আসন্ন রমজানের আগে বাংলাদেশে খেজুরের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার পর সরকারের একজন মন্ত্রী ইফতারে খেজুরের পরিবর্ততে বরই খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তার এই বক্তব্য ঘিরে নানা ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও রাজনীতির অঙ্গনে।
গত সোমবার ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানের শেষে শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন সাংবাদিকদের বলেন, “খেজুর নিয়ে আমাদের অভাব অভিযোগ আছে। বরই দিয়ে ইফতার করেন। খেজুর-আঙ্গুর কেন লাগবে?”
ওই দিন বিকেলেই সাবেক তথ্যমন্ত্রী ও জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু রাজশাহীর এক সমাবেশে এই বক্তব্যের জোরালো প্রতিবাদ জানান।
সেখানে তিনি শিল্পমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলেন, “আমি বরই দিয়ে ইফতার করবো, আর তুই খেজুর-আঙ্গুর খাবি? তা হবে না, তা হবে না।”
এমন অবস্থায় ইফতারিতে বরই কী খেজুরের বিকল্প হতে পারে কি না, সেটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই।
পুষ্টিবিদরা কিন্তু বলছেন, সারাদিন রোজা রাখার পর ইফতারিতে খেজুর সবচেয়ে উপকারী। যার সাথে অন্য কোনও খাবার বা ফলের তুলনা চলে না।
তারা আরও বলছেন, ফল কিংবা খাদ্য হিসেবে বরই কখনও খেজুরের বিকল্প হতে পারে না।
বাংলাদেশ-সহ গোটা মুসলিম বিশ্বেই রমজানের ইফতারিতে খেজুর খাওয়ার একটা প্রচলন রয়েছে। যেটিকে সুন্নত হিসেবে বলছেন ইসলামিক চিন্তাবিদরা।
তারা জানাচ্ছেন, মুসলিম সমাজে ইফতারে খেজুর খাওয়ার প্রচলন রয়েছে নবী মুহাম্মদ (সা.) এর অনুসরণেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ইফতারিতে খেজুর খাওয়া মানুষের একটা আধ্যাত্মিক আকাঙ্ক্ষা।”
“কিন্তু এই জিনিসটা এখন আমাদের আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে। ফলে ভোক্তাদের মধ্যে এ নিয়ে অতৃপ্তি, অসন্তোষ ও অস্বস্তির একটা জায়গা তৈরি হয়ে যায়”, বলছিলেন তিনি।
খেজুরের দাম নিয়ে হঠাৎ বিতর্ক
আগামী সপ্তাহের সোমবার কিংবা মঙ্গলবার থেকে শুরু হচ্ছে রমজান মাস।
বাংলাদেশে সারা বছর খেজুরের মোটামুটি চাহিদা থাকলেও রোজার মাসে এর চাহিদা বেড়ে যায় অনেক। এই সুযোগে খেজুরের দাম এবারো আগেভাগে বেড়েছে।
গত বছর বেশ কম দাম দেখিয়ে খেজুর আমদানি করা হয়েছিল বাংলাদেশে। এ কারণে এবার শুল্ক বাড়ানো হয়েছে।
এই শুল্কহার বাড়ানোর কারণ দেখিয়ে একদিকে যেমন খেজুরের দাম বাড়ানো হয়েছে, অন্যদিকে তৈরি করা হয়েছে কৃত্রিম সংকট।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর বলছে, আগে যেখানে প্রতি কেজি খেজুরের দাম ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা ছিল, এখন সেখানে ভালো মানের প্রতি কেজি খেজুর বিক্রি হচ্ছে দেড় থেকে দুই হাজার টাকায়।
এমন অবস্থায় গত সোমবার ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানের শেষে যখন শিল্পমন্ত্রী সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন তখন স্বাভাবিকভাবে তাকে খেজুরের দাম নিয়ে প্রশ্ন করা হয়।
এই প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রী শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন সাংবাদিকদের কাছে ইফতারিতে খেজুরের পরিবর্তে বরই খাওয়ার কথা বলার পর থেকেই এটি নিয়ে সমালোচনা তৈরি হয়।
তিনি তখন বলেছিলেন, “আমাদের বাইরে থেকে খেজুর আমদানি করতে হয়। এখানে কী আছে? বরই দিয়ে ইফতার করেন না কেন? আঙ্গুর লাগবে কেন? আপেল লাগবে কেন? আর কিছু নাই আমাদের দেশে?”
মূলত মন্ত্রীর ঐ বক্তব্যের জের ধরেই রোজার আগে খেজুর নিয়ে এসব আলোচনা চলছে।
তার এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও রাজনৈতিক বক্তারা এটা নিয়ে সমালোচনা করছেন বেশ জোরেশোরে।
ফেসবুকের বিভিন্ন পোস্টে অনেকে লিখেছেন, খেজুরের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে মন্ত্রীরা বেফাঁস মন্তব্য করছেন।
কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করে লিখেছেন, এই বক্তব্যের জেরে বাড়তে পারে বরইয়ের দামও।
ইফতারিতে খেজুর কেন গুরুত্বপূর্ণ?
রমজান মাসে খেজুর কেন খাওয়া হয়? কিংবা খেজুর খেলে কী কী ধরনের উপকার পাওয়া যায় তা নিয়ে বিভিন্ন ধরণের ব্যাখ্যা পাওয়া ইসলামিক চিন্তাবিদ ও পুষ্টিবিদদের কাছ থেকে।
এর ভেতর ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নানা গুরুত্বের কথা বলছেন ইসলামিক চিন্তাবিদরা।
তারা বলছেন, ইফতারিতে খেজুর খাওয়া একটি সুন্নত আমল। তাই খেজুর দিয়ে ইফতার করলে আলাদা সওয়াব পাওয়া যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ইসলামের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) খেজুর খেতেন। এবং তার খেজুরের প্রতি বেশি আকর্ষণের ফলে এটা তখন সবার মাঝখানে বরকতের বিষয় হিসেবে গণ্য হতো।”
“কালের ধারাবাহিকতায় এখনও এটা প্রচলিত রয়েছে। এটা রাসুলের সাথে আমাদের আবেগ ও ভালবাসার একটা সম্পর্ক।”
সুন্নত কিংবা ইসলামিক ঐতিহ্যগতভাবে খেজুরের গুরুত্ব তো আছেই। সেই সাথে খেজুরের পুষ্টিগুণ নিয়েও নানা তথ্য দিচ্ছেন পুষ্টিবিদরা।
তারা বলছেন, প্রচুর পরিমাণ ক্যালরি থাকায় রোজা শেষে ইফতারিতে খেজুর খেলে দ্রুত ক্ষুধা নিবারণ করা যায়। সেই সাথে দ্রুত দুর্বলতাও কেটে যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নাজমা শাহীন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সারাদিন রোজা রাখার পর সুগার লেভেলটা কমে যায়। সেটার জন্য ইমিডিয়েট সুগার সোর্স হিসেবে খেজুরটা তাৎক্ষনিক ভাবে খুব কাজে দেয়।”
পুষ্টিবিদরা বলছেন, প্রতি একশো গ্রাম খেজুরে ৩০১ কিলো ক্যালরি এনার্জি থাকে। সেই সাথে খেজুরে ময়েশ্চার, প্রোটিন কার্বোহাইড্রেট ও ফাইবার, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, কপার ও ভিটামিন থাকে। ফলে সারাদিন রোজা রাখার পরে খেজুর থেকে এক ধরনের বাড়তি এনার্জি পাওয়া যায়।
ডায়েট কাউন্সেলিং সেন্টারের প্রধান পুষ্টিবিদ সৈয়দা শারমিন আক্তার বিবিসি বাংলাকে বলেন, “রোজার মধ্যে সারা দিন পানি খাওয়া হচ্ছে না। সে কারণে নানা সমস্যা হতে পারে। এক্ষেত্রে খেজুর খুব কাজে দেয়।”
“তা ছাড়া আমাদের শরীরে যেহেতু গ্লুকোজটা শর্ট থাকে সে কারণে চিনি দিয়ে শরবত খাওয়ার চেয়ে ভালো হয়, যদি খেজুর খাওয়া যায়।”
মিজ আক্তার আরও বলছেন, “খেজুরে কোনও ফ্যাট নাই। তাছাড়া রোজাদারের সারাদিন যে পুষ্টির ঘাটতি থাকে তা খেজুর খেয়ে পূরণ করা সম্ভব। এমনকি ডায়াবেটিস রোগীরাও খেজুর খেতে পারেন।”
বরই আর খেজুরের তুলনা
খেজুরের দাম বৃদ্ধি ও শিল্পমন্ত্রী ইফতারিতে খেজুরের পরিবর্তে বরই খাওয়ার পরামর্শ দেওয়ার পর এ নিয়ে নানা আলোচনা শোনা যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও রাজনীতির আলোচনায়। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে এবারের রোজার ইফতারিতে বরই কি খেজুরের বিকল্প হতে পারবে?
দেশি ফল বরইয়ের পুষ্টিগুণ ও ইফতারির তালিকায় সেটিকে রাখা নিয়ে কোনও ধরণের সমস্যা দেখছেন না পুষ্টিবিদ ও ইসলামিক আলোচকরা।
তবে তারা বলছেন খেজুরের সাথে যে ধর্মীয় আবেগ ও পুষ্টিগুণের বিষয়গুলো রয়েছে, তা কখনোই বরই দিয়ে পূরণ করা সম্ভব না।
তাদের অনেকেই খেজুর আর বরইয়ের মধ্যে একটিকে অপরটির বিকল্প হিসেবেও মনে করেন না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নাজমা শাহীন বিবিসি বাংলাকে বলেন, পুষ্টিগুণ চিন্তা করলে খেজুর আর বরইয়ে ক্যালরির ডিফারেন্স অনেক বেশি। বরইয়ে ক্যালরির পরিমাণ কম এবং পানির পরিমাণ বেশি থাকে।
এছাড়া অন্যান্য নিউট্রিয়েন্ট বা পৌষ্টিক উপাদানগুলোও বরইতে খেজুরের তুলনায় কম থাকে।
ডায়েট কাউন্সেলিং সেন্টারের প্রধান পুষ্টিবিদ সৈয়দা শারমিন আক্তার বিবিসি বাংলাকে বলেন, “বরইয়ের মধ্যেও অনেকগুলো নিউট্রিয়েন্ট থাকে যেগুলি খুবই ভালো বা উপকারী। তবে যদি বিকল্প হিসেবে চিন্তা করেন তাহলে বরই কখনো খেজুরের বিকল্প না।”
তারা বলছেন, ইফতারিতে খেজুর খাওয়ার বিষয়টা সৌদি আরবে যেমন সহজলভ্য বাংলাদেশে তেমনটা নয়। সৌদির কারণেই বাংলাদেশে ইফতারিতে খেজুর রাখা মুসলমানদের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে, খেজুর যে খেতেই হবে বা বাধ্যতামূলক – ধর্মীয়ভাবে এমন বিষয় নয় বলেও অনেকে জানাচ্ছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “রমজানের ইফতারিতে খেজুর মানুষের মনের একটা আধ্যাত্মিক আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে। যদি সেটা সুলভ হয় তাহলে মানুষের চাহিদাটা মিটে।”
“কিন্তু যখন বাজার দরের ব্যাপারটা মানুষের আয়ত্তের বাইরে চলে যায় তখন মানুষ অস্বস্তি বোধ করে।”
এই খেজুরের বিকল্প হিসেবে বরই খাওয়ার এই বক্তব্য নিয়ে ক্ষোভও প্রকাশ করেন তিনি। অধ্যাপক ইব্রাহিমের মতো আরও অনেকেই বলছেন, “খেজুর বাধ্যতামূলক না হলেও খেজুর ছাড়া রোজার ইফতারি অনেকটা অসম্পূর্ণ মনে হয়।”
অধ্যাপক ইব্রাহিম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমাদের মন্ত্রী বা দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা এসব জিনিসের প্রতি সংবেদনশীল নন বলেই এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে সাধারণ মানুষকে আহত করছেন। অথচ খাদ্যসামগ্রীর দাম মানুষের আয়ত্তের মধ্যে রাখার যে দায়িত্ব, সেটি কিন্তু এড়িয়ে যাচ্ছেন।”