে প্রকাশিত হবে। আপনারা ইতিহাসের সাক্ষী।”
“এটা একটা ঐতিহাসিক ঘটনা। একজন নোবেল বিজয়ীর বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ, জালিয়াত, মানি লন্ডারিং-এর অভিযোগ আনা হয়েছে। আরো সাতজন আছে। এ বিচার শুধু দেশের মধ্যে নয়, সারা দুনিয়া লক্ষ্য করছে কী বিচার হচ্ছে। এটা জাতির ইতিহাসের অংশ হয়ে যাচ্ছে”, বলেন ড. ইউনূস।
তিনি আরো বলেন, “এ মামলা গুরুত্বপূর্ণ এ জন্য যে আইন মানুষের শুভকামনা করে রচনা হয়, আইন মানুষের মনে স্বস্তি আনে। আইন মানুষের মনে ভয়ংকর শঙ্কাও জাগায়”।
“এখন আইনকে কোন দিকে নিয়ে যাবে সেটা হলো সমাজের ইচ্ছা। কাজেই দুর্নীতি দমন কমিশন যে বিচারে বসলে তা সঠিকভাবে হয়েছে কি না অথবা এটা ঠিকভাবে হয় নি … এটাই হলো আমাদের দায়িত্ব”, মন্তব্য করেন তিনি।
এই মামলার শুনানি পর্যবেক্ষণ করতেও মহানগর দায়রা জজ আদালতে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশে অবস্থিত যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের প্রতিনিধিরা।
অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে মোট ১৮টি মামলা চলছে।
এসব মামলা স্থগিত ও বিচারিক হয়রানি বন্ধ চেয়ে আন্তর্জাতিক মহল আহ্বান জানিয়ে আসছিলো।
অযথা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে কি না, তা দেখতে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের বাংলাদেশে আসার আহ্বানও জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করে বাংলাদেশে আসতে নোবেল বিজেতারা-সহ মোট ২৪২ জন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব খোলা চিঠিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। পরে ড. ইউনূসের আইনজীবীরা বলেছিলেন, তাদের আসার ব্যাপারটা সরকারের অনুমতির উপর নির্ভর করে।