জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্টের পদ থেকে ডঃ মতিউর রহমানকে সরিয়ে দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। তবে রোববার জারি করা ওই প্রজ্ঞাপনে কোন কারণ উল্লেখ করা হয়নি।
এদিকে মি. রহমানের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের জন্য রোববার তিন সদস্যের একটি কমিটি করার কথা জানিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ওই কমিটি ইতোমধ্যেই কাজ শুরু করেছে বলে দুপুরে এক ব্রিফিংয়ে জানিয়েছেন দুদকের সচিব খোরশেদা ইয়াসমিন।
সম্প্রতি ঈদের আগে মুশফিকার রহমান ইফাত নামে এক তরুণ পনের লাখ টাকার ছাগল কিনে আলোচনায় আসার পর সামাজিক মাধ্যম ও গণমাধ্যমে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে ওই তরুণ মি. রহমানের সন্তান। যদিও তিনি সংবাদমাধ্যমের কাছে তা অস্বীকার করেছিলেন।
পরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একজন সংসদ সদস্য একাধিক সংবাদমাধ্যমকে জানান যে, মি. রহমানেরই সন্তান ইফাত এবং ইফাতের মা মি. রহমানের দ্বিতীয় স্ত্রী। ওই সংসদ সদস্য জানান ইফাতের মা তার নিকটাত্মীয়।
এর মধ্যেই গণমাধ্যমে মি.রহমানের একের পর এক সম্পদের খবর প্রকাশিত হতে থাকে। একই সাথে প্রকাশ পায় দেশে ও বিদেশে তার সন্তান ও পরিবারের সদস্যদের বিলাসবহুল জীবনের খবর।
এমন প্রেক্ষাপটে আজ অর্থ মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনে বিসিএস শুল্ক ও আবগারী ক্যাডারের কর্মকর্তা মি. রহমানকে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করে।
কর্মকর্তারা বলছেন, যেহেতু তাকে কোন সুনির্দিষ্ট দায়িত্বে দেয়া হয়নি তার মানে হলো আপাতত পরবর্তী নির্দেশ না হওয়া পর্যন্ত তিনি সেখানে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা ওএসডি হিসেবে থাকবেন।
‘সংযুক্ত করা’ কিংবা ‘ওএসডি’ কী বার্তা দেয়
সরকারের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাদের কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে সংস্থাপন বা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের জন্য বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা ওএসডি করার বিধান আছে।
এর বাইরে অন্য বিভাগ, সংস্থা বা মন্ত্রণালয়ের জন্য ওএসডির বদলে সংযুক্ত করার পদ্ধতি চালু আছে।
আবার ওএসডি বা সংযুক্ত করা সবসময় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসাবে করা হয় না। অনেক সময় ইতিবাচক কারণেও করা হয়ে থাকে।
যেমন – কারও পদোন্নতি হলো কিন্তু পদ খালি নেই। তখন তার বেতন ভাতা যাতে বন্ধ না হয় সেজন্য তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা ওএসডি করা হয়।
তবে রাজনৈতিক কারণে ওএসডি করে অনেক কর্মকর্তাকে কাজের বাইরে রাখার একটি প্রক্রিয়াও আছে, যাকে সরকারি কর্মকর্তারা শাস্তিমূলক পদক্ষেপ বলেই মনে করেন।
যদিও ২০২০ সালের জানুয়ারিতে হাইকোর্ট এক রায়ে বলেছে সরকারি কোনো কর্মকর্তাকে ১৫০ দিনের বেশি অফিসার অন স্পেশাল ডিউটিতে (ওএসডি) রাখা যাবে না।
সাবেক যুগ্ম সচিব বিজন কান্তি সরকার বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, একজন কর্মকর্তা ভালো কাজের প্রয়োজনেও ওএসডি হতে পারেন, আবার সরকারের রোষানলে পরেও হতে পারেন।
“তবে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠলে তাকে ওএসডি বা সংযুক্ত করে রাখে মন্ত্রণালয়, যাতে তিনি চেয়ারে বসে কর্তৃত্ব করে তার বিরুদ্ধে তদন্ত বা অনুসন্ধানে বাধা না দিতে পারেন। একজন কর্মরত থাকলে তার বিরুদ্ধে তদন্ত করা যায় না,” বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন।
জানা গেছে যেসব কারণে কর্মকর্তাদের ওএসডি বা সংযুক্ত করা হয় তার মধ্যে আছে – অবসরে যাওয়ার পূর্বে প্রেষণে (অন্য কোন বিভাগে বা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত) থাকলে, কোনো কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়ার পর পরবর্তী পদায়নের আগে, উচ্চশিক্ষা ও লিয়েনের জন্য, তিন মাসের বেশি কেউ ছুটি নিলে, এনডিসি কোর্সের জন্য, বিভাগীয় মামলা ও গুরুতর অসুস্থতার কারণে, জনপ্রশাসন থেকে অবসর নিতে চাইলে এবং জনস্বার্থ ও প্রশাসনিক কারণে।
এছাড়া কেউ কোন বিভাগে সংযুক্ত থাকলে সেখান থেকে অবসর দিতে গেলে তাকে ওএসডি করা হয়।
এর বাইরে কারও বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ ওঠলে এবং সরকার সেই অভিযোগ তদন্ত করার প্রয়োজন বোধ করলে ওই কর্মকর্তাকে ওএসডি কিংবা মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করে থাকে।
কিন্তু এই ওএসডি বা সংযুক্তি কী বার্তা দেয়?
এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক যুগ্ম সচিব বিজন কান্তি সরকার বলেন, “এখানে একটি বিষয় হলো অভিযোগের ক্ষেত্রে একজন কর্মকর্তা চেয়ারে বসে কর্তৃত্ব করতে পারছেন না। ঘুষ খেতে বা দুর্নীতি করতে পারছেন না। মোট কথা অ্যাকটিভ কর্মকাণ্ডে তাকে রাখা হচ্ছে না”।
যদিও দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ডঃ ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, সরকারি সংস্থাগুলোর ট্র্যাক রেকর্ড (অতীত ইতিহাস) বলে যে কারও বিরুদ্ধে বড় ধরনের অভিযোগ ওঠলে তাকে ওএসডি বা মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয় পুরো বিষয়টা থেকে মানুষের দৃষ্টি সরিয়ে দেয়া বা ধামাচাপা দেয়ার জন্য।
“মতিউর রহমানকে মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করে মূলত এনবিআরকে প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বস্তি দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এগুলো অভিযোগ ওঠলে সুরক্ষা দেয়ার উপাদান মাত্র। অন্তত তাতে সাময়িক বরখাস্ত করে তদন্তের জন্য সংযুক্ত করার কথা বলা হলেও সেটি কিছু অর্থ বহন করতো,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
মি. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ”ধরুন রাজস্ব বোর্ড বা শুল্ক দফতরের কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলো এবং তিনি যদি সত্যিই দুর্নীতি করে থাকেন তার মানে হলো তিনি বড় বড় অংকের কর ফাঁকি দেয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন প্রভাবশালীদের জন্য।”
“এক্ষেত্রে ওএসডি বা সংযুক্তির মতো পদক্ষেপগুলো তো আসলে এক ধরনের পুরস্কার। তার সাথে যোগসাজশ করে যেসব প্রভাবশালীরা লাভবান হয়েছেন তাদের নিরাপদ রাখার জন্যও অনেক সময় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এসব পদক্ষেপ হয়, যার কোন গুরুত্ব নেই,” তিনি বলেন।
ওএসডির কিছু ঘটনা
বাংলাদেশের জামালপুরের একজন জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলনের অভিযোগ ওঠেছিলো ২০১৯ সালে। পরে ওই বছরের অগাস্টে তাকে ওএসডি করেছিলো জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
পরে তদন্তে অভিযোগ সত্যি প্রমাণিত হলে তাকে নিম্নপদে নামিয়ে দেয়া হয় এবং তিনি আর কখনোই পদোন্নতি পাবেন না বলে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য যাদের সম্মাননা দেয়া হয়েছিলো, তাদের দেয়া ক্রেস্টে স্বর্ণ জালিয়াতির অভিযোগে সাবেক সচিব কেএইচ মাসুদ সিদ্দিকীকে অনেকদিন ওএসডি করে রাখা হয়েছিলো।
তার বিরুদ্ধে নিয়ম বহির্ভূতভাবে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেয়ারও অভিযোগ ওঠেছিলো। তখন আরও কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে জালিয়াতি করে সনদ নেয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছিলো। পরে দুই সচিবকে স্বেচ্ছা অবসর দিয়েছিলো সরকার।
তবে ওএসডির ক্ষেত্রে নজিরবিহীন এক ইতিহাস হয়েছিলো সরকারের একজন সাবেক ভারপ্রাপ্ত সচিবের ক্ষেত্রে। ২০১১ সালের দশই অক্টোবর তাকে যখন ওএসডি করা হয়েছিলো তখন তিনি ভারপ্রাপ্ত সচিব।
এরপর ওএসডি থাকা অবস্থায় তিনি সচিব হন। এরপর আট বছর সচিব হয়েও ওএসডি অবস্থায় থেকেই সব সুযোগ সুবিধা নিয়ে ২০১৯ সালে তিনি অবসর ছুটিতে যান।
ওই সময় প্রায় পাঁচ শতাধিক কর্মকর্তা ওএসডি অবস্থায় ছিলেন। তবে কর্মকর্তারা বলছেন এখন ওএসডিতে থাকা কর্মকর্তার সংখ্যা খুবই কম।