সম্প্রতি নেটফ্লিক্সে মুক্তি পাওয়া ফিল্ম ‘মহারাজ’ নিয়ে দুটি কারণে আলোচনা হচ্ছে।প্রথমত: ভারতীয় সমাজের কিছু কু-নীতির বিরুদ্ধে যেভাবে এক সাংবাদিক একশো বছরেরও বেশি সময় আগে লড়াই করেছিলেন, সেই কাহিনী। দ্বিতীয়ত: এই সিনেমাটিতে প্রথমবার অভিনয় করেছেন বলিউডের ‘মিস্টার পার্ফেকশনিস্ট’ বলে পরিচিত আমীর খানের পুত্র জুনেইদ খান।
সিনেমাটি তৈরি হয়েছে ২০১৪ সালে প্রকাশিত গুজরাতের সাংবাদিক সৌরভ শর্মার উপন্যাস ‘মহারাজ’-এর কাহিনীর ভিত্তিতে।
এই সিনেমাটিতে করসনদাস নামের এক সাংবাদিকের সমাজ সংস্কার ও সমাজের খারাপ রীতিনীতিগুলির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কাহিনী পর্দায় তুলে ধরা হয়েছে।
সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত সিনেমাটিতে দেখানো হয়েছে যে, ১৮৬২ সালে এক ধর্মীয় গুরুর যৌন নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে এক সাংবাদিক লেখালেখি শুরু করেন। ওই সব লেখালেখির কারণে ওই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে বোম্বে হাইকোর্টে একটি মানহানির মামলা দায়ের হয়েছিল। ওই মামলাটি আলাদা এক ইতিহাস হয়ে আছে।
প্রায় দেড় শতাব্দী আগে ভারতীয় সমাজে নারীদের ওপরে যৌন নির্যাতন ও রক্ষণশীল ধর্মীয় রীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলেন কে এই সাংবাদিক?
কে এই করসনদাস মুলজি?
বিএন মোতিওয়ালার লেখা করসনদাস মুলজির জীবনী প্রকাশিত হয় ১৯৩৫ সালে। ওই বইটির তথ্য অনুযায়ী মি. মুলজি ১৮৩২ সালের ২৫শে জুলাই বোম্বের (এখনকার মুম্বাই) এক গুজরাতি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় একটি গুজরাতি স্কুলে, তবে পরে তিনি ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে ভর্তি হন।
‘মহারাজ’ সিনেমাটিতে দেখানো হয়েছে যে ছোটবেলা থেকেই তিনি প্রতিভাবান ছিলেন এবং সমাজের রীতিনীতি সম্পর্কে প্রশ্ন ওঠাতেন। তিনি মাঝে মাঝেই পরিবারের সদস্যদের সামনে এমন সব প্রশ্ন তুলতেন, যেগুলোকে মনে করা হত সামাজিক আচার ও মূল্যবোধের পরিপন্থী।
যেমন তিনি প্রশ্ন করেছিলে, “আমরা কেন প্রতিদিন মন্দিরে যাই? ঈশ্বর কি গুজরাতি ভাষা বোঝেন? উনি (ভগবান) কি আমাদের গ্রামের? আর নারীরা সবসময় ঘোমটা দেয় কেন?”
করসনদাস মুলজি ছিলেন গুজরাতি ভাষার সাংবাদিক। ধর্মের নামে নারীদের যৌন শোষণের বিরুদ্ধে লিখতে শুরু করেছিলেন তিনি।
সাংবাদিকতা ও সামাজিক রীতিনীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে গিয়ে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাঁকে।
যেভাবে নারী ভক্তদের যৌন শোষণ করত ‘মহারাজ’
সিনেমায় যে মহারাজার কথা দেখানো হয়েছে, সেই যদুনাথ জি মহারাজ ছিলেন ‘বৈষ্ণব পুষ্টিমার্গ’ সম্প্রদায়ের একজন গণ্যমান্য ধর্মগুরু। তিনি শ্রীকৃষ্ণের উপাসনা করতেন। এই সম্প্রদায়ের ধর্মগুরুরা নিজেদের ‘মহারাজ’ বলে পরিচয় দিতেন।
গুজরাত, কাথিয়াওয়াড়, কচ্ছ এবং মধ্য ভারতে ‘পুষ্টিমার্গ’-এর অনুগামীদের মধ্যে ধনী ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে কৃষক সকলেই থাকতেন। এদের মধ্যে ভাটিয়া এবং বানিয়ার মতো প্রভাবশালী জাতির মানুষজনও থাকতেন।
এই সম্প্রদায়ের ধর্মগুরুরা ‘চরণ সেবা’ নামের একটি আচার পালন করতেন। এই ধর্মীয় আচারের নামে ধর্মগুরুরা তার নারী ভক্তদের বিশ্বাসের অপব্যবহার করে তাদের ওপর যৌন শোষণ চালাতেন।
ভারতের পরিচিত পত্রিকা ‘ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি’-তে অনু কুমার লিখেছেন, “মহারাজ তাঁর নারী ভক্তদের সঙ্গে কেবল শারীরিক সম্পর্কই করতেন না, তিনি আশা করতেন যে তাঁর পুরুষ ভক্তরা গুরুদের যৌন তৃপ্তির জন্য নিজের স্ত্রীদেরও উৎসর্গ করবেন।“
করসনদাসের মতো সমাজ সংস্কারকরা ধর্ম ও বিশ্বাসের এই ধরনের অপব্যবহার খুব ভালভাবেই ধরে ফেলেছিলেন কিন্তু ওইসব ‘মহারাজা’দের ভক্ত এবং নিজের পরিবারের প্রবল বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়েছিল।
তিনি প্রথমে দাদা ভাই নওরোজির পত্রিকা ‘রস্ত গুফতার’-এ লিখলেও পরে ‘সত্য প্রকাশ’ নামে নিজেরই একটা পত্রিকা শুরু করেন। ‘চরণ সেবা’ নামের ওই কুপ্রথার বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার জন্য করসনদাসকে বাড়ি থেকে বার করে দেওয়া হয়েছিল। তবুও তিনি তাঁর সাংবাদিকতার মাধ্যমে ‘মহারাজ’-দের ওই যৌন শোষণের বিরুদ্ধে লেখা বন্ধ করেন নি।
মানহানির মামলা
ধর্মগুরু যদুনাথ মহারাজের বিরুদ্ধে ধর্মের নামে নারীদের যৌন নির্যাতনের অভিযোগ এনে তার পত্রিকায় প্রবন্ধ লেখার জন্য সাংবাদিক করসনদাস মুলজির বিরুদ্ধে বম্বে হাইকোর্টে মানহানির মামলা হয়েছিল।
ওই ‘মহারাজ’-এর হয়ে ১৮৬২ সালে মামলাটি দায়ের করা হয়।
ওই মামলায় করসনদাস পাল্টা যুক্তি দিয়েছিলেন যে তার বদলে মহারাজ যদুনাথের বিচার করা উচিত। কারণ হিসাবে তিনি বলেছিলেন যে ‘পুষ্টিমার্গ’ সত্যিকারের কোনও হিন্দু সম্প্রদায় নয়, বরং একটি বিপথগামী গোষ্ঠী, যার সদস্য ভক্তরা তাদের ‘মহারাজ’কে সন্তুষ্ট করার জন্য নিজের স্ত্রী ও কন্যাদেরও তার হাতে তুলে দিতেন।
ঘটনাচক্রে করসনদাস মুলজির নিজের পরিবারও ওই ‘পুষ্টিমার্গ’ সম্প্রদায়ের ‘মহারাজ’কে শ্রদ্ধা করত।
মহারাজ যদুনাথের ওই মামলা আদালতে ২৪ দিন ধরে চলেছিল। মহারাজ তাঁর চরিত্রের স্বচ্ছতা প্রমাণ করার জন্য বেশ কয়েকজন সাক্ষী হাজির করেছিলেন।
মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছিলেন ‘মহারাজ’ যদুনাথের ব্যক্তিগত চিকিৎসকও। তিনি বলেছিলেন যে যদুনাথ ও অন্যান্য ‘মহারাজ’দের যৌনরোগের চিকিৎসা করেছিলেন। বহু নারী ভক্তের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক থাকায় তাঁর যৌনরোগ হয়েছিল বলে চিকিৎসক আদালতে জানিয়েছিলেন।
এই ঐতিহাসিক মানহানির মামলায় জয়ী হয়েছিলেন মি. করসনদাস।
সংবাদমাধ্যমের একটি অংশ মি. মুলজির মামলা জয়কে খুব প্রশংসার চোখে দেখেছিল আর স্থানীয় ইংরেজি খবরের কাগজগুলি তাকে ‘ভারতীয় লুথার’ উপাধি দিয়েছিল।
সমাজ থেকে বহিষ্কৃত
করসনদাস মুলজির সমসাময়িক ও তাঁর সংবাদপত্রের সহকারী মাধবদাস রঘুনাথদাস একটা বই লিখেছিলেন ১৮৯০ সালে। সেই বইয়ে তিনি লিখেছিলেন যে কীভাবে মি. মুলজির সহায়তায় তিনি এক বিধবাকে বিয়ে করেছিলেন।
তিনি লিখেছিলেন, একজন বিধবার পুনর্বিবাহ কোন সাধারণ বিষয় না। ওই বিয়েটিকে সুষ্ঠুভাবে শেষ করার জন্য তাদের বেশ কিছু নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হয়েছিল।
করসনদাস মুলজি নিজেই কনের বাবার পরিবর্তে কন্যাদান করেছিলেন। তবে ওই বিয়ের কারণে সমাজের রক্ষণশীল অংশের তীব্র প্রতিক্রিয়া হবে, এমন আশঙ্কা ছিল। রাতে কোনও রকম হামলা হলে যাতে নিরাপদ থাকেন তারা, এজন্য এক ব্রিটিশ ইন্সপেক্টর তাদের কিছু লাঠি দিয়ে রেখেছিলেন।
রঘুনাথদাস লিখেছেন, “সাবধানতার জন্য আমরা নিজেরাই সেখানে চারজন শক্তিশালী পাঠান রেখেছিলাম।“
করসনদাস মুলজি সমাজকে অন্যভাবেও চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। মাধবদাস রঘুনাথদাস লিখেছেন যে তিনি ‘অশুদ্ধ ম্লেচ্ছ ও অসুরদের দেশে’ ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
হিন্দু সমাজের একটি অংশের উল্লেখ করে রঘুনাথদাস লিখেছেন, “তাদের কাছে ইউরোপ যাত্রা করসনদাসের অপরাধের তালিকায় সবথেকে বড় অপরাধ ছিল, এমন কি বিধবাকে বিয়ে করার থেকেও বড় অপরাধ ছিল সেটা।“
রঘুনাথদাস লিখেছেন, “ম্লেচ্ছের দেশে যাওয়ার অপরাধে করসনদাসকে সমাজ থেকে বয়কট করা হয়েছিল। তার স্ত্রী ও ছোট সন্তানদেরও বিনা দোষে বার করে দেওয়া হয় সমাজ থেকে।“
করসনদাসের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী ও সন্তানরা ক্ষমা চেয়ে নিক, এমনটাই চেয়েছিলেন সম্প্রদায়ের নেতারা। তারা বলেছিলেন যে সারা শরীরে গোবর ঘষে নাসিকের পবিত্র নদীতে নিজের ‘পাপ’ যেন ধুয়ে ফেলেন মি. মুলজির স্ত্রী-সন্তানরা।