বাংলাদেশে গত ৭ই জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে কার্যত গা ঢাকা দিতে হয়েছিল’ – এমন একটি দাবিকে কেন্দ্র করে কূটনৈতিক তর্কবিতর্ক ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছে।
ঢাকায় নিযুক্ত সাবেক ভারতীয় হাই কমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী কিছুদিন আগে দিল্লিতে এক অনুষ্ঠানে এই দাবি করার পর সোমবার (৮ই এপ্রিল) মার্কিন প্রশাসন এই বক্তব্য সরাসরি নাকচ করে দিয়েছে।
আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের (স্টেট ডিপার্টমেন্ট) মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার সোমবার তাদের নিয়মিত সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছেন, “এই বক্তব্য সঠিক নয়।”
বাইডেন প্রশাসন এই বক্তব্যকে সরাসরি খারিজ করে দেওয়ার পরেও পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী অবশ্য নিজের দাবি থেকে মোটেও সরে আসছেন না।
মঙ্গলবার (৯ এপ্রিল) বিকেলে তিনি দিল্লিতে বিবিসি বাংলাকে বলেন, “প্রথম কথা হল, আমি সেদিন কিন্তু নতুন কোনও কথা বলিনি। বাংলাদেশের নির্বাচনের ঠিক আগে সে দেশের মিডিয়াতেই ভূরি ভূরি খবর বেরিয়েছিল যে হঠাৎ করে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে আর কোথাও দেখা যাচ্ছে না।”
“যারা বাংলাদেশের গণমাধ্যমে নিয়মিত নজর রাখেন তারা সবাই এটা জানেন, আমিও জানি।”
“এখন ঘটনা হল, এর ঠিক কিছুদিন আগেই দিল্লিতে ভারত ও আমেরিকার মধ্যে ‘টু প্লাস টু ডায়ালগে’ কী ঘটেছে, সেটাও পাবলিক ডোমেইনে আছে এবং সবাই তা জানেন।”
“আপনি বলতে পারেন সেই টু প্লাস টু-র বৈঠকের পরই রাষ্ট্রদূতের এই অন্তর্ধান – আমি শুধু দুয়ে দুয়ে চার করেছি!”, শব্দ নিয়ে খেলা করে হাসতে হাসতেই জবাব দেন পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী।
কোনও দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রকাশ্য সাংবাদিক সম্মেলনে যে এই প্রশ্নের দ্বিতীয় কোনও উত্তর দেওয়া যে সম্ভব নয়, সেটাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন তিনি।
“আমেরিকা ছাড়ুন, একটা ছোট্ট দেশের সরকারকেও যদি জিজ্ঞেস করা হয় অমুক দেশের কড়া অবস্থানের কারণেই কি আপনাদের রাষ্ট্রদূত গা ঢাকা দিয়েছেন, কেউ কি স্বীকার করবে যে হ্যাঁ, সেটা সঠিক?”, পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেন পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী।
বিতর্কের সূত্রপাত যেভাবে
পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী ভারতের একজন সাবেক শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিবিদ, যিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (অর্থনৈতিক সম্পর্ক) পদ থেকে অবসর নেন কয়েক বছর আগে।
২০০৭ থেকে ২০০৯ – এই পুরো তিন বছর তিনি ঢাকায় ভারতের হাই কমিশনার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
এই সময়কালেই বাংলাদেশ দীর্ঘ দু’বছর সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনে ছিল। তারপর ২০০৯ সালে যখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে, তারও প্রথম এক বছর তিনি ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশনার ছিলেন।
ঢাকায় রাষ্ট্রদূত থাকাকালীন মি চক্রবর্তীর বহু মন্তব্য বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। বিরোধী দলে থাকাকালীন বিএনপি তার বিরুদ্ধে ঢাকায় ভারতীয় দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ পর্যন্ত দেখিয়েছিল।
২০০৯ সালের জুন মাসে তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপি টিপাইমুখ বাঁধ ইস্যুতে তার কিছু মন্তব্যের জেরে মি চক্রবর্তীকে ঢাকা থেকে প্রত্যাহারেরও দাবি জানিয়েছিল।
এহেন মি চক্রবর্তী সম্প্রতি ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে একটি বই লিখেছেন, যার নাম ‘ট্রান্সফর্মেশন : ইমার্জেন্স অব বাংলাদেশ অ্যান্ড ইভোলিউশন অব ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ টাইস’ (রূপান্তর : বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ও ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের বিবর্তন)।
গত ২৮শে মার্চ দিল্লির থিঙ্কট্যাঙ্ক অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনে (ওআরএফ) এই বইটির ওপর একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে লেখক মি চক্রবর্তী-সহ অন্য বিশেষজ্ঞরাও যোগ দেন।
বিবিসি বাংলার এই প্রতিবেদকও ওই অনুষ্ঠানে শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
ওআরএফে এই ধরনের অনুষ্ঠানগুলিতে ‘চ্যাথাম হাউস’ রুল মেনে চলা হয় – অর্থাৎ আলোচনার বিষয়বস্তু প্রতিবেদনে তথ্য হিসেবে ব্যবহার করা গেলেও কাউকে উদ্ধৃত করে কোনও মন্তব্য রিপোর্ট করা যায় না।
তা সত্ত্বেও সে দিনের অনুষ্ঠানের প্রশ্নোত্তর পর্বে পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীর করা একটি মন্তব্য বাংলাদেশের একাধিক গণমাধ্যমে রিপোর্ট করা হয়।
ওই রিপোর্টগুলোতে বলা হয়, অনুষ্ঠানে একটি প্রশ্নের জবাবে মি চক্রবর্তী বলেছেন তিনি নিশ্চিত যে ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই বাংলাদেশের নির্বাচনের আগে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত কার্যত আত্মগোপনে চলে গিয়েছিলেন।
তার বক্তব্য ছিল, বাংলাদেশের নিজস্ব গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আমেরিকার অতিরিক্ত ‘হস্তক্ষেপে’র চেষ্টা ভারত যে পছন্দ করছে না এবং তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে – দিল্লি তাদের এই মনোভাবের কথা গত নভেম্বরে ‘টু প্লাস টু ডায়ালগে’র সময়ই ওয়াশিংটনের কাছে স্পষ্ট করে দিয়েছিল।
প্রসঙ্গত, টু প্লাস টু ডায়ালগ হল ভারত ও আমেরিকা, এই দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের মধ্যে একটি স্ট্র্যাটেজিক সংলাপ প্রক্রিয়া, যার শেষ পর্বটি গত বছর নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
ওই সংলাপের পরই ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াটরা প্রকাশ্যে জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ভারতের অবস্থান আমেরিকার কাছে স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। যদিও ভারত-মার্কিন যৌথ বিবৃতিতে বাংলাদেশ প্রসঙ্গের কোনও উল্লেখ ছিল না।
এর ঠিক দু’মাসের মধ্যেই (৭ জানুয়ারি) অনুষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশের সংসদীয় নির্বাচন।
বস্তুত এই বিষয়টির অবতারণা করেই পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী সে দিন যে কথাগুলো বলেছিলেন তা হল, “আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি ভারতের পক্ষ থেকে তখন এই কড়া বার্তাটা (আমেরিকাকে) শুনিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যার পরিণতিতে ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত, যিনি তার কিছুদিন আগেও অমুক বিএনপি নেতাকে দাওয়াত দিয়ে বাড়িতে ডেকে আনছিলেন বা তমুক বিএনপি নেতার বাসায় গিয়ে হাজির হচ্ছিলেন – তাকে আর ভোটের সময় দেখাই গেল না! কোথায় যে তিনি গা ঢাকা দিলেন সে কেবল তিনিই জানেন!”
মি চক্রবর্তী এদিন বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ওই ডায়ালগের পরের ঘটনাক্রম আর বাংলাদেশের মিডিয়াতে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের গতিবিধি নিয়ে প্রকাশিত রিপোর্ট – এই দুটোর মধ্যে সম্পর্ক টেনে তিনি শুধু ‘দুয়ে দুয়ে চার’ করেছেন – মোটেই নতুন কিছু বলেননি।
ম্যাথিউ মিলারের ব্রিফিংয়ে ‘অন্তর্ধান’ প্রসঙ্গ
সোমবার (৮ই এপ্রিল) ওয়াশিংটন ডিসি-তে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের নিয়মিত সাংবাদিক সম্মেলনে এই প্রসঙ্গটির অবতারণা করেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারি।
মি আনসারি তার একটি ফেসবুক পোস্টে এই প্রশ্নোত্তর পর্বের যে বিবরণ দিয়েছেন তাতে লিখেছেন :
“বাংলাদেশে ৭ই জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের পূর্ব মুর্হূতে ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছিলেন- ভারতের সাবেক শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিক ও ঢাকায় নিযুক্ত সাবেক ভারতীয় হাই কমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীর এমন মন্তব্যকে আমলে নেয়নি স্টেট ডিপার্টমেন্ট।”
“সোমবার স্টেট ডিপার্টমেন্টের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে রাষ্ট্রদূত পিনাক রঞ্জনের এমন মন্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার হাস্যরসের
সঙ্গে বিষয়টিকে উড়িয়ে দেন এবং এ ধরনের অভিযোগ সঠিক নয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।”
বস্তুত সাবেক ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের করা ওই মন্তব্যের সূত্র ধরে মি আনসারি জানতে চেয়েছিলেন, “ভারতের চাপের কারণে বাংলাদেশের ৭ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পূর্ব মুর্হূতে ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত গা ঢাকা দিয়েছিলেন বলে, নয়াদিল্লিতে একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন ঢাকায় হাই কমিশনারের দায়িত্ব পালন করে যাওয়া এক ভারতের কূটনীতিক । সত্যিই কি তাই ঘটেছিলো?”
জবাবে মুখপাত্র মিলার হাসতে হাসতেই বলেন, “দিল্লিতে যত বইয়ের মোড়ক উন্মোচন বা বই নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠান হয় তার সবগুলো আমি ফলো করি না!”
তবে সেই সঙ্গেই তিনি যোগ করেন, “আপনার প্রশ্নের উত্তরে বলব – না, এটা সঠিক নয়!”
এসময় বার্তা সংস্থা এপি বা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের সাংবাদিক ম্যাথিউ লি জানতে চান, “কেন (দিল্লির সবগুলো বুক লঞ্চ ইভেন্ট) ফলো করেন না?”
জবাবে মি মিলার বলেন, “আমার আরও অনেক কাজ থাকে। সেগুলো নিয়ে ব্যস্ত থাকাটাই জরুরি মনে করি।”
এই প্রশ্নের জবাবে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে যে ধরনের জবাব প্রত্যাশিত ছিল, মুখপাত্রের জবাবে যে সেটারই প্রতিফলন ঘটেছে তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
কিন্তু টু প্লাস টু ডায়ালগে ভারতের অবস্থান ও তার পরবর্তীতে ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সক্রিয়তায় ভাঁটা পড়ার ইস্যুকে কেন্দ্র করে দিল্লি ও ওয়াশিংটনের মধ্যে যে একটা কূটনৈতিক অস্বস্তি তৈরি হয়েছিল সেটা গোটা ঘটনায় আরও একবার স্পষ্ট হয়ে গেছে।