ভারতের পশ্চিমবঙ্গে খুন হওয়া বাংলাদেশের এমপি আনোয়ারুল আজীম হত্যাকাণ্ডের ঘটনার তদন্তে নেমে নতুন নতুন তথ্য পাচ্ছে দুই দেশের পুলিশ। এরই মধ্যে কিছু খণ্ডিত হাড় ও মাংস উদ্ধার করা হয়েছে, যেগুলো মি. আজীমের মরদেহের অংশ বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এই ঘটনায় মরদেহ শনাক্তের পর তদন্ত শেষে অনেকেই গ্রেফতার হতে পারেন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।
সোমবার সচিবালয়ে এমপি আজীম হত্যাকাণ্ডের তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন তিনি।
তিনি বলেছেন, “আমরা তো এখনো বলছি সত্যের কাছাকাছি এসে গিয়েছি। ডেড বডিটা সুনিশ্চিত হলেই আপনাদের কাছে অনেক কিছু প্রকাশ করা হবে।”
এদিকে এমপি মি. আজীম হত্যায় নেপালে আটককৃত সিয়াম হোসেন রিমান্ডে থাকা অবস্থায় কলকাতা সিআইডিকে নতুন তথ্য দিচ্ছে।
জিজ্ঞাসাবাদে দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে রোববার তাকে নিয়ে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার একটি খালে অভিযান চালায় কলকাতা সিআইডি।
সেখানে ঝোপের পাশ থেকে কিছু হাড়গোড় উদ্ধার করে কলকাতা সিআইডি। যেগুলো মানুষের শরীরের হাড় বলেই ধারণা করছে পুলিশ।
উদ্ধার হওয়া মাংস ও হাড়গুলো শনাক্তে ডিএনএ নমুনা দিতে এরই মধ্যে ভারতের ভিসা সংগ্রহ করেছে পরিবার।
এমপি মি. আজীমের ব্যক্তিগত সহকারী আব্দুর রউফ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এমপি সাহেবের কন্যা ও ভাইসহ তিনজনের ভিসা সংগ্রহ হয়েছে। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে ডিএনএ নমুনা দিতে পরিবার ভারত যেতে পারে।”
গ্রেফতার হতে পারেন অনেকেই
এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তে এরই মধ্যে ভারতের সিআইডির সাথে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের গোয়েন্দা পুলিশও।
এতদিন হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে কয়েকজনকে আটকের পর গত সপ্তাহে গ্রেফতার করা হয়েছে ঝিনাইদহ জেলার এক আওয়ামী লীগ নেতাকে।
গত বৃহস্পতিবার ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবুকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
রোববার তাকে আদালতে হাজির করা হলে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়।
সোমবার সচিবালয়ে এমপি আজীম হত্যাকাণ্ড নিয়ে যখন কথা বলছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মি. খান তখন তাকে আটক আওয়ামী লীগ নেতার জড়িত থাকার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করা হয়।
জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “তদন্তটা শেষ হোক, আরো অনেকেই হয়তো গ্রেপ্তার হতে পারেন। তদন্তের আগে মনে হয় এগুলো বলা ঠিক হবে না।”
বাংলাদেশের এমপি ভারতের মাটিতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ায় কোন দেশে বিচার হবে সেটি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। তবে, নিয়ে সরাসরি কোন উত্তর দেননি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “যেখানে ঘটনা ঘটেছে সেখানে একটি মামলা হয়েছে, সেটা হতেই হবে। মাননীয় সংসদ সদস্যের কন্যা ঢাকায় একটি মামলা করেছেন। কাজেই এ ঘটনাগুলোতে দুই দেশই সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছে।”
অন্যদিকে, এই ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে যাকে অভিযুক্ত করছে পুলিশ সেই আকতারুজ্জামান শাহিন এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আছে বলে জানা যাচ্ছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বন্দি বিনিময় চুক্তি আছে, বাংলাদেশের সঙ্গে নেই। সে ক্ষেত্রে শাহিনকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনার বিষয়ে ভারত সুবিধা পেতে পারে।”
হাড়ের ডিএনএ পরীক্ষা হবে
এমপি আনোয়ারুল আজীম হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটির একটি বড় অংশ আটকে আছে এখনো পর্যন্ত মরদেহ শনাক্ত না হওয়ায়।
প্রায় দশ দিন তল্লাশি চালানোর পর গত ২৮ই মে কলকাতার সঞ্জীভা গার্ডেনের বাড়ির সেফটিক ট্যাংক থেকে প্রায় চার কেজি ওজনের মাংস উদ্ধার করে সিআইডি।
ওই বাড়িতেই মি. আজীম বাড়িতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন বলে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। তবে, এখনো পর্যন্ত ডিএনএ পরীক্ষা সম্পন্ন না হওয়ায় ওই মাংস টুকরোগুলো এমপি আজীমের কি না সেটি নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ।
এই মামলার অন্যতম আসামি সিয়াম গত সোমবার নেপালে গ্রেফতারের পর শুক্রবার তাকে কলকাতায় আনা হয়।
তাকে কয়েক দফা জিজ্ঞাসাবাদের পর রোববার মি. সিয়ামকে নিয়ে তল্লাশিতে নামে কলকাতা সিআইডি।
এসময় দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কাশিপুর এলাকার বাগজোলা খালের ঝোপের পাশ থেকে কিছু হাড়গোড় উদ্ধার করা হয়। তবে এই হাড়গুলো মি. আজীমের কি না সেটি এখনো স্পষ্ট নয়।
এগুলো উদ্ধারের পর ফরেনসিক রিপোর্টের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের সিআইডি। এগুলোকে প্রাথমিকভাবে মানুষের শরীরের হাড় হিসেবেই ধারণা করছে কলকাতা পুলিশ।
উদ্ধারের পর কলকাতার সিআইডি পুলিশ সাংবাদিকদের জানিয়েছে, তাদের ধারণা হাড়গুলো পাঁজরের খাঁচা ও হাতের হতে পারে। তবে মাথার খুলি এখনো পর্যন্ত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
শিগগিরই ভারত যাচ্ছে এমপি কন্যা ও ভাই
বাংলাদেশের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটির তদন্তের পথে বড় বাধা মরদেহ শনাক্ত না হওয়া।
এখন পর্যন্ত তদন্ত এগিয়েছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির মাধ্যমে।
দুই দফা অভিযানে দুটি আলাদা জায়গা থেকে হাড় ও মাংস উদ্ধার হলেও সেগুলো মি. আজীমের কি না, কিংবা আদৌ কোনো মানুষের কি না তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কেননা মরদেহ খণ্ড-বিখণ্ড হওয়ার কারণে বেগ পেতে হচ্ছে পুলিশকে।
সোমবার সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মি. খান বলেন, “খণ্ড-বিখণ্ড মরদেহ যে তার সেটির একটি প্রমাণ তো লাগবে। সে জন্য ডিএনএ টেস্টের প্রয়োজন। তার কন্যার সাথে ম্যাচ হয় কি না দেখেই ভারত সরকারের পুলিশ আমাদেরকে জানাবে।”
যে কারণে মি. আজীমের পরিবারের সদস্যরা এরই মধ্যে ডিএনএ টেস্টের নমুনা দিতে প্রস্তুতি নিয়েছে বলে জানা গেছে।
পুলিশ বলছে, মাংস ও হাড় উদ্ধারের ঘটনায় দুটি আলাদা ফরেনসিক রিপোর্ট প্রস্তুত করে বাংলাদেশ পুলিশকে পাঠাবে কলকাতা সিআইডি।
এমপি মি. আজীমের ব্যক্তিগত সহকারী আব্দুর রউফ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমরা যতটুকু শুনেছি একটি ফরেনসিক রিপোর্ট এরই মধ্যে এসেছে। অন্যটি আসার পরই আমাদের ডাকলে আমরা ভারত রওনা দিবো।”
পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ডিএনএ নমুনা দিতে ভারত যাওয়ার জন্য এমপি কন্যা মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন, এমপির ভাই ও ব্যক্তিগত সহকারী ভারতের ভিসা সংগ্রহ করেছে।
এমপির ব্যক্তিগত সহকারী মি. রউফ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমাদের অপেক্ষা এখন শুধু হাড়ের ফরেনসিক রিপোর্টের জন্য। সেটি আসলেই আমরা ভারত রওনা দিবো।”
এ পর্যন্ত আটক যারা
এমপি মি. আজীম হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ, ভারত ও নেপাল থেকে কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে।
এদের মধ্যে শিমুল ভুইঁয়া ওরফে আমানুল্যাহ সাঈদ, তানভীর ভুইঁয়া ও শিলাস্তি রহমান রিমান্ড শেষে কারাগারে রয়েছেন।
পুলিশ জানিয়েছে, ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বর্ণনাসহ তারা ঘটনায় জড়িত থাকার বিষয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে।
আটককৃত ওই তিন জন বর্তমানে বাংলাদেশের কারাগারে রয়েছে।
অন্যদিকে, হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে কলকাতার পুলিশ জিহাদ হাওলাদার নামে একজনকে গ্রেফতার করে শুরুতে।
কলকাতা পুলিশ দাবি করেছে মি. হাওলাদার পেশায় একজন কসাই। যে কি না সরাসরি এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল। এবং হত্যার পরে মরদেহ গুমও করেছে।
হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসার পরই মূল আসামিদের একজন হিসেবে উঠে আসে সিয়ামের নাম।
সিয়াম ভারত থেকে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল নেপালে। সেখান থেকে তাকে আটক করা হয়। আটকের পর তাকে হস্তান্তর করা হয়েছে ভারতের পুলিশের কাছে।
গত ১২ই মে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ থেকে কলকাতায় যাওয়ার পরদিন রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে যান তিনবারের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম।
এরপর ২২ই মে সকালের দিকে তার খুনের খবর প্রকাশ্যে আসে। পুলিশ বলছে, কলকাতার উপকণ্ঠে নিউটাউনের অভিজাত আবাসন সঞ্জীভা গার্ডেনসের একটি ফ্ল্যাটে আনারকে খুন করা হয়।
এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আটককৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের পর পুলিশ বলছে, খুনের আলামত মুছে ফেলতে দেহ কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়েছিল। পরে সেগুলো সুটকেস ও পলিথিনে ভরে ফেলে দেওয়া হয় বিভিন্ন জায়গায়।