“রায়ের চলচ্চিত্র না দেখার বিষয়টি এমন যে, আপনি পৃথিবীতে বসবাস করছেন, অথচ সূর্য বা চাঁদ দেখেনি” – সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে এমন মন্তব্য করেছেন অস্কারজয়ী বিখ্যাত জাপানি চলচ্চিত্র নির্মাতা আকিরা কুরোসাওয়া।
মি. কুরোসাওয়াকে সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্র নির্মাতাদের একজন বলে বিবেচনা করা হয়। আর স্বনামধন্য এ নির্মাতাই বিভিন্ন সময় দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, তিনি সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রের ‘একজন ভক্ত’।
আধুনিক বাংলা সংস্কৃতি জগতের একটি বিরল প্রতিভা সত্যজিৎ রায়। তাকে বলা হয়, বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম পথিকৃৎ, যার হাত ধরে বাংলা সিনেমা প্রথমবারের মতো বিশ্ব দরবারে পৌঁছেছিল।
নির্মাতার পাশাপাশি লেখক, চিত্রনাট্যকার, সঙ্গীত পরিচালক এবং শিল্প নির্দেশক হিসেবেও তার ব্যাপক খ্যাতি রয়েছে।
মধ্য বয়সে ছবি বানানো শুরু করা মি. রায় পরবর্তীতে পরিচিতি লাভ করেছিলেন বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতাদের একজন হিসেবে।
মার্টিন স্কোরসেস থেকে শুরু করে খ্যাতনামা বহু পরিচালক তার সিনেমা দেখে চলচ্চিত্র নির্মাণে উৎসাহ পেয়েছেন বলে জানা যায়।
মি. রায়ের জনপ্রিয়তা এমন যে, বিবিসি’র চালানো ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ জরিপেও তার নাম উঠে এসেছে।
জীবদ্দশায় মোট ৩২টি কাহিনীচিত্র এবং চারটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন মি. রায়।
এগুলোর মাধ্যমে কান, বার্লিনসহ বিশ্ব চলচ্চিত্রের বড় বড় উৎসবে পেয়েছেন ডাক, ভূষিত হয়েছেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অসংখ্য পুরস্কারে।
এমনকি, চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য ১৯৯২ সালের অস্কার আসরে সত্যজিৎ রায়কে আজীবন সম্মাননা প্রদান করা হয়।
চলুন, খ্যাতনামা এই নির্মাতার বহুল আলোচিত পাঁচটি চলচ্চিত্রের বিষয়ে সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাক।
পথের পাঁচালী
সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনা উঠলেই অবধারিতভাবে যে চলচ্চিত্রটির নাম সামনে চলে আসে, সেটি হচ্ছে ‘পথের পাঁচালী’।
১৯৫৫ সালে মুক্তি পাওয়া এই চলচ্চিত্র দিয়ে মি. রায় চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন এবং প্রথম ছবিতেই সমালোচকদের নজর কাড়তে সক্ষম হন।
চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে বাংলা ভাষার খ্যাতনামা কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাস অবলম্বনে।
এই চলচ্চিত্রে বাংলার এক অজ পাড়াগাঁয়ে কঠোর দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকা একটি পরিবার ও তাদের সুখ-দুঃখের কাহিনীকে রূপালী পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন মি. রায়।
এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে মি. রায় বাংলার তৎকালীন গ্রামীণ জীবনের ছবি এমন ‘নিখুঁত ও শৈল্পিক উপায়ে’ বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছিলেন, যা তাকে বিশ্ব চলচ্চিত্রের দরবারে অন্যতম প্রভাবশালী নির্মাতার খ্যাতি এনে দিয়েছিল।
চলচ্চিত্রটির কেন্দ্রীয় চরিত্রে রয়েছে অপু নামের একটি শিশু, যাকে নিয়ে মি. রায় পরবর্তীতে ‘অপরাজিত’ এবং ‘অপুর সংসার’ নামে আরও দু’টি সিনেমা নির্মাণ করেন।
এই তিনটি চলচ্চিত্র একত্রে ‘অপু ট্রিলজি’ বা ‘অপু ত্রয়ী’ নামেও পরিচিত।
চলচ্চিত্র গবেষকদের অনেকের মতে, ‘পথের পাঁচালী’ই ছিল স্বাধীন ভারতে নির্মিত প্রথম কোনও চলচ্চিত্র, যেটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চলচ্চিত্র প্রেমী, নির্মাতা এবং সমালোচকদের মনোযোগ আকর্ষণে সক্ষম হয়েছিল।
এর মাধ্যমে চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে ভারতের তৎকালীন প্রচলিত ধারার বাইরে নতুন একটি ধারা তৈরি হয়েছিল।
মুক্তির পর চলচ্চিত্রটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বেশ কয়েকটি পুরস্কার অর্জন করে।
এরপর ১৯৫৬ সালে বিশ্বের অন্যতম বড় উৎসব কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘পথের পাঁচালী’কে ‘শ্রেষ্ঠ মানবিক দলিল’ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
বিবিসি’র সর্বকালের সেরা ১০০ বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্রের তালিকাতেও জায়গা করে নিয়েছে ‘পথের পাঁচালী’।
জলসাঘর
‘জলসাঘর’কে সত্যজিৎ রায়ের অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি কথা সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত, মি. রায়ের বানানো চতুর্থ চলচ্চিত্র।
গত শতাব্দীর বিশের দশকে যখন ব্রিটিশ সরকার ভারতে জমিদারি প্রথার বিলুপ্তি ঘোষণা করে, তখনকার প্রেক্ষাপটে ছবিটি নির্মিত হয়েছে।
চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্রে রয়েছেন বিশ্বম্ভর বাবু নামের একজন সদ্য সাবেক জমিদার, যিনি কিছুতেই তার জমিদারির পতন মেনে নিতে পারছেন না।
ক্ষমতা ও প্রতাপ আগের মতো নেই, তারপরও নিজের মর্যাদা ও দম্ভ টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা এবং এর ফলে বিশ্বম্ভর বাবুর যে করুণ পরিণতি, সেটিই তুলে ধরা হয়েছে চলচ্চিত্রটিতে।
১৯৫৮ সালে মুক্তি পাওয়া সিনেমাটির শুরুর দৃশ্য দেখে চলচ্চিত্র সমালোচকদের অনেকেই এর ভূয়সী প্রশংসা করেন।
বিখ্যাত মার্কিন চলচ্চিত্র সমালোচক রজার জোসেফ এবার্ট ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত এক নিবন্ধে লিখেছেন, “বিশ্বে এখন পর্যন্ত যত চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম সেরা আগ্রহ উদ্দীপক প্রথম দৃশ্য চিত্রায়িত হয়েছে ‘জলসাঘর’ চলচ্চিত্রে।”
খ্যাতনামা চলচ্চিত্র সমালোচক ডেরেক ম্যালকমও এই চলচ্চিত্রটির ব্যাপক প্রশংসা করেন।
ইংরেজি দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানে ব্রিটিশ এই সমালোচক লিখেছেন, “দৃশ্যায়নের দিক থেকে এটি মি. রায়ের অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র। অসাধারণ ক্যামেরার কাজ দেখানোর জন্য চিত্রগ্রাহক সুব্রত মিত্রকে ধন্যবাদ।”
আবহ সংগীতের দিক থেকেও ‘জলসাঘর’ বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন মি. ম্যালকম।
তার ‘জলসাঘর’ চলচ্চিত্রটিকে ‘গ্রেট মুভি’র তকমা দিয়েছেন চলচ্চিত্র সমালোচক রজার জোসেফ এবার্ট।
‘অপু ত্রয়ী’র পর এই ছবির মাধ্যমে তৃতীয় বারের মতো ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন সত্যজিৎ রায়।
মহানগর
এই সিনেমার জন্য ১৯৬৪ সালে অনুষ্ঠিত চতুর্দশ বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা পরিচালকের খেতাব পান সত্যজিৎ রায়। জিতে নেন ‘সিলভার বিয়ার ফর বেস্ট ডিরেক্ট’ পুরস্কার।
কথা সাহিত্যিক নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ছোটগল্প ‘অবতরণিকা’ অবলম্বনে ‘মহানগর’ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন মি. রায়, ছবিটি ১৯৬৩ সালে মুক্তি পায়।
‘মহানগর’ চলচ্চিত্রের পটভূমি ১৯৫০ এর দশকের কলকাতা।
ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন খ্যাতনামা অভিনয়শিল্পী মাধবী মুখোপাধ্যায়, যাকে প্রথমে দেখা যায় রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন গৃহবধূ হিসেবে।
কিন্তু তৎকালীন কলকাতায় সংসার চালানোর জন্য স্বামীর আয় যথেষ্ট না হওয়ায় পরে তিনি অনেকটা জোর করেই বাড়ির বাইরে বের হন এবং একটি চাকরি নেন। এক পর্যায়ে স্বামী চাকরি চালালে পুরো সংসারের হাল ধরেন।
এমন অবস্থার মধ্যেও নিজের অফিসে ঘটে যাওয়া এক অন্যায়ের প্রতিবাদে উপার্জনের একমাত্র উৎস সেই চাকরিতে ইস্তফা দেন তিনি।
এই চলচ্চিত্রের নির্মাণশৈলীর জন্য মি. রায় যেমন সমালোচকদের প্রশংসা কুড়িয়েছেন, তেমনি ‘অসাধারণ’ অভিনয়ের মাধ্যমে তাদের নজর কেড়েছেন অভিনয়শিল্পী মাধবী মুখোপাধ্যায়।
অশনি সংকেত
সত্তরের দশকে বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘অশনি সংকেত’ সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কার জিতে নেয়।
‘সিলভার বিয়ার’ পাওয়ার নয় বছর পর সত্যজিৎ রায়ের হাতে ওঠে কানের ‘গ্লোল্ডেন বিয়ার’।
পাশাপাশি ভারতের রাষ্ট্রপতি স্বর্ণপদকসহ আরও বেশ কয়েকটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করেছে চলচ্চিত্রটি।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অশনি সংকেত’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এ সিনেমা ১৯৭৩ সালে মুক্তি পায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪৩ সালে ব্রিটিশ ভারতে, বিশেষতঃ বাংলা অঞ্চলে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক দুর্ভিক্ষ, যা তেতাল্লিশের মন্বন্তর নামে পরিচিত – তার প্রেক্ষাপট চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে।
দুর্ভিক্ষের ফলে তৎকালীন গ্রামীণ বাংলার মানুষের আর্থ- সামাজিক জীবনে যেসব সমস্যা ও পরিবর্তন ঘটিয়েছিল, সেটিই চলচ্চিত্রে ফুটে উঠেছে।
১৯৭৩ সালে বার্লিন উৎসব থেকে ফেরার সময় লন্ডনে বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, “যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, এমন একটা জায়গায় এমন কতগুলো লোকের উপর, যারা সেই যুদ্ধের থেকে বহু দূরে রয়েছে এবং তার (যুদ্ধের) কারণ কিছু বুঝতেও পারছে না, অথচ তারা (যুদ্ধের প্রভাব) দেখছে…..এই জিনিসটাই আমার কাছে বেশ আশ্চর্য লেগেছিল।”
‘অশনি সংকেত’ ছবির প্রধান দুই চরিত্রের একটি হচ্ছে অনঙ্গ বৌ, এই চরিত্রে অভিনয় করেন বাংলাদেশের এক সময়ের জনপ্রিয় অভিনেত্রী ববিতা।
সিনেমায় গল্পের প্রেক্ষাপট ছিল বাংলাদেশের একটি গ্রাম, কাজেই সেখানে গিয়েই সিনেমার দৃশ্যায়ন করার ইচ্ছা ছিল বলে বিবিসিকে বলেছিলেন মি. রায়।
কিন্তু নানা জটিলতায় সেটি সম্ভব না হলেও বাংলাদেশ থেকে কেন অভিনেত্রী ববিতাকে বেছে নিয়েছিলেন, সে গল্পটিও বিবিসি বাংলাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন মি. রায়।
বিবিসিকে মি. রায় বলেন, ছবিটার জন্য শুরু থেকেই তিনি একটি নতুন মুখ খুঁজছিলেন। তখন বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত চিত্রালী নামের একটি চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকায় তিনি প্রথম ববিতার ছবি দেখেন।
“তখন আমার মনে হলে হয়তো একে একবার দেখা চলতে পারে।….তারপর স্ক্রিন টেস্টে তিনি উৎরে গেলেন,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. রায়।
“পাটটা তাকে দিয়ে দিলাম এবং তিনি খুব ভালো অভিনয় করেছেন বলেই আমার বিশ্বাস।”
হীরক রাজার দেশে
সত্যজিৎ রায়ের এই চলচ্চিত্রটি সমালোচকদের কাছে যেমন প্রশংসিত হয়েছে, তেমনি পেয়েছে দর্শকপ্রিয়তা।
‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ সিরিজের দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘হীরক রাজার দেশে’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৮০ সালে।
প্রজাদের উপর নির্যাতন চালানো একজন স্বৈরশাসকের শেষ পরিণতি কেমন হয়, ছবিতে সেটিই তুলে ধরা হয়েছে।
মি. রায় নিজেই এই ছবির কাহিনী রচনা করেছেন।
চলচ্চিত্র সমালোচক ও গবেষকদের অনেকেই মনে করেন যে, ছবিটি রূপক এবং এর মাধ্যমে স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে এক ধরনের ‘সতর্কবার্তা’ উচ্চরণ করেছেন মি. রায়।
ছবিতে মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়টিও বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে বলেও মনে করেন তারা।
এমনকি, ছবিটির অনেক সংলাপ এবং গান এখনও বাংলা ভাষা-ভাষীদের স্বৈরশাসন বিরোধী বিভিন্ন প্রতিবাদ ও আন্দোলনে ব্যবহার হতে দেখা যায়।
শিশুসাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর জনপ্রিয় দুই চরিত্র গুপী এবং বাঘার উপস্থিতি এবং তাদের ছড়ার সুরে বলা সংলাপের কারণে শিশু-কিশোরদের কাছেও চলচ্চিত্রটি বিশেষভাবে জনপ্রিয়।
ছবিতে গুপী-বাঘা চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করে তপন চট্টোপাধ্যায় এবং রবি ঘোষ দর্শক ও সমালোচক, উভয়ের কাছ থেকেই প্রশংসা কুড়িয়েছেন।
তবে সমালোচকদের অনেকেই মনে করেন, শক্তিশালী অভিনয়ের দিকে থেকে ছবিতে তাদেরকেও ছাপিয়ে গেছেন ‘হীরক রাজা’র চরিত্রে অভিনয় করা খ্যাতনামা শিল্পী উৎপল দত্ত।
এই ছবিটির মাধ্যমে মি. রায় আরও একবার ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।