বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুষায়ী আষাঢ় শুরু হয়েছে। বর্ষার শুরুতেই দেখা যাচ্ছে, আগামী কয়েক দিনের মাঝে বাংলাদেশের সিলেট ও রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলা বন্যা কবলিত হয়ে পড়তে পারে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বৃষ্টির পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেরও কয়েকটি রাজ্যে চলমান টানা ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আশংকা তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে বলা হয়েছে, সিলেট বিভাগের সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলা ঝুঁকিতে আছে।
এছাড়া, রংপুরের বিভাগ, অর্থাৎ দেশের উত্তরাঞ্চলের তিস্তা নদীর তীরবর্তী চারটি জেলা — লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও কুড়িগ্রামেও বন্যা হতে পারে।
আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, বাংলাদেশের দুই বিভাগে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার মূল কারণ ‘ভারী বৃষ্টিপাত’ ঠিক-ই, তবে সেই বৃষ্টির উৎস একই নয় – বরং, ভিন্ন ভিন্ন।
সিলেটের বন্যা নিয়ে যা জানা যাচ্ছে
বাংলাদেশের সিলেট হল মেঘনা অববাহিকার অংশ। এই অঞ্চলে এমনিতেও সারাবছর অনেক বেশি বৃষ্টিপাত হয়। কিন্তু সিলেটের অভ্যন্তরীণ বৃষ্টিপাত সাধারণত বন্যা পরিস্থিতি ডেকে আনে না।
মূলত, ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জিতে যদি এক নাগাড়ে চার-পাঁচদিন ভারী বৃষ্টিপাত হয়, তখনই উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলা বন্যা কবলিত হয়ে পড়ে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র শুক্রবার সন্ধ্যায় জানিয়েছিলো, গত ২৪ ঘণ্টায় চেরাপুঞ্জিতে প্রায় ১০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে এবং তার আগের ২৪ ঘণ্টার বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ৩৯০ মিলিমিটার।
চেরাপুঞ্জির পাশাপাশি গত আটই জুন থেকে সিলেটেও থেমে থেমে ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, ১৩ই জুন সকাল থেকে ১৪ই জুন সকাল পর্যন্ত সিলেট জেলায় ২০২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান শুক্রবার বিবিসিকে বলেছেন, “আগামী তিন থেকে পাঁচ দিনেও চেরাপুঞ্জিতে গড়ে ১০০-২০০ মিলিমিটার বা তারও বেশি বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।”
এদিকে আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলেছেন, গাণিতিক মডেল অনুযায়ী, আগামী পাঁচদিনে সিলেট ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় ৩০০-৩৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হবে।
“তবে এটি কম-বেশি হতে পারে।”
বাংলাদেশ ও ভারতের এই বৃষ্টিপাত সম্বন্ধে মি. রায়হান বলেছেন, যেহেতু এটি ভারী বৃষ্টিপাত, সেহেতু নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির একটা সম্ভাবনা আছে।
এখন পর্যন্ত সিলেটের সব নদীর পানি বিপদসীমার নীচে থাকলেও চেরাপুঞ্জির ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে তা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে।
আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই ধরনের ভারী বৃষ্টিপাত আগামী চার-পাঁচ দিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে ও পরবর্তী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মাঝে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ‘আরও বাড়বে’।
সেটি হলে “আগামী তিন-পাঁচ দিনের মাঝে” সিলেটের নদীগুলোর কয়েকটি স্টেশনের পানি বিপদসীমার উপর দিতে প্রবাহিত হওয়ার আশংকা রয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড-এর সিলেট জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, “এখন পর্যন্ত এখানে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। চেরাপুঞ্জিতে টানা চার-পাঁচদিন বৃষ্টি হলেই সিলেটের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। ওখানে বৃষ্টিপাত কমলে এখানেও বন্যা হওয়ার সম্ভাবনা কমে আসবে।”
এদিকে, মাত্র দুই সপ্তাহ আগে, মানে মে মাসের শেষ সপ্তাহে ঘূর্ণিঝড় রিমাল আঘাত হানার পর সিলেট জেলার সাতটি উপজেলা ‘আকস্মিক বন্যা’ কবলিত হয়ে পড়েছিলো।
সেবার ২৭শে মে থেকে সিলেট ও চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি শুরু হয় এবং তা চলমান থাকে ৩০শে মে পর্যন্ত।
তখন ভারতের চেরাপুঞ্জিতেও রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছিলো, যার প্রভাবে ওই বন্যা হয়েছিলো।
সিকিমের বন্যার প্রভাব বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে
এদিকে, গত ১২ই জুন, বুধবার রাত থেকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সিকিম রাজ্যের মাঙ্গান অঞ্চলে প্রবল বৃষ্টিপাত হয়।
বাংলাদেশ সময় শুক্রবার বিকাল তিনটা পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সেখানে ২৪ ঘণ্টায় ২২০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এর ফলে উত্তর সিকিমের অনেক জায়গায় ভূমিধস হয়েছে এবং তিস্তা নদীর পানির স্তর বেড়ে গেছে।
ভারতের সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানিয়েছে, পর্যটকদের খুবই প্রিয় স্থান সিকিমে ভূমিধসের কারণে কমপক্ষে ছয় জন প্রাণ হারিয়েছেন ও উত্তর সিকিমের লাচুং এলাকায় দেড় হাজারের বেশি পর্যটক আটকা পড়েছেন।
সেখানে পরিস্থিতি এমন যে বন্যার পানির তোড়ে ঘড়-বাড়ি ধসে পড়ছে, এমনকি নবনির্মিত বেইলি সেতুও ভেঙ্গে গিয়ে বিচ্ছিন্ন অবস্থা তৈরি হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে দেশটির সরকার স্যাটেলাইট বা উপগ্রহের মাধ্যমে সিকিমের প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে নজরদারি চালাচ্ছে।
এখন, ভারতের সিকিম যেহেতু তিস্তা নদীর অববাহিকার একটি অংশ, সেখানে ভারী বর্ষণ হলে তার প্রভাব সরাসরি তিস্তা নদীতে পড়ে।
আর তিস্তা নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মাত্রায় বেড়ে গেলে বাংলাদেশের তিস্তা অববাহিকার জেলাগুলোতে বন্যার পানি ঢুকে নিমাঞ্চল প্লাবিত হয়।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান বলেন, “সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গে ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। সিলেটে তার কোনও প্রভাব নাই।
কিন্তু সিকিমে যেহেতু পানি বেড়েছে, স্বাভাবিকভাবে আমাদের তিস্তা নদীতেও পানি বেড়েছে। এটি অব্যাহত থাকলে আগামী তিন থেকে পাঁচ দিনের মাঝে উত্তরাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদী বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।”
স্বল্পমেয়াদী বন্যা সাধারণত এক থেকে তিন দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। তিনি বলেন, তিস্তা নদীতে পানি বাড়লে তা খুব বেশি স্থায়ী হয় না, “পানি নেমে যায়”।
এদিকে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, ১৪ থেকে ১৮ই জুন পর্যন্ত “ময়মনসিংহ, রংপুর ও সিলেটে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাত হবে।”
যেহেতু সিকিমের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে ও বাংলাদেশের তিস্তার অববাহিকার জেলাগুলোতেও বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা আছে, তাই “একই অববাহিকা হওয়ায় তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধির ঝুঁকি আছে” বলেন মি. রায়হান।
এই সময়ের বন্যা কি অস্বাভাবিক?
কাগজে কলমে বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ হলেও আবহাওয়া অধিদপ্তর আবহাওয়ার বিচারে দেশের ঋতুচক্রকে চার ভাগে বিভক্ত করে। তা হল:
- শীতকাল (ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি)
- প্রাক-বর্ষাকাল (মার্চ-মে)
- বর্ষাকাল (জুন-সেপ্টেম্বর)
- বর্ষা পরবর্তীকাল (অক্টোবর-নভেম্বর)
আবহাওয়া অফিসের হিসাবে জুনের প্রথম সপ্তাহেই বর্ষাকাল শুরু হয়েছে।
এখন, বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে বলা হয়েছে, বছরের এই সময়ে, মানে প্রাক-বর্ষাকাল ও বর্ষাকালের মাঝামাঝিতে বন্যা হলে সেটি খুব বেশি অস্বাভাবিক না। কারণ ভৌগোলিক কারণেই এ সময় বন্যা হয়।
গত মে মাসে সিলেটে যে বন্যা হয়েছিলো, সেটিকে আকস্মিক বন্যা বলা হয়েছিলো। কিন্তু এবারের আসন্ন বন্যা ঠিক ‘আকস্মিক’ নয়।
সাধারণত যে বন্যা খুব দ্রুত সময়ে আসে, মানে বৃষ্টিপাত শুরু হওয়ার দুই থেকে তিন ঘণ্টার মাঝেই যদি নদ-নদীতে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়, তখন সেটিকে ‘আকস্মিক বন্যা’ বলা হয়।
আকস্মিক বন্যার সময়ে অল্প সময়ের মাঝে নদ-নদীতে প্রচুর পানি বাড়ে এবং তা সাধারণত অল্প সময়ের মাঝেই নেমে যায়, এটি স্থায়ী হয় না।
কিন্তু যেগুলো ‘রিভারাইন ফ্লাড’, সেগুলোর সময়ে পানি ধীরে ধীরে এলেও পানিটা দীর্ঘস্থায়ী হয়। অনেকসময় পানি নেমে যেতে সাত থেকে ১০ দিন বা আরও দীর্ঘ সময় থাকে। এতে বিস্তৃত এলাকা বন্যা কবলিত হয়।
এক্ষেত্রে, এখন যে বন্যার পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে, সেটিকে ‘মৌসুমী বন্যা’ বলছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। কারণ ফ্ল্যাশ ফ্লাড ও রিভারাইন ফ্লাড, দু’টো অনেকসময় একসাথে হয়ে যায়।
মি. রায়হান বলেন, “এখন মৌসুমি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। প্রতিবছরই এ সময়ে এরকম ছোট-খাটো বন্যা হয় ও হাওড়গুলো ডুবে যায়। এটি সাধারণ ঘটনা। সাম্প্রতিক সময়ের মাঝে ২০২২ সালের বন্যা অস্বাভাবিক ছিল।”
“উত্তরাঞ্চলের বন্যার ভয়াবহতা ব্যাপক হবে না। কিন্তু কিছু পয়েন্টে পানি বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে,” তিনি বলেন।
তিনি আরও জানান, আগামী ১০ দিনের মাঝে, মানে ২২শে জুনের দিকে ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীর পানিও বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
কারণ, এরপর বৃষ্টিপাতের পরিধিটা ধীরে ধীরে ভারতের আসামে বিস্তার লাভ করবে।
“এর ফলে এই দুই নদীর পানিও আগামী ১৬ বা ১৭ তারিখ থেকে বৃদ্ধি পেতে পারে। এটি পাঁচ-ছয়দিন অব্যাহত থাকতে পারে।”