চীন যখন ১৯৭৮ সালে তার অর্থনীতিকে সংস্কার করে উদারনীতি গ্রহণ শুরু করেছিল, তখন থেকেই দেশটির মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি বছরে গড়ে নয় শতাংশের বেশি হারে বৃদ্ধি পেয়ে আসছে।
বিশ্ব প্রবৃদ্ধির চালিকা শক্তিতে পরিণত হওয়া দেশটি শুধুমাত্র ২০২০ সালের করোনা মহামারির সময় মাত্র দুই দশমিক দুই শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল, যা কয়েক দশকের মধ্যে চীনের সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি অর্জনের রেকর্ড।
যদিও এর পরের বছরই দেশটির অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছিল এবং আট শতাংশেরও বেশি প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করেছিল।
কিন্তু ২০২২ সালে এসে আবারও চীনের প্রবৃদ্ধি কমে যায়। সে বছর দেশটির প্রবৃদ্ধি ছিলো মাত্র তিন শতাংশ।
চীন কি তাহলে দীর্ঘমেয়াদী নিম্ন প্রবৃদ্ধির সারিতে ঢুকে গেলো? দেশটির অর্থনীতিতে আসলে ঠিক কী ঘটছে?
বিষয়ে বুঝতে আমরা পাঁচটি মৌলিক প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি।
চীনের অর্থনীতিতে হচ্ছেটা কী?
গত জানুয়ারিতে চীন ঘোষণা করেছে যে, ২০২৩ সালে দেশটি পাঁচ দশমিক দুই শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে।
প্রবৃদ্ধির হার বিবেচনায় বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতির মধ্যে ভারতের পরেই চীনের অবস্থান। যদিও চীনের অর্থনীতি ভারতের চেয়ে পাঁচগুণ বড়।
কিন্তু দেশটির ভিতরে সাধারণ মানষ বিষয়টিকে অন্যভাবে দেখছে। গত পাঁচ বছরের মধ্যে ২০২৩ সালে প্রথম চীন থেকে বিদেশি বিনিয়োগ অন্যত্র চলে যেতে দেখা গেছে।
তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হারে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে, যা গত বছরের জুনের তুলনায় ২০ শতাংশেরও বেশি। এছাড়া চলতি বছরের শুরুতে শেয়ারবাজারের দামেও ধ্বস দেখা গেছে, যা গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
এ অবস্থায় চীনা জনগণের মধ্যে অল্প কয়েকজন বিক্ষুব্ধ ব্যক্তিকে গত বছরের বেশিরভাগ সময়জুড়ে দেখা গেছে যে, তারা চীনে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসের সামাজিক মাধ্যম উইবো অ্যাকাউন্টে গিয়ে নিজ দেশের অর্থনীতিক মন্দার কথা জানিয়ে এসেছে।
তাদের মধ্যে একজন “দীর্ঘদিন ধরে বেকার এবং ঋণগ্রস্ত অবস্থায় আছি” উল্লেখ করে সাহায্যের আবেদন চেয়েছেন।
সামাজিক মাধ্যমটির আরেকটি পোস্টে শেয়ারবাজারের লোকসানের বিষয়ে বলা হয়েছে।
সেখানে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারকে উদ্দেশ্য করে বলছেন যে, “আমাদের কিছু ক্ষেপণাস্ত্র দিন, যাতে আমরা সেগুলো দিয়ে সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জকে উড়িয়ে দিতে পারি”।
যদিও পশ্চিমা গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে যে, ওই সব মন্তব্যগুলোর বেশিরভাগই পরবর্তীতে মুছে দেওয়া হয়েছে।
নেদারল্যান্ডভিত্তিক বহুজাতিক ব্যাংক ‘ইন্টারন্যাশনাল নেদারল্যান্ডস গ্রুপের (আইএনজি) বৃহত্তর চীন অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতিবিদ লিন সঙ বলেন, ”করোনা মহামারি পরবর্তী সময়ে চীনের অর্থনীতি যে তুলনামূলকভাবে ধীরগতিতে এগোচ্ছে, তার একটি কারণ হলো, দেশটি অন্যান্য অনেক দেশের মতো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর লক্ষ্যে অতি-আগ্রাসী কোনো নীতি গ্রহণ করেনি।”
করোনা মহামারির সময় অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছে, সেটি পূরণ করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশ বিশেষ পুনর্বাসন পরিকল্পনা গ্রহণ করে সেটি বাস্তবায়ন করেছে।
করোনাকালে দেশের বেকার জনগোষ্ঠী, ছোট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, রাজ্য এবং স্থানীয় সরকার গুলোকে সাহায্য করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক দশমিক নয় ট্রিলিয়ন ডলারের একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিলো।
এর বিপরীতে চীনে তখন যা ঘটেছে, সেটি ব্যাখ্যা করে মি. সঙ বলেন, “গোটা চীনে আর্থিক নীতি তখন আরও সংকোচন করা হয়েছে। এর ফলে অবশ্য মুদ্রাস্ফীতি চীনের জন্য তেমন কোনো সমস্যা হয়ে উঠতে পারেনি। তবে দেশটির অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে।”
চীনাদের অনেকেই এমন বাসস্থানের জন্য অর্থ পরিশোধ করেছেন, যেগুলোর নির্মাণ কাজ এখনো শুরু হয়নি, কিংবা হলেও পুরোপুরি শেষ হয়নি।
ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক ইউবিএস’র ওয়াং তাও অবশ্য চীনা অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের বর্তমান ধীরগতির পেছনে আরও একটি বড় কারণ উল্লেখ করেছেন।
তিনি বলছেন, “আবাসনখাতের মন্দা বিবেচনায় চীন এখন তার ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে।”
“আবাসনখাতে চীনের ৬০ শতাংশেরও বেশি পরিবারের সম্পদ রয়েছে। কিন্তু যখন বাড়ির দাম কমে যায়, তখন মানুষ এ খাতে ব্যয় করতে আস্থা পায় না, বিশেষ করে মধ্যবিত্তরা। এর একটি বড় প্রমাণ হচ্ছে, বড় বড় গৃহস্থালি সামগ্রির ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে,” বলেন তিনি।
চীনের আবাসনখাতের এসব সমস্যা দেশটির অর্থনীতিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। কারণ চীনের অর্থনীতির এক তৃতীয়াংশই এই খাতের উপর নির্ভরশীল।
২০২১ সাল থেকে এই খাতটি বড় ধরনের আর্থিক সংকোচনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কারণ ওই বছর চীনা কর্তৃপক্ষ আবাসনখাতের সাথে যুক্ত বড় কোম্পানি গুলোর ঋণ দেওয়ার পরিমাণ কমিয়ে দেয়।
বছরের পর বছর ধরে চীনের আবাসন ব্যবসায়ীরা হয় ব্যাংক ঋণ নিয়ে অথবা বন্ড ছেড়ে এবং নির্মাণের আগেই ক্রেতাদের কাছে বাড়ি বিক্রি করে তাদের নতুন প্রকল্পের জন্য তহবিল সংগ্রহ করেছে।
বিশ্বের অনেক দেশেই আবাসন ব্যবসায়ীরা এই ব্যবসায়িক মডেল অনুসরণ ব্যবসা চালিয়ে আসছেন। তবে চীনের ব্যবসায়ীরা ঋণ গ্রহণের উপর অতিমাত্রা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন।
এমনকি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই খাতের বেশ কয়েকটি বড় কোম্পানিকে ঋণ খেলাপিও হতে দেখা গেছে।
চীনাদের অনেকেই এসব আবাসন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বাড়ি কিনতে অগ্রিম অর্থ জমা দিয়েছিলেন। অথচ বাড়িগুলোর বেশিরভাগই হয় এখনো নির্মাণকাজ শুরু হয়নি অথবা হলেও সেটির কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি।
ক্রেতা অনেকেই নিজের সারা জীবনের সঞ্চিত অর্থ ওইসব বাড়ির পেছনে ঢেলেছিলেন। তারা এখন সেই অর্থ মার যাওয়ার আশঙ্কা করছেন।
চীনের স্থানীয় সরকার, যারা অবকাঠামো নির্মাণের জন্য আগে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে এবং রাজস্ব অর্জনে জমি বিক্রির উপর নির্ভর করেছে, তারাও এখন চাপের মধ্যে রয়েছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের হিসেবে, তাদের ঋণের পরিমাণ এখন ৯২ ট্রিলিয়ন ইউয়ান বা ১২.৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ছুঁয়েছে, যা চীনের ২০২২ সালের অর্থনৈতিক উৎপাদনের ৭৬ শতাংশের সমান।
যদিও দেশটির ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ তিয়ানচেন জু বলছেন, “চীনের অর্থনীতি মোটেও সংকটের মধ্যে নেই।”
তিনি মনে করেন, ঋণ কার্যক্রমের ফলে গত এক দশকে চীনের অবকাঠামোখাতের দ্রুত সম্প্রসারণ ঘটেছে এবং অর্থনীতি উচ্চ প্রবৃদ্ধি লাভ করেছে।
“নিজের ভারসাম্য ঠিক রাখতে চীন এখন সেই মডেল থেকে সরে এসেছে এবং এই সংশোধনটি অনিবার্য ছিলো,”, বিবিসিকে বলেন মি. তিয়ানচেন।
তিনি আরও বলেন, “বিষয়টি অনেকটা বিশাল আকৃতির এটি যন্ত্রের মতো, যেটি চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে এবং সেটার বিভিন্ন অংশে বেশ কিছু ফাটল দেখা দিতে শুরু করেছে।”
চীনের অর্থনীতি কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে?
জিডিপির আকার বিবেচনায় ২০১০ সালে চীন যখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছিল, তখন ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল যে, দেশটি খুব শিগগিরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও ছাড়িয়ে যাবে। এমনকি বেশিরভাগই বিশ্বাস করেছিল যে, ঘটনাটি ঘটনা সময়ের ব্যাপার মাত্র।
এই বিশ্বাসের পেছনে বড় কারণ ছিলো দেশটির অসাধারণ অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ। ২০১০ সাল পর্যন্ত টানা দুই দশক দেশটি অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের দিক থেকে শীর্ষে ছিল। এর মধ্যে ১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ সাল এবং ২০০৩ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত দুই মেয়াদে চীন দুই অঙ্কের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে রেকর্ড করেছিল।
বর্তমান অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হওয়ার আগে ধারণা করা হচ্ছিলো যে, চীন ২০২৮ সাল নাগাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে ছাড়িয়ে যাবে। এমনকি এ বিষয়ে যারা তুলনামূলক কম আশাবাদী ছিলেন, তারাও অনুমান করছিলেন যে, ২০৩২ সালের মধ্যে দেশটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অতিক্রম করতে সক্ষম হবে।
কিন্তু বর্তমানে যে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, তা সত্ত্বেও চীন কি এখনও সেটি করতে পারবে?
“হ্যাঁ পাবরে, তবে আপাতত কয়েক বছরের মধ্যে নয়,” বলছিলেন হংকং ইউনিভার্সিটির সেন্টার অন কনটেম্পরারি চায়না অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ডের (সিসিসিডাব্লিউ) প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক অধ্যাপক লি চেং।
অধ্যাপক লি এর আগে ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের চায়না সেন্টারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
চীনের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ তিয়ানচেন জু অবশ্য এ ব্যাপারে আরও সুনির্দিষ্ট সময়সীমার কথা উল্লেখ করেছেন।
তিনি বলেছেন, ২০৪০ এর দশকে চীন এই লক্ষ্য পূরণ করতে সক্ষম হবে।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে অধ্যাপক লি বলছেন যে, চলতি বছরের শেষ নাগাদ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল সহ বেশ কয়েকটি অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
“এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সহজ কোনো যাত্রা নয়। ভয়ঙ্কর রকম রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব, বর্ণবাদ কেন্দ্রীক উত্তেজনা, অভিবাসন নীতিসহ আরও বেশকিছু অনিশ্চয়তা দেশটির সামনে রয়েছে, যা বিবেচনায় নেওয়া উচিৎ,” বলেন অধ্যাপক লি।
তিনি আরও বলেন, “এক্ষেত্রে চীন সামনে অবশ্য নতুন কিছু সুযোগ তৈরি হয়েছে। যেমন: দেশটি কয়েক বছরের মধ্যেই বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদন শিল্পের নেতা হয়ে উঠেছে, যা অনেক মানুষকে রীতিমত অবাক করে দিয়েছে।”
“কিন্তু চীনের জন্য একটি খারাপ খবর হলো দেশটিতে বয়স্কদের সংখ্যা বাড়ছে। সে তুলনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খানিকটা কম চাপের মধ্যে রয়েছে। কারণ তাদের জন্মহার চীনের চেয়েও বেশি। তাছাড়া দেশটির কর্মশক্তিতে অভিবাসীরাও ভূমিকা রাখছে।“, বলেন অধ্যাপক লি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির এসএআইএস চায়না গ্লোবাল রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক অ্যান্ড্রু মের্থা অবশ্য মনে করেন যে, যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে হয়তো চীনের নেতাদের মধ্যেই দ্বিধা রয়েছে।
“অর্থনৈতিক ঝুঁকির বিবেচনায় চীন হয়তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যেতে চাইবেই না,” বলেন তিনি।
অধ্যাপক মের্থা আরও বলেন, “প্রবৃদ্ধির নিম্ন হার, আবাসন সংকট এবং বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর পরিপ্রেক্ষিতে চীনের বর্তমান অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে যে, দেশটির নেতারা কিছুটা ঝুঁকিমুক্ত থাকতে চাচ্ছেন।”
“তাছাড়া মার্কিন আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করার মতো সাহসী অর্থনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রেও তারা খুব একটা আগ্রহী নন।”
চীনের ক্ষেত্রে এর পরিণতি কী হতে পারে?
এই প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করলে প্রায়ই ‘হারানো দশকে’র বিষয়টি সামনে চলে আসে।
“হারানো দশক” বলতে মূলত: একটি পূর্বাভাসিত দীর্ঘ সময়ের অর্থনৈতিক স্থবিরতাকে বোঝানো হয়ে থাকে।
মি. সঙ বিশ্বাস করেন যে, আস্থার সংকট এবং সেটির প্রতিক্রিয়া চীনের অর্থনীতিকে পেছনের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
আস্থার অভাব দেশটিতে বিনিয়োগ এবং ভোগ কমছে। এর ফলে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফা কমে যাচ্ছে। সেকারণে সম্পত্তির দাম কমছে।
আর সম্পত্তির দাম কম থাকায় মানুষ বিনিয়োগ করতে আস্থা পাচ্ছেনা। পুরো ব্যাপারটি অনেকটা এভাবেই ঘটে চলেছে।
“এই চক্র থেকে বের হয়ে আসার জন্য একটি যুতসই নীতি দরকার”, বলেন মি. সঙ।
অনেকেই আশঙ্কা করছেন যে, অর্থনৈতিক মন্দার কারণে সৃষ্ট অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ দূর করতে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং হয়তো তাইওয়ানের উপর আক্রমণ চালাবেন।
স্ব-শাসিত তাইওয়ানকে চীন নিজের একটি বিচ্ছিন্ন প্রদেশ হিসাবে দেখে এবং তারা বিশ্বাস করে যে, ধীরে ধীরে সেটি বেইজিংয়ের নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
প্রফেসর মের্থা মনে করেন, তাইওয়ানকে আক্রমণ করাটা চীনের জন্য “বোকামী” হবে।
অধ্যাপক লি এ ব্যাপারে সতর্ক করে বলছেন, ” চীন, মার্কিন কিংবা তাইওয়ানের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে যারাই তাইওয়ানের বিরুদ্ধে যে-ই যুদ্ধ শুরু করতে চান, তাদের সতর্কতার সাথে বিষয়টি বিবেচনা করা উচিৎ। কারণ এই যুদ্ধটি হবে ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে ভিন্ন।”
“এটিই প্রথম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর প্রযুক্তির যুদ্ধ হতে পারে। এটি হবে একটি সর্বাত্মক উচ্চ প্রযুক্তির মেশিন-টু-মেশিন যুদ্ধ,” বলেন অধ্যাপক লি।
তিনি আরও বলেন, “তাইওয়ান অবশ্যই চীনের জন্য একটি মূল বিষয়। তবে চীনা নেতৃত্বও এটি স্বীকার করে যে, কৌশল হিসেবে যুদ্ধ হবে তাদের শেষ অবলম্বন। আর কারণ হিসেবে অর্থনৈতিক স্থবিরতা এই যুদ্ধ শুরু করার জন্য যথেষ্ট নয়।”
চীনের মন্দা বিশ্ব অর্থনীতিতে কেমন প্রভাব ফেলবে?
চীনের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ তিয়ানচেন জু মনে করেন, চীনের বর্তমান অর্থনৈতিক মন্দা বিশ্বকে তিনভাবে প্রভাবিত করবে।
সেগুলো হলো: পণ্য, চীনা পর্যটন এবং ভূ-রাজনীতি।
“প্রথমতঃ বিশ্ববাজারের পণ্যের ক্ষেত্রে চীন যেহেতু একটি প্রধান আমদানিকারক দেশ, কাজেই দেশটিতে মন্দার অর্থ হচ্ছে পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়া, বিশেষ করে আকরিক লোহা ও বক্সাইটের মতো যেসব পণ্য নির্মাণকাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।“
“দ্বিতীয়তঃ চীনা পর্যটকরা যেসব গন্তব্যগুলোতে বেশি যেতেন, সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফলে তাদের ব্যবসাকে করোনা মহামারির আগের অবস্থায় ফিরে নিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে যাবে।“
“তৃতীয়তঃ অর্থনৈতিক মন্থরতার কারণে চীনের ভেতরে, বিশেষ করে যদি সরকারি তহবিলে সঙ্কট দেখা দেয়, সেক্ষেত্রে সরকারিভাবে অন্যদেশকে সাহায্য বা ঋণ প্রদান করা চীনের জন্য কঠিন হয়ে যাবে।”
চীন গত এক দশকে বিশ্বব্যাপী নিজের উপস্থিতির জানান দিতে বেশ কয়েকটি বিনিয়োগ ও অবকাঠামো প্রকল্পের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) স্থাপনের কাজ শুরু করেছিল।
এ বিষয়ে ইতিমধ্যেই তারা ১৫২টি দেশের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে এবং ৩০০০ টিরও বেশি প্রকল্পে বিনিয়োগও করে ফেলেছে।
কিন্তু সমালোচকদের কেউ কেউ একে চীনের “ঋণের ফাঁদ” হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তারা মনে করছেন যে, বিআরআই প্রকল্পের মাধ্যমে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের অনেক দেশের কাছে চীন প্রধান ঋণদাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের ২০২২ সালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, চীন এখন মালদ্বীপ, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বড় দ্বিপাক্ষিক ঋণদাতা।
যদিও চলতি মার্চ মাসে চীনের ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসের (এনপিসি) অধিবেশনে জানানো হয়েছে যে, প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি আগের তুলনায় উল্লেখযোগ্যহারে কমিয়েছেন।
এটি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, অর্থনৈতিক মন্দার মুখে বিদেশে চীনের বড় আকারের বিনিয়োগ খুব একটা টেকসই হবে না।
কিন্তু মি. সঙ জোর দিয়ে বলেছেন যে, চলমান মন্দার মধ্যেও বিশাল আকারের অর্থনীতির কারণেই চীন এখনও বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে বড় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
“বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে চীনের আগামী পাঁচ বছরে ২০ শতাংশ বা তার চেয়েও বেশি অবদান রাখার সম্ভাবনা রয়েছে,” বলেন মি. সঙ।
চীন কি আবারও উঠতে পারবে?
মি. সঙ মনে করেন, চীনের জন্য পরবর্তী ধাপটি হচ্ছে আরও উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক রূপান্তর সফলভাবে সম্পন্ন করা।
“(চীনের ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসের) দু’টি অধিবেশন দেখিয়েছে যে, নীতি নির্ধারকরা এখন বড় এবং দীর্ঘ মেয়াদী অগ্রাধিকারের উপর দৃষ্টি দিয়েছেন, যা ঠিক করে দিবে যে, চীন পরবর্তী ধাপে যেতে পারবে কী-না।”
মি. জু পরামর্শ দিয়ে বলেন, “চীনের জন্য এখন আবাসনখাতের সংকট আরও দায়িত্বশীলতার সাথে মোকাবেলা করাটাই মূল বিষয়।“
“দ্বিতীয়তঃ কেবল চীনা অর্থনীতির সরবরাহের দিকে মনোযোগ না দিয়ে এখন চাহিদার দিকেও মনোযোগ দেওয়া উচিৎ,” বলেন মি. জু।
তিনি আরও বলেন, “চীনের উচিৎ বেসরকারি এবং বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য অর্থনীতির আরও অনেকখাতকে উন্মুক্ত করে দেওয়া করা।”
“এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা আর্থিক সম্প্রসারণের পরে যেটি সরকারি অর্থের দীর্ঘমেয়াদী স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে পারবে, এমন আর্থিক সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিৎ।”
মি. সঙ বিশ্বাস করেন যে, চীনা নেতৃত্ব এখন ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসে (এনপিসি) নির্ধারিত পাঁচ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জনে মনোযোগ দিবে।
“যদিও আমরা পরিমিতভাবে আরো সহায়ক রাজস্ব নীতির লক্ষ্যমাত্রা দেখেছি, তারপরও ২০২৪ সালের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সামনের দিনগুলোতে আরও কী ধরনের উদ্দীপকমূলক নীতি গ্রহণ করা যায়, সেগুলোর ব্যাপারে আমরা ভাবছি।”