বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের একজন শিক্ষার্থী কুমিল্লায় তার নিজ বাড়িতে আত্মহত্যার পর শুক্রবার রাতেই প্রতিবাদ বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছিলো ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস।
রাত প্রায় আড়াইটা পর্যন্ত ওই ছাত্রীকে ‘আত্মহননে বাধ্য করার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে’ ব্যবস্থা নেয়ার দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ ঘটনায় ওই ছাত্রীর একজন সহপাঠীকে সাময়িক বহিষ্কার ও একজন সহকারী প্রক্টরকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে।
ওই শিক্ষার্থী ফাইরুজ অবন্তিকা আত্মহত্যার আগে এক ফেসবুক পোস্টে তার মৃত্যুর জন্য একজন সহপাঠী ও একজন সহকারী প্রক্টরকে দায়ী করেছেন।
এতে তিনি লিখেছেন ‘আমার উপর দিয়ে কী গেলে আমার মতো নিজেকে এতো ভালোবাসে যে মানুষ সে মানুষ এমন কাজ করতে পারে। আমি জানি এটা কোনো সলিউশন না কিন্তু আমাকে বাঁচতে দিতেসে না বিশ্বাস করেন। আমি ফাইটার মানুষ। আমি বাঁচতে চাইছিলাম… এটা সুইসাইড না, এটা মার্ডার। টেকনিক্যালি মার্ডার’।
তার মা আজ সাংবাদিকদের বলেছেন মূলত ওই সহকারী প্রক্টর আর কয়েকজন সহপাঠীর মানসিক উৎপীড়নের কারণেই আত্মহত্যায় বাধ্য হয়েছে তার মেয়ে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সাদেকা হালিম বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন সুইসাইড নোটে ওই শিক্ষার্থী তার একজন সহপাঠীকে ও বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহকারী প্রক্টরকে অভিযুক্ত করায় শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার ও শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
“দ্রুত এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে,” বলছিলেন তিনি।
তবে অবন্তিকার এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন অভিযুক্ত শিক্ষার্থী ও সহকারী প্রক্টর। অনেক দিন ধরে অবন্তিকার সঙ্গে তাদের কোন যোগাযোগ ছিল না বলে দাবি করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ও সাংবাদিকদের অনেকে জানিয়েছে, ফাইরুজ অবন্তিকা ক্যাম্পাস কেন্দ্রিক বিভিন্ন সংগঠনে সক্রিয় ছিলেন। সম্প্রতি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী খাদিজাতুল কোবরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আটকের পর তার মুক্তির দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন তিনি।
ফেসবুক পোস্ট ও আত্মহনন
শুক্রবার রাত ৯ টা ৫৫ মিনিটে নিজের ফেসবুক পাতায় সুইসাইড নোট পোস্ট করেন ফাইরুজ অবন্তিকা। এরপর কুমিল্লা শহরে নিজের বাড়িতেই আত্মহত্যা করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের এই শিক্ষার্থী।
নিজ রুমের সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই এ ঘটনার খবর ক্যাম্পাসে পৌঁছালে উত্তাল হয়ে ওঠে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। রাত একটা নাগাদ উপাচার্য সাদেকা হালিম ঘটনাস্থলে পৌঁছে অবন্তিকা যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানান।
ফাইরুজ অবন্তিকা তার পোস্টে সহপাঠী রায়হান সিদ্দিকী আম্মানে বিরুদ্ধে যৌন হয়রানিমূলক মন্তব্য করা এবং সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম প্রক্টর অফিসে ডেকে গালিগালাজ করেছেন বলে উল্লেখ করেছেন।
অবন্তিকা তার পোস্টে লিখেছেন ‘আম্মান নামক আমার ক্লাসমেট ইভটিজারটা আমাকে এটাই বলছিল যে আমার জীবনের এমন অবস্থা করবে যাতে আমি মরা ছাড়া কোনো গতি না পাই। তাও আমি ফাইট করার চেষ্টা করসি। এখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে সহ্য ক্ষমতার’।
যদিও মি. ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেছেন দু’বছর আগে সহপাঠীদের একটি অভিযোগের বিষয়ে অবন্তিকা ও তার বাবা-মায়ের সাথে তার কথা হয়েছে।
“তারা তখন আমার অফিসেও এসেছিলেন। এরপর থেকে তাকে কখনোই ডাকিনি এবং এমন কোন আচরণও তার সাথে করিনি,” বলছিলেন তিনি।
অন্যদিকে এ বিষয়ে কথা বলতে রায়হান সিদ্দিকীকে ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করলেও তিনি সাড়া দেননি। তবে এক ফেসবুক পোস্টে তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য দিয়েছেন।
সেখানে বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন, ‘তাকে কোনোভাবেই ডিস্টার্ব করার মতো মানসিকতা আমার কখনোই ছিল না। এই ছিলো পুরো ঘটনা। সে আমাকে ব্লক করে রেখেছিলো। তার সাথে আমি আজকে পর্যন্তও ফেসবুকে বা অন্য কোন মাধ্যমে কথাই বলিনি’।
ঘটনার সূত্রপাত কোথায়
অবন্তিকার মা কুমিল্লায় সাংবাদিকদের বলেছেন, কয়েকজন সহপাঠী ও সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের মানসিক উৎপীড়নের কারণেই তার মেয়ে আত্মহত্যায় বাধ্য হয়েছে।
তবে অভিযুক্ত সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলছেন দু’বছর আগে ফাইরুজ অবন্তিকার সাথে তারই কয়েকজন সহপাঠীর বিরোধ শুরু হয় ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নিয়ে।
এ নিয়ে থানায় একটি জিডিও হয়। পরে উভয় পক্ষকে নিয়ে আলোচনায় বসে বিষয়টি মিটমাট করা হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
যদিও এরপরেও জিডিটি আর তুলে নেয়া হয়নি এবং এ নিয়ে অবন্তিকার বাবা-মাও কয়েকবার এসে প্রক্টর অফিসে অনুরোধ করলেও কাজ হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে অবন্তিকার ঘনিষ্ঠ অনেকে ফেসবুকে লিখেছেন ওই ঘটনার পর থেকে ব্যাপকভাবে মানসিক উৎপীড়নের শিকার হচ্ছিলেন অবন্তিকা।
আইন বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কয়েকজন জানিয়েছেন এরপর থেকে সহপাঠীরা অনেকে তার সাথে বসতো না, কথা বলতো না এমনকি তিনি বুলিংয়ের শিকার হয়ে আসছিলেন। এক পর্যায়ে হল ছেড়ে অন্যত্র আরেক ছাত্রীর সঙ্গে থাকতে বাধ্য হন তিনি।
নাশিয়া জাহিন রোদেলা তার ফেসবুক পাতা (অ্যাস্থেটিক বাই রোদেলা)তে লিখেছেন, “আমার সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বলতো যে, ভার্সিটিতে ওর দম বন্ধ হয়ে আসে। ওরই কিছু সহপাঠী পুরো ব্যাচকে ওর বিরুদ্ধে উস্কায়া দিসে। দিনের পর দিন পুরো ক্লাস এর মানুষ ওর সাথে বসতো না, কথা বলতো না। ওরা চাইছিলো অবন্তী যেন আর কন্টিনিউ করতে না পারে। এরপরেও মেয়েটা মনকে শক্ত করে ক্লাস এ যেতো। ওকে দেখলে লিটারেলি ওর সামনে বুলি করতো, হ্যারেস করতো। পুরোটা ক্লাস”।
গত মাসেই দায়িত্ব নেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রক্টর ডঃ মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলছেন যে ঘটনাটি অনেক পুরনো হওয়ায় এটি তাদের জানা ছিলো না এবং সাম্প্রতিক কালে অবন্তিকা এমন কোন অভিযোগও করেনি।
“তারপরেও পুরনো ফাইল দেখে মনে হচ্ছে যে মানসিক চাপটা সে নিতে পারেনি। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তদন্ত শেষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে,” বলছিলেন মি. হোসেন।