মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জান্তা বাহিনী ও বিদ্রোহী আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘাতের জের ধরে গত তিন দিনে নতুন করে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর ৮০জন সদস্য বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি এ তথ্য জানিয়েছে। এর মধ্যে সর্বশেষ মঙ্গলবার রাতে মিয়ানমারের সীমান্ত পুলিশ বিজিপি ও সেনা সদস্য মিলে মোট ৪৬ জন পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন।
বিজিবি জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, গত তিনদিনে মিয়ানমার জান্তা বাহিনীর প্রায় ৮০ জন সদস্য বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন।
“সর্বশেষ গতকাল রাতে ৪৬ জন পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। এর আগে দিনের বেলায় আসেন আরো ১৮ জন,” বলেন মি. ইসলাম।
মিয়ানমারের রাখাইনে জান্তা বাহিনী এবং বিদ্রোহী আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘাত চলছে গত কয়েক মাস ধরেই।
এর আগে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে তিনশতাধিক বিজিপি সদস্য আশ্রয় নিয়েছিলেন বাংলাদেশে। একাধিক সীমান্ত চৌকি আরাকান আর্মির দখলে যাওয়ায় সেসময় তাদের পালাতে হয়েছিল।
পরে তাদের একটি বড় অংশকে ফেরত পাঠানো হলেও দেড়শো’র মতো মিয়ানমারের নাগরিক বাংলাদেশ সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর আশ্রয়ে ছিলেন।
গত কয়েকদিনে নতুন অনুপ্রবেশের ফলে সে সংখ্যা এখন দাঁড়িয়েছে ২৬০ জনে।
এখন আবার কেন জান্তা বাহিনীর এত সদস্য পালিয়ে আসছেন বাংলাদেশে? এ থেকে রাখাইনের যুদ্ধ পরিস্থিতি সম্পর্কে কী ধারণা পাওয়া যায়?
বিজিবির মি.ইসলাম বলেছেন, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা সবাই বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হেফাজতে রয়েছেন।
তাদের দেখভালের দায়িত্ব পালন করছে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে অবস্থিত বিজিবি ১১ ব্যাটালিয়ন।
যুদ্ধে কোনো পরিবর্তন?
গত দোসরা ফেব্রুয়ারি থেকে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ বা বিজিপি’র সংঘর্ষ শুরু হয়।
সেসময় জান্তা বাহিনীর দখলে থাকা সীমান্ত চৌকিগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেয় বিদ্রোহীরা।
সীমান্ত চৌকিগুলোতে আরাকান আর্মির অভিযানের তীব্রতায় টিকতে না পেরে বাংলাদেশ পালিয়ে আসেন মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ বা বিজিপি-র সদস্যরা।
এরপর মংডু ও বুধিডং টাউনশিপের দিকে অগ্রসর হয় আরাকান আর্মি।
ঘুমধুম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ তখন বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছিলেন, কয়েকদিন তারা দূরে সংঘর্ষের আওয়াজ পাচ্ছেন।
বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে খানিকটা দূরে অবস্থিত ওই শহরতলি।
মঙ্গলবারও ওই একই এলাকার দিক থেকে গোলাগুলির শব্দ শোনা গেছে বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন নাইক্ষ্যংছড়ি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আবছার।
সংঘাতে মিয়ানমারের রাখাইনসহ অনেক এলাকায় জান্তা বাহিনীকে হটিয়ে বিদ্রোহী আরাকান আর্মি নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি ওই এলাকায় নতুন করে সংঘাত ও সংঘর্ষ বেড়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও গবেষক মো. বায়েজিদ সরোয়ার বিবিসি বাংলাকে বলেন, “নতুন অনুপ্রবেশের কারণ, নববর্ষের পর আরাকান আর্মি তাদের আক্রমণ বাড়িয়েছে।”
মি. সরোয়ার মনে করেন, মংডু’র উত্তর ও আশেপাশে দু’পক্ষের ব্যাপক সংঘাতের কারণেই নতুন করে বিজিপি সদস্যরা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন।
মিয়ানমারে নববর্ষকে স্থানীয়ভাবে থিংইয়ান নামে ডাকা হয়। সেখানে নতুন বছরের প্রথম দিনটি সাধারণত মধ্য-এপ্রিলে হয়ে থাকে। নববর্ষের চারদিন আগে থেকে পানি উৎসব শুরু হয়, চলে নববর্ষের দিন পর্যন্ত।
এ সময় সংঘাত পরিস্থিতি কিছুটা শিথিল হয়ে থাকতে পারে বলে মত, মি. সরোয়ারের।
বাংলাদেশের আরেকজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা অবসরপ্রাপ্ত মেজর এমদাদুল ইসলাম বলছেন, আরাকান আর্মির(এএ) কাছে যে ধরনের অস্ত্র আছে বর্ডার পোস্টগুলোতে সে মানের অস্ত্র নেই।
“আরাকান আর্মি দুর্বল জায়গাগুলোতেই আক্রমণ করে যাচ্ছে। এর বিপরীতে বিজিপি সদস্যরা যখন টিকতে পারেনা তখন পালিয়ে আসে,” যোগ করেন তিনি।
আবহাওয়া আর দূরত্বও কারণ
জান্তা সরকারের কাছ থেকে মংডু ও বুধিডং শহরে আধিপত্য কেড়ে নিতে গত দুই মাস ধরে লড়াই চালাচ্ছে আরাকান আর্মি।
এদিকে, বর্ষা মৌসুম আসছে। এ সময় পাহাড়ি অঞ্চলে যুদ্ধ পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়ে।
বায়েজিদ সরোয়ার মনে করেন, “তাই, বর্ষার আগেই এই অঞ্চলে বড় ধরনের অভিযান চালিয়ে লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করবে আরাকান আর্মি।”
জান্তা বাহিনীর সাথে আরাকান আর্মির যুদ্ধক্ষেত্র মূলত রাখাইন রাজ্যের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকা।
চিন ও রাখাইনের যে নয়টি শহর তারা দখলে নিয়েছে সেগুলোও সীমান্তের কাছাকাছি।
দূরত্বের হিসাব-নিকাশসহ বেশ কয়েকটি কারণে বিজিপি সদস্যরা বাংলাদেশে আসাটা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ মনে করে বলে ধারণা মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলামের।
“হয়তো সিতওয়ে বা মিয়ানমারের অন্য শহরে ফেরত যাওয়ার রাস্তা তাদের নাই, গেলেও কোর্টমার্শালের (সামরিক আদালতে বিচার) ঝুঁকি থেকে যায়। আবার, তাদের মধ্যে আরাকান আর্মির হাতে পড়ার ভয়ও কাজ করতে পারে,” যোগ করেন তিনি।
সে কারণে বাংলাদেশে পালিয়ে চলে আসতে পারলে সে শঙ্কাগুলো থেকে রেহাই মেলে।
মি. ইসলাম বলেন, “পরে ডিপোর্টেশন (ফেরত পাঠানো) হলেও আপাতত তো ওই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বেঁচে গেলো, এটা আরেকটা কারণ।”
মংডুর গুরুত্ব
মিয়ানমার তো বটেই, বাণিজ্যিক কারণে বাংলাদেশের কাছেও গুরুত্ব আছে মংডুর। এই পথে বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের সীমান্ত বাণিজ্য হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ থেকে রাখাইনের প্রবেশদ্বারও বলা যায় শহরটিকে।
আগে বিশেষ ট্রানজিট পাসের মাধ্যমে টেকনাফ ও মংডুর লোকজনকে সীমান্ত পেরিয়ে দুইদেশে যাতায়াতের সুযোগ দেয়া হতো। ২০১৬ সালে মংডুর সীমান্ত চৌকিতে হামলার পর সে ট্রানজিট পাস বন্ধ করে দেয়া হয়।
উত্তর আরাকানের গুরুত্বপূর্ণ শহরটি জেলার প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্রও বটে।
“আরাকান আর্মি শহরটি দখল করতে পারলে বাংলাদেশের সঙ্গে ভূমি সীমান্ত এবং নাফ নদীতে জান্তা সরকারের আর কোনো অবস্থান থাকবে না,” বলছিলেন মি. সরোয়ার।
বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের মধ্যকার সীমান্তের দৈর্ঘ্য ২৭১ কিলোমিটার।
মি. সরোয়ার বলেন, “মংডু দখল করে ফেললে এই ভূ-সীমান্তের পুরোটাতেই আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে।”
রাখাইনের মংডু, রাথিডং, বুধিডং এলাকাগুলো রোহিঙ্গা অধ্যুষিত।
“মংডু যদি কোনোভাবে আরাকান আর্মির দখলে যায় সেটা দেশটির জান্তার জন্য একটা বড় আঘাত হবে,” বলেন মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম।
তবে তাতে বাংলাদেশের জন্য নতুন ঝুঁকি তৈরি হতে পারে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
যেমন যেহেতু বুধিডং ও মংডুতে জান্তা বাহিনীর ঘাঁটি রয়েছে। ফলে ওই অঞ্চলের পতন হলে শত শত জান্তা সেনা ও বিজিপি সদস্য আবারো বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে পারে, এমন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
সেনাবাহিনীতে রোহিঙ্গাদের নিয়োগের প্রভাব?
সম্প্রতি বিবিসি’র এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বর্তমানে রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকেই জনবল সংগ্রহ করছে সেনাবাহিনী এবং রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক বাহিনীতে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে।
এ নিয়ে আরাকান আর্মি বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। আবার সামরিক সরকারপন্থী মিডিয়া প্রচার করেছে, বুধিডং ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছে।
যদিও স্থানীয়রা বিবিসিকে জানিয়েছেন যে তারা সন্দেহ করছেন, এ দুটি জাতিগোষ্ঠীকে বিভক্ত করার চেষ্টায় সেনাবাহিনী পরিকল্পিতভাবে এমনটা করছে।
এ নিয়োগের ফলে এই মূহুর্তে বড় কোন সংকট দেখা না দিলেও, ভবিষ্যতে তা বড় ধরণের সমস্যা তৈরি করতে পারে বলে মনে করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা।
এর ফলে রাখাইন ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে পরস্পর বিরোধী অবস্থান তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক এমদাদুল ইসলাম।
তিনি বলেন, “মেরে-কেটে তাড়ানো বা পালিয়ে আসার পরও সেখানে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আধিক্য রয়েছে।এখন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইন ও মুসলিম রোহিঙ্গাদের মধ্যে সংঘাতময় পরিস্থিতি জান্তাকে সুবিধা দেবে -এটাই তাদের কৌশল,” বলেন তিনি।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) বায়েজিদ সরোয়ারও মনে করেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনীতে নিয়োগ রাখাইন-রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে অবিশ্বাসের জন্ম দিতে পারে।
এর আগে ২০১২ সালে রাখাইন রাজ্যের মিশ্র বসবাসের এলাকা থেকে কয়েক হাজার রোহিঙ্গাকে বিতাড়িত করা হয়েছিল এবং তাদেরকে মিয়ানমারে ক্যাম্পে বসবাস করতে বাধ্য করা হয়েছিল।
পাঁচ বছর পর ২০১৭ সালের আগস্টে সেনাবাহিনী তাদের বিরুদ্ধে নৃশংস অভিযান শুরু করলে সেসময় সাত লাখ রোহিঙ্গা দেশ ছেড়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।