বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার কারণে বিভিন্ন সময়ে ব্যাটারিচালিত রিকশা, অটোরিকশা বা ইজিবাইক বন্ধে সরকার ঘোষণা দিলেও এটি কার্যকর করতে পারেনি। বরং রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের ঘোষণার পর দু’দিন ব্যাপী আন্দোলনের মুখে আবারো তা চালু রাখার নির্দেশ দিয়েছে সরকার।
দুপুরে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বরাত দিয়ে ব্যাটারি চালিত তিন চাকার রিকশা চালু রাখার সিদ্ধান্তের কথা জানান।
মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী এ নির্দেশ দিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, নিম্নআয়ের মানুষের কথা বিবেচনায় এ নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
তবে, শুধুমাত্র রাজধানী ঢাকা শহরে ফিডার রোডে (মূল সড়ক নয় এমন রাস্তা) এই তিন চাকার ব্যাটারিচালিত রিকশা চালু থাকবে। সারা দেশের ২২টি মহাসড়কে এসব বাহন বন্ধই থাকবে বলে জানিয়েছেন মি. কাদের।
পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাঠামোগত কারণেই এসব রিকশা সড়কের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। ২০ বছর আগে যখন এসব বাহন চালু হয় তখন সরকার নির্দিষ্ট পলিসি, মান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করলে এ পরিস্থিতি হতো না।
এখন আর রাতারাতি এসব বাহন বন্ধ করার সুযোগ নেই মনে করলেও অনিরাপদ অবস্থায় এসব বাহনের সংখ্যা যাতে না বাড়ে সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ তাদের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বাহনগুলোর উপর চালক বা মালিকদের পরিবারই নির্ভরশীল নয় বরং যাত্রীরাও অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কারণ পায়ের রিকশার তুলনায় এসব বাহনে ভাড়ার ক্ষেত্রে আর্থিক সাশ্রয় যেমন হয় তেমনি সময়ও বাঁচে অনেক। ফলে যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি এসব নির্ভরতার কারণগুলোও বিবেচনায় রাখতে হবে।
ব্যাটারিচালিত রিকশার পক্ষে-বিপক্ষে
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার অলিগলিতে পায়ে চালিত রিকশার চেয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশা বেশি। তবে, কিছু কিছু এলাকায় দিনে প্রধান সড়কে এসব রিকশার চলার অনুমতি না থাকলেও রাতে চলে সব রাস্তাতেই। আবার কিছু এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশাই বেশি এবং প্রধান সড়কেও চলতে দেখা যায়।
পূর্ব ঘোষিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ সপ্তাহের প্রথম দিন রোববার থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ ছিল। ফলে যেসব এলাকায় পায়ে চালিত রিকশার চেয়ে ব্যাটারিচালিত বাহনই বেশি ছিল ঘর সেখানে ঘর থেকে বের হয়ে বিপাকে পড়েন অনেকেই। তবে, অনেকেই আবার সাময়িক কষ্ট হলেও নিরাপত্তার কারণে এসব বাহন বন্ধ করে বিকল্প ব্যবস্থা চালু করার কথা বলছেন।
রাজধানীর মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী রাফসান আহমেদ। ক্লাস টেন পড়ুয়া এই শিক্ষার্থী সাময়িক কষ্ট হলেও অনিয়ন্ত্রিত গতির কারণে এই বাহন বন্ধের পক্ষে কথা বলেন।
“ হয়তো এখন কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু কষ্টের চাইতেও বড় আমার জীবন। ব্যাটারি রিকশাওয়ালাকে যতই বলি আস্তে চালান, উনি ততই জোরে রিক্সা চালান। বাসা থেকে যে পথে যতদূর এই রিকশায় যাওয়া যায় সেই রাস্তায় বাস চলে। তারা বেপরোয়া হয়ে বাসের সাথেও পাল্লা দেয়। পায়ের রিকশায় বেশি চালু করে এটা বন্ধ করলে সমস্যা কী? সরকার এখন আবার চালু করায় তারা আরো বেপরোয়া হয়ে যাবে,” বলেন রাফসান আহমেদ।
তবে, বেসরকারি চাকুরীজীবী মোহাম্মদ মশিউজ্জামান তরফদার এই রিকশার পক্ষেই মত দেন।
বিবিসি বাংলাকে মি. জামান বলেন, “পায়ের রিকশায় ভাড়া যেমন বেশি, সময়ও বেশি লাগে। সরকার এই রিকশাকে আইনানুযায়ী নিয়মের মধ্যে আনলেই তো হয়। তাহলে ওরাও বেপরোয়া গতিতে চালাবে না। ওদের বিভিন্ন জায়গায় চাঁদাও দিতে হবে না। ভাড়াও অনেক কমবে এতে। কয়দিন পরপর বন্ধের ঘোষণা না দিয়ে পুরোপুরি আইন করে চালু রাখা উচিত।”
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও এই বাহনের পক্ষে-বিপক্ষে দুই ধরনের মন্তব্য পাওয়া গেছে।
ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের পক্ষে যেমন অনেকে লিখেছেন, তেমনি এ ধরনের ঘোষণা নতুন করে চাঁদাবাজি বৃদ্ধির সুযোগ করে দেবে বলেও মন্তব্য করেছেন। আবার অনেকেই এসব রিকশার মান নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের ব্যবস্থা করে চালু রাখার পক্ষে মন্তব্য করেছেন।
সরকার এই রিকশা আবার চালু রাখার ঘোষণার পর ফেসবুকে এমডি নজরুল হায়দার নামে একজন লিখেছেন, “ঢাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চলার অনুমতি একটা আত্ম-ঘাতী সিদ্ধান্ত। আপনার কি মনে হয়?”
জিসান নামে এক ব্যক্তি লিখেছেন, “ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের ঘোষণা সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। তবে, আমার বিশ্বাস হয় না, উপরি রেট বৃদ্ধির জন্য নয় তো???”।
ওয়াসেক বিল্লাহ সৌধ নামে একজন এই রিকশা বন্ধের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন তুলেছেন।
তিনি লিখেছেন, “ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত কদিন পরপর কেন আসে? এই রিকশাগুলো মানুষকে কী পরিমাণ কষ্ট থেকে মুক্তি দিয়েছে, যাতায়াতের খরচ কতটা কমিয়েছে, তারা কি সরকারি কর্মকর্তা আর মন্ত্রী জানেন?”
এছাড়া এসব রিকশা চার্জ দিতে বিদ্যুৎ চুরির বিষয়টি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। বলছেন, সরকার বা নির্ধারিত সংস্থা এদের আইনের আওতায় এনে ব্যবস্থা করে দিতে পারে। তাহলে এ সমস্যার সমাধান হয়। এছাড়া পুলিশের বিরুদ্ধেও চাঁদাবাজির অভিযোগ করে অনেকে মন্তব্য করেন।
সরকারের সিদ্ধান্ত জানার পর কয়েকজন ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক বলছেন, এখন তারা বৈধভাবেই রিকশা চালাতে পারবেন। কাউকে চাঁদা দিতে হবে না বলে মনে করছেন তারা।
যা বলছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা
বাংলাদেশে ২০০৩-০৪ সাল থেকেই ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, ইজি-বাইক চীন থেকে আমদানি করা হচ্ছিল। যেগুলো কাঠামোগতভাবে কিছুটা নিরাপদ ছিল। তবে, ২০১০ সাল থেকে স্থানীয়ভাবে এসব বাহন তৈরির উদ্যোগ নেয়ার পর থেকে দেখা যায় কারিগরি মান ঠিক না থাকায় সড়কে-মহাসড়কে এসব বাহন দুর্ঘটনার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সংকটের কারণ হিসেবে পরিবহন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এম হাদিউজ্জামান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো একেবারেই অনিরাপদ।”
“কারণ পায়ে চালিত রিকশাগুলোতে মোটর লাগানো হয়েছে। কাঠামোগতভাবে একেবারেই এর সক্ষমতা নাই। কারণ মোটর লাগানোর ফলে যে গতিতে এগুলো চলে কাঠামোগতভাবে এটা সমর্থন করে না। তাই সবসময়ই এ ধরনের যানবাহনের বিপক্ষে আমাদের অবস্থান ছিল।”
তবে, দেশে ব্যাপক হারে চালু হওয়া এসব বাহন এখন আর বন্ধ করার কোনো সুযোগ নেই বলে মনে করেন তিনি। বরং এসব বাহনের দুর্বলতা নিরসন করে কিছুটা পরিবর্তন করে নিরাপদভাবে চলার উপযোগী করা যায়। একইসাথে সুনির্ধারিত পলিসি করে লাইসেন্স দিলে সরকার রাজস্ব হারাবে না বলে মনে করেন মি. হাদিউজ্জামান।
“যখন এ ধরনের যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করার কথা ছিল তখন করা হয়নি। ফলে রাতারাতি বন্ধ করার এখন আর কোনো সুযোগ নেই। তবে, এগুলোর সংখ্যা যাতে আর না বাড়ে সেজন্য নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনতে হবে। এসব বাহনের আয়ুষ্কাল নির্ধারণ করলে এগুলো ধীরে ধীরে একটা সময় বন্ধ হয়ে যাবে। তাই পলিসি মজবুত করতে হবে।”
নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে সুষ্ঠু নীতিমালা থাকলে এসব বাহন গত ২০ বছরে এতো ব্যাপক হারে বৃদ্ধি হতো না বলে মনে করছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। ফলে কারিগরি মান নির্ণয় করে রুট নির্ধারণের পর নিবন্ধনের আওতায় আনলে সরকারের কাছে এসব বাহনের সঠিক সংখ্যা থাকতো বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে, বিভিন্ন সময়ে পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যাটারিচালিত রিকশার কাছ থেকে চাঁদা নেয়ার অনেক অভিযোগ উঠেছে।
তবে, ট্রাফিক পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মুনিবুর রহমান এমন অভিযোগ অস্বীকার করেন।
বিবিসি বাংলাকে এর ব্যাখ্যা দিয়ে মি. রহমান বলেন, “যেহেতু ব্যাটারিচালিত রিকশা এতোদিন সব রাস্তায় অনুমোদিত ছিল না। তাই যেসব রাস্তায় তারা অনুমতি ছাড়াই যেতো সেখানে পুলিশ রিকশা জব্দ করে রেকার বিল নেয়। এটা চাঁদাবাজি না।”