একই সেলে চারজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। দীর্ঘ এক মাস ধরে তারা কৌশল করে কারাগারের ছাদে ছিদ্র করেছিল। সেই ছিদ্র দিয়ে চারজন একসাথে পালিয়ে জড়ো হয়েছিল স্থানীয় একটি বাজারেও। কিন্তু সেখান থেকে আর পালাতে পারেনি, মাত্র আধা ঘণ্টার মধ্যেই ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে!
মঙ্গলবার রাতে পুরো সিনেমার স্টাইলে এই ঘটনাটি ঘটেছে বগুড়ার জেলা কারাগারে।
কিন্তু ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হওয়ার পরও পালানোর সময় তাদের কারও পরনেই কনডেম সেলের নির্ধারিত পোশাক ছিল না কেন, প্রশ্ন উঠেছে সেটি নিয়েও।
এখনও রহস্য থেকে গেছে কারাগারে ডাণ্ডাবেড়ি খুলতে বাইরে থেকে কেউ তাদের সহযোগিতা করেছিল কি না, তা নিয়ে।
প্রাথমিকভাবে পুলিশ ধারণা করছে, কারাগারের কনডেম সেলের গোসলখানায় যে বালতি ছিল, সেই বালতির হাতল খুলে সেটিকেই ছাদ ফুটোর অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিল আসামিরা।
বগুড়া জেলা পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এত সূক্ষ কৌশলে তারা কাজটি করেছে যে বাইরে থেকে বোঝার কোনও উপায় ছিল না। পুরো কাজটি তারা করেছে প্রায় একমাস ধরে।”
পুলিশ বলছে, কারাগারের এই কনডেম সেলগুলোতে একজন আসামির থাকার কথা। কিন্তু সেখানে চারজনকে রাখা হয়েছিল এক সেলে।
আটকের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশের কাছে কিছু তথ্য দিয়েছে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ওই আসামিরা।
কারাগার পরিচালনা কমিটির দায়িত্বে থাকা বগুড়ার জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “পুরো ভবনের এই কারাগারের ছাদটি ছিল ছিল চুন সুড়কির। যে কারণে ছাদে কোনও রড ছিল না। ওই আসামিরা বিছানার চাদর দিয়ে পাটাতন তৈরি করে প্রায় এক মাস ধরে ছাদটি ফুটো করেছিল।”
এই ঘটনায় ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে কমিটিকে রিপোর্ট দিতেও বলা হয়েছে।
পালিয়ে যাওয়া কয়েদি কারা?
বগুড়া জেলা কারাগারের পূর্ব-উত্তর কোণে তিনটি কনডেম সেল রয়েছে। সেখানে ১৩ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদিকে রাখা হয়েছে।
ওই চারজনকে রাখা হয়েছিল একটি কনডেম সেলে। তারা বিভিন্ন মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ছিলেন।
ওই চার আসামি প্রায় একমাস ধরে কনডেম সেল থেকে পালানোর পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়ন করেছিলেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।
পালিয়ে যাওয়ার পর গ্রেফতারকৃত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী উপজেলার দিয়াডাঙ্গা গ্রামের মৃত আজিজুল হকের ছেলে নজরুল ইসলাম মঞ্জুর, নরসিংদীর মাধবদী উপজেলার ফজরকান্দি গ্রামের মৃত ইস্রাফিল খাঁর ছেলে আমির হোসেন, বগুড়া সদরের কুটুরবাড়ির ইসমাইল শেখ চাঁদ মিয়ার ছেলে ফরিদ শেখ এবং বগুড়ার কাহালু উপজেলার উলট পূর্বপাড়ার আবদুল মান্নানের মো. জাকারিয়া।
পুলিশ বলছে, মো. জাকারিয়া বগুড়ার কাহালুর শিশু নাইমকে হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ছিলেন। আর নজরুল ইসলাম মঞ্জুর ও আমির হোসেন চারটি হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত।
বগুড়া জেলা পুলিশ সুপার মি. চক্রবর্তী বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ওই চার আসামি একই দিন একটি কনডেম সেলে আসেনি। ভিন্ন ভিন্ন দিনে তাদের চারজনকে এক সেলে রাখা হয়েছিল।”
পালাতে যে কৌশল নিয়েছিল আসামিরা
বগুড়ার জেলা কারাগারটি পুরনো ব্রিটিশ আমলের। কারাগারের ভবনের এই ছাদটি ছিল ছিল চুন সুড়কির ছাদ। চুন সুড়কির ছাদ নির্মাণে রডের ব্যবহার হত না। এবং কারাগারের এই ছাদেও রড ছিল না বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।
মঙ্গলবার ভোররাতে ওই চার আসামি পালানোর পর তাদের যখন গ্রেফতার করা হয় তারপর তাদের জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়েছে।
সকালে কারাগার পরিদর্শন করেছেন জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী-সহ জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর পুলিশ বলছে, ওই চার আসামি প্রায় একমাস ধরে এই পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়ন করেছে। তারা খুব কৌশলে ছাদ ফুটো করার জায়গা নির্ধারণ করে।
পুলিশ সুপার মি. চক্রবর্তী বিবিসি বাংলাকে বলেন, “কনডেম সেলের মূল ফটকের বাম পাশে সাধারণত কারও নজর পড়ে না। ওই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা এই জায়গাটা নির্বাচন করেছিল।”
তিনি জানান, “দরজা খুলছে, খাবার দিছে। ওই জায়গা একটা কর্নার হওয়ার কারণে সাধারণত কারও নজরে পড়েনি। কেউ ভেতরে না ঢুকলে বাইরে থেকে বোঝার কোনও উপায় নেই।”
পুলিশের ধারণা বাইরে থেকে তাদের আত্নীয় স্বজন কেউ যখন দেখা করতে এসেছে তাদের কেউ কোনও ধরনের বস্তু সরবরাহ করেছে যেটি তারা হ্যান্ডক্যাপ বা পায়ের ডাণ্ডাবেড়ি খুলতে ব্যবহার করেছে।
পুলিশ সুপার মি. চক্রবর্তী বলেন, “ওই কনডেম সেলের সাথেই বাথরুম যুক্ত ছিল। এই বাথরুমের বালতির হ্যান্ডেলের লোহা খুলে সোজা করে একমাস ধরে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ছিদ্র করছে তারা।”
জেলা প্রশাসক মি. ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “যাতে কেউ বুঝতে না পারে সে কারণে চুন সুড়কিগুলো নিচে পড়ার পর সেগুলো একটা ব্যাগের মধ্যে লুকিয়ে রাখত আসামিরা। আমরা তদন্ত করে দেখব এখানে অন্য কোনও অস্ত্র ব্যবহার হয়েছে কি না!”
এত বিছানার চাদর ও গামছা নিয়ে প্রশ্ন পুলিশের
পুলিশ বলছে মূলত কনডেম সেলে একজন থাকার কথা। কিন্তু জায়গা সংকটের কারণে এক সেলে চারজনকে রাখা হয়েছিল। এক কক্ষে গাদাগাদি করে থাকার কারণে ভেতরে কারও প্রতি নজর রাখা হত না খুব একটা।
পালানোর পর বুধবার সকালে ওই কক্ষ পরিদর্শনকালে পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন বেশ কিছু ছবি তোলে। তাতে দেখা যায় উঁচু ছাদে উঠতে বেশি কিছু বিছানার চাদর ও গামছা দিয়ে কৌশলে পাটাতন তৈরি করা হয়েছে।
যে পাটাতনের ওপর বসে সময় নিয়ে ধীরে ধীরে বেশ কয়েকদিন ধরে ছাদ ফুটো করছিল আসামীরা।
একটি ছবিতে দেখা যায় খুব সূক্ষভাবেই ফুটো অবস্থায় আছে সেই ছাদটি। এর ঠিক নিচে কয়েকটি বিছানার চাদর জোড়া দিয়ে হাতল তৈরি করা হয়েছে।
এছাড়া কারাগারের বাইরের বড় দেওয়ালেও বিশাল বিছানার চাদর জোড়া দিয়ে ঝুলন্ত পথও তৈরি করা হয়েছে, এমনটি দেখা গেছে আরেকটি ছবিতে।
পুলিশ সুপার মি. চক্রবর্তী বিবিসি বাংলাকে বলেন, “চারজন মানুষের জন্য যে পরিমাণ বেডশিট ও গামছা দরকার তার থেকে অনেক বেশি বেডশিট ও গামছা পেয়েছি আমরা। এত বিছানা চাদর ও গামছা কীভাবে এল আমাদের জানা নেই।”
পুলিশ বলছে, প্রিজন সেলের সামনের খোলা জায়গার চারদিক দিয়ে লোহার খাঁচা বানানো হয়েছে যাতে কোন আসামি পালাতে না পারে। সেই খাঁচার দুই পাশের লোহার গেট বেয়ে আসামিরা ছাদে ওঠে। এরপর সীমানা প্রাচীরে উঠে বিছানার চাদরের তৈরি রশি বেয়ে কারাগার থেকে পালায়।
জেলা প্রশাসক মি. ইসলাম বলছেন, “এই ঘটনায় বাইরের কারও যোগাযোগ থাকতেও পারে। সেখান থেকে কোনও ধরনের সহযোগিতা নিয়েছে কি না, আমরা সেটি খতিয়ে দেখব।”
পালানোর পর ধরা পড়ল যেভাবে
মঙ্গলবার রাত ৩টা ৫৫ মিনিটের দিকে ওই চার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সুরক্ষিত জেলের কনডেম সেল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর টের পান একজন কারারক্ষী।
তখন ওই কারারক্ষী বিষয়টি জেল সুপারকে জানানোর পর জেল সুপার তা জেলা প্রশাসক ও পুলিশকে জানান।
জেলা প্রশাসক মি. ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “জেল সুপার রাত ৩টা ৫৫ মিনিটে আমাকে ফোন দেওয়ার পরই অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে ও পুলিশকে বলেছি। সদর থানায় নিরাপত্তা চৌকি বসিয়ে সিল করে দেয়া হয়েছিল। যাতে আসামিরা কোথাও না যেতে পারে।”
ততক্ষণে ওই কয়েদিরা করতোয়া নদীর সেতু পার হয়ে পাশের চেলোপাড়ার চাষি বাজার এলাকায় একত্রিত হয়। সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করে।
এ সময় তাদের কারও গায়ে কয়েদির কোনও পোশাক ছিল না। তখন সেখানে পুলিশের এক সাব ইন্সপেক্টর সাদা পোশাকে ছিল।
পুলিশ সুপার মি. চক্রবর্তী বিবিসি বাংলাকে বলেন, পালিয়ে আসা কয়েদিরা পুলিশের সাথে ওয়ারলেস দেখতে পেয়ে অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করে। পুলিশের সন্দেহ হলে তখন ফরিদ নামের কয়েদির হাতে লাল কালির কাগজ দেখতে পেয়ে সে নিশ্চিত হয়ে তাদেরকে ধরে ফেলে।
এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “আমাদের ওই কর্মকর্তাও জানতেন না যে এই চারজন কয়েদি। কারণ তাদের গায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির পোশাক ছিল না।”
ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ার পরও কীভাবে তারা সাধারণ পোশাকে ছিল, সেই উত্তরও খুঁজছে পুলিশ।
তদন্ত কমিটি গঠন
পালিয়ে যাওয়া ওই কয়েদিদের আটকের পরই পুরো ঘটনার খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কারাগার পরিদর্শনে আসেন রাজশাহীর ডিআইজি প্রিজন কামাল হোসেন।
বুধবার ঘটনাটির তদন্তে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন বগুড়া কারাগার, পুলিশ, র্যাব, গণপূর্ত ও ফায়ার সার্ভিসের প্রতিনিধিরা।
বগুড়ার জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বিবিসিকে বলেন, “আমরা সাত কার্য দিবস সময় দিয়েছি তদন্ত টিমকে। কারও কোনও গাফিলতি আছে কি না পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য। এখানে জেল সুপার থেকে শুরু করে সবার বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য আমরা বলেছি।”
অন্যদিকে সুরক্ষিত বগুড়া জেলা কারাগারের কনডেম সেলের ছাদ কীভাবে ছিদ্র করে ফাঁসির আসামিরা পালিয়ে গেলেন এবং তাদের গায়ে জেলের পোশাক না থাকা নিয়েও নানান প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।
এ ব্যাপারে বগুড়া জেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবহেলাকে দায়ী করছেন কেউ কেউ। তবে বগুড়া কারাগারের জেল সুপার আনোয়ার হোসেনের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
এই ঘটনায় জেল পালানোর জন্য ওই চার আসামীর বিরুদ্ধে মামলা করার কথাও জানিয়েছেন জেলা পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী।