বাংলাদেশের সংসদে আইন পাশ করে সরকারি চাকরিতে সকল গ্রেডে কোটা সংস্কারের দাবিতে বৃহস্পতিবার আবারও বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি পালন করে শিক্ষার্থীরা। পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে রাজধানী ঢাকার শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেয় তারা। এছাড়া, কুমিল্লায় কর্মসূচি চলাকালে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
কেন্দ্রীয়ভাবে বিকেল সাড়ে তিনটা থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করা হলেও শিক্ষার্থীরা পাঁচটার কিছু আগে মিছিল নিয়ে শাহবাগের দিকে অগ্রসর হন।
গত কয়েকদিনের তুলনায় বৃহস্পতিবার অধিক প্রস্তুতি ও সতর্কতা নিয়ে মাঠে নামতে দেখা গেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে।
শাহবাগ থেকে বিবিসি বাংলার সংবাদদাতা শাহনেওয়াজ রকি জানান, আর্মড পার্সোনেল ক্যারিয়ার (এপিসি), জলকামান, অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে আগে থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অবস্থান নেয় পুলিশ।
ক্যাম্পাসে থেকে শাহবাগ মোড়ে যাওয়ার রাস্তায় ব্যারিকেডও দেয়া হয়।
তবে, শিক্ষার্থীরা ব্যারিকেড ভেঙে মোড়ে চলে যান এবং সেখানে অবস্থান নেন।
এসময় কাউকে কাউকে পুলিশের এপিসির উপরও উঠে বসতে দেখা যায়।
শিক্ষার্থীদের কর্মসূচি চলাকালে শাহবাগ মোড় কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। আশেপাশের সড়কে যানজট দেখা দেয়।
রাত ৯টা পর্যন্ত শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি হিসেবে শুক্রবার বিকেলে সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভের ডাক দেওয়া হয়েছে।
আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করে বলেন, কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ হামলা চালিয়েছে। কোটা সংস্কারের দাবির পাশাপাশি এই হামলার প্রতিবাদে আগামীকাল (শুক্রবার) বিকেল চারটায় সব ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করা হবে।
দেশের অন্যান্য স্থানেও বাংলা ব্লকেড পালন করেছে শিক্ষার্থীরা। সবখানেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনীর ব্যাপক উপস্থিতি দেখা গেছে।
এদিন দুপুরে ডিএমপি’র পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, “যদি আন্দোলনের নামে জনদুর্ভোগসৃষ্টি করা হয় তাহলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
“বাংলা ব্লকেড” কর্মসূচি চলাকালে কুমিল্লায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষে অন্তত ১৫ জন আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
স্থানীয় সাংবাদিক খোকন চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে জানান, আহতদের মধ্যে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সাংবাদিকও আছেন।
“আহতদের অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে,” যোগ করেন তিনি।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
খোকন চৌধুরী জানান, শিক্ষার্থীরা ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করার জন্য ক্যাম্পাস থেকে মিছিল নিয়ে বের হলে বাধা দেয় পুলিশ। এ সময় উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃ্ষ্টি হয়।
এক পর্যায়ে সেটি ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষে রূপ নেয়।
এর বাইরে রাজধানীর আগারগাঁও এবং চট্টগ্রাম ও সাভারেও সড়ক অবরোধ করেছেন শিক্ষার্থীরা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বিপুল সংখ্যক পুলিশের উপস্থিতি দেখা গেছে। ঢাকা আরিচা মহাসড়কের ওই যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে এ নিয়ে টানা ১১ দিন ধরে কর্মসূচি পালন করেছেন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
স্লোগানের পাশাপাশি শাহবাগে জড়ো হওয়া আন্দোলনকারীরা রাস্তায় অবস্থান নিয়ে প্রতিবাদী গান ও কবিতা আবৃত্তি করেন।
এসময় সেখান থেকে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বাধা দেয়া ও হামলার নিন্দা জানানো হয়।
এসব হামলায় বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন বলে দাবি আন্দোলনকারীদের।
বিবিসি বাংলার সংবাদদাতা জানিয়েছেন, শাহবাগে যখন কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের ‘ব্লকেড’ চলছে তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে অবস্থান নেয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেনসহ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতাদেরও সেখানে বক্তব্য রাখতে দেখা গেছে।
এর আগে দুপুরে মধুর ক্যান্টিনে কোটা ইস্যুতে সংবাদ সম্মেলন করে ছাত্রলীগ।
সেখানে “এ আন্দোলনে কোনো প্রতিপক্ষ নেই” মন্তব্য করে মি. সাদ্দাম বলেন, ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনকে প্রলম্বিত করে রাজনৈতিক রূপ দেওয়া চেষ্টা করা হচ্ছে।”
কোটা নিয়ে সাম্প্রতিক আন্দোলন যে কারণে
২০১৮ সাল পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা প্রচলিত ছিল বাংলাদেশে। তার মাঝে ৩০ শতাংশই ছিল মুক্তিযোদ্ধা কোটা।
বাকি কোটার মাঝে ১০ শতাংশ নারী কোটা, ১০ শতাংশ জেলা কোটা, ৫ শতাংশ কোটা ছিল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জন্য এবং এক শতাংশ কোটা ছিল প্রতিবন্ধীদের।
ওই বছরই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কারের দাবিতে কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু করে। শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল যে কোটা ৫৬ শতাংশ না হয়ে ১০ শতাংশ করা হোক।
তাদের দাবির মুখে সে বছর প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে পুরো কোটা পদ্ধতিই বাতিল করে একটি পরিপত্র জারি করেছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
সেসময় কোটা পদ্ধতি বাতিলের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে বলেছিলেন, “কোটা পদ্ধতি থাকলেই এ ধরনের আন্দোলন হবে বার বার হবে। প্রতিবন্ধী বা ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী যারা আছেন তাদেরকে আমরা অন্যভাবে চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে পারবো।”
কিন্তু ২০২১ সালে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা ফিরে পাবার জন্য উচ্চ আদালতে রিট করেন এবং গত পাঁচই জুন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের সরকারি সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয় হাইকোর্ট।
হাইকোর্টের ওই রায়ের পর গত ছয় জুন থেকেই আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা। তবে কিছুদিন আন্দোলন চললেও মুসলিমদের অন্যতম বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদ-উল-আজহা চলে আসায় ২৯শে জুন পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত রাখেন শিক্ষার্থীরা।
এরপর গত ৩০শে জুন থেকে ফের আন্দোলন শুরু করেন তারা এবং পহেলা জুলাই থেকে এই আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।
বুধবার আপিল বিভাগ হাইকোর্টের সেই রায়ে চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থার আদেশ দিলেও শিক্ষার্থীরা জানায় তারা তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাবে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবি সরকারকে কোটা ইস্যুর একটি স্থায়ী সমাধান করতে হবে।
শিক্ষার্থীদের দাবি সব ধরনের সরকারি চাকরিতে কোটা ৫ শতাংশে নিয়ে আসতে হবে।
দাবি আদায়ের লক্ষ্যে বুধবার সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা অবরোধও পালন করেছে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।