“এ ধরনের এক্সপেরিয়েন্স আগে কখনো হয়নি। আর্থিক ক্ষতিতো হচ্ছেই, রেপুটেশনও নষ্ট হচ্ছে। কারণ সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আমি যে কী প্রব্লেম ফেইস করছি সেটাও ক্লায়েন্টকে জানাতে পারছি না। তারা হয়তোবা ভাবছে আমি হয়তো ইচ্ছে করে যোগাযোগ করছি না বা অন্য কিছু। আমারতো যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ইমেইল,” হতাশা প্রকাশ করে বলছিলেন ফ্রিল্যান্সার কামরুজ্জামান শিশির।
গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে ব্রডব্যান্ড ও মোবাইলে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হওয়ায় আর্থিক ক্ষতি এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে যে শঙ্কায় রয়েছেন বিবিসি বাংলার কাছে সেটিএভাবেই তুলে ধরলেন মি. শিশির।
বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলা বিক্ষোভ ও সংঘাতের এক পর্যায়ে সরকার পুরোপুরি ব্রডব্যান্ড ও মোবাইল ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেয়।
প্রথমে বেশ কিছু এলাকায় ইন্টারনেটের গতি ধীর করা হয়। কিন্তু বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে আটটার পর থেকে সারা দেশে একেবারেই বন্ধ করে দেয়া হয় ইন্টারনেট।
এর ফলে বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের যেসব ব্যবসা রয়েছে ইন্টারনেট সংযোগ না থাকার কারণে বন্ধ হয়ে যায় তাদের কার্যক্রম।
মঙ্গলবার রাত থেকে সীমিত পরিসরে ইন্টারনেট সেবা দেয়া হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, আর্থিকভাবে আপাতত এ কয়েক দিনের ক্ষতির হিসাব করা গেলেও দীর্ঘস্থায়ী যে ক্ষতি হতে যাচ্ছে সেটির প্রভাব মারাত্মক। কারণ বিদেশি ক্লায়েন্টরা চুক্তি অনুযায়ী কাজ না পেলে অর্ডার বাতিল করে দেবে।
একইসাথে নেতিবাচক রিভিউ দেবে যার কারণে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি বা ফ্রিল্যান্সারের পরবর্তীতে নতুন ক্লায়েন্টের কাজ পেতে অসুবিধা হবে।
যা বলছেন তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ফ্রিল্যান্সাররা
তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ফ্রিল্যান্সিং করেন এমন ব্যবসায়ীরা বলছেন, টানা পাঁচদিন ইন্টারনেট বন্ধ থাকলেও আর্থিক ক্ষতির হিসাব এখনই পুরোপুরি করা যাচ্ছে না। কারণ বিদেশি ক্রেতারা ডেলিভারি না পেয়ে কী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেটিও এখন বোঝা যাচ্ছে না।
এমনকি এ কয়েক দিনে নতুন কাজ দেয়ার জন্য কেউ যোগাযোগ করেছেন কি না তাও ইন্টারনেট ছাড়া জানা যাচ্ছে না। গতকাল থেকে সীমিতভাবে ইন্টারনেট দেয়া হলেও ঢাকার সব এলাকায় দেয়া হয়নি। ফলে এখনও সংযোগ পাননি অনেক ফ্রিল্যান্সার।
মি. শিশির বলেন, “দুই-তিনটা কাজ ছিল। যেগুলো শনিবার ডেলিভারি দেবার কথা ছিল। আমার বেশিরভাগ ক্লায়েন্টই দেশের বাইরের। লোকাল মার্কেটে আমার ক্লায়েন্ট কম। আবার এই কয়দিনে নতুন অর্ডারও হয়তোবা আসতো। সে হিসেবে পাঁচ দিনে অন্তত পাঁচশো থেকে ছয়শো ডলার ক্ষতি হয়েছে। তবে এর চেয়েও বেশি হবে এটা। কারণ আমাদের অটোমেটিক অর্ডার আসে । ফলে কেউ এ সময়ের ভেতর কেউ মেসেজ বা রিচ করতে চেয়েছে কি না সেটাও বলতে পারছি না।”
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ইন্টারনেট সংযোগ না থাকার কারণে কোনোভাবেই বিদেশি ক্লায়েন্টদের গত কয়েকদিনের পরিস্থিতি জানানো যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে দেরিতে কাজের ডেলিভারি দিলে তারা নেতিবাচক ফিডব্যাক অথবা অর্ডার ক্যান্সেল করতে পারে।
“মার্কেট প্লেসগুলোতে টাইমলি ডেলিভারি না দিলে র্যাঙ্কিং হারায়। মার্কেটে র্যাঙ্কিং না থাকলে পরবর্তীতে নতুন ক্লায়েন্ট আসায় ব্যাঘাত ঘটে। একদিন হলে সেটা হয়তো ম্যানেজ করা যেতো কিন্তু পাঁচদিন হয়ে যাওয়ায় এখন শঙ্কায় কাটছে সময়,” বলেন মি. শিশির।
যা বলছেন ব্যবসায়ীরা
এ খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় সব ব্যবসার ক্ষতি হলেও এ খাতের ক্ষতির পরিমাণ একটু বেশিই। কারণ যারা সফটওয়ার ব্যবসায় জড়িত তাদের ব্যবসার লাইফ লাইনই হচ্ছে ইন্টারনেট।
কিন্তু অন্য ব্যবসার সাপোর্ট লাইন হিসেবে ইন্টারনেট কাজ করে। একইসাথে ই-কমার্স খাতও ইন্টারনেট ছাড়া চলে না।
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে যে বাজার তৈরি করতে পেরেছেএবং বিদেশি ক্লায়েন্টদের কাছে আস্থার জায়গায় পরিণত হয়েছে এবারের পরিস্থিতিতে সেটি অনেকটাই হুমকির মুখে পড়েছে।
ইন্টারনেট না থাকার কারণে তাদেরএবং ক্লায়েন্টদের সাথে যোগাযোগ করে কিছু জানাতে না পারায় যে অনাস্থা তৈরি হয়েছে তাতে তারা বিকল্প বাজারের দিকে চলে যাওয়ার শঙ্কা আছে বলে মনে করছেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতের ব্যবসায়ীরা।
সফটওয়ার কোম্পানি ভাইজার এক্স লিমিটেডের এমডি ও সিইও ফয়সাল মোস্তফা বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমরা সফটওয়ার এক্সপোর্ট করি। আমাদের ক্লায়েন্টদের সাথে কানেক্টিভিটি চলে গেছে। এতোদিন ধরে ক্লায়েন্টদের সাথে কানেকশন না থাকায় অনেক ক্লায়েন্টই চিন্তা করছে আমি অলটারনেটিভ অপশন বের করি। ভবিষ্যতে আবারও এরকম সমস্যা হবে না সেটিরও নিশ্চয়তা নেই।”
“তারা বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন দেশের কথা ভাবছে। ভারত, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন এই ধরনের দেশে বিজনেসগুলো চলে যেতে পারে। এখনও ক্লায়েন্টদের সাথে কানেকশন করতে পারিনি। যদি কানেকশন ডিল করতে পারি তখন বলতে পারবো আদতে ক্ষতি কতটুকু হয়েছে,” বলেন মি. মোস্তফা।
এ খাতের বিদেশি ক্লায়েন্ট হারালে সেটা দেশের চাকরির বাজারেও প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
মি. মোস্তফা বলেন, “এই ক্ষতির প্রভাব জব মার্কেটেও পড়বে। যেসব ক্লায়েন্টরা চলে গেছে তাদের বিপরীতে যতজন এমপ্লয়ী ততজনের জবের উপর ওই প্রভাব পড়বে। চাকরি চলে যাবে অনেকের। কারণ আমি ক্লায়েন্ট হারালে তাদের কীভাবে রাখবো।”
যা বলছে বেসিস
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস)।
এই সংগঠনটির দাবি ইন্টারনেট সংযোগ না থাকার কারণে গত কয়েক দিনে এ খাতে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে পাঁচশ কোটি টাকা।
বেসিসের সভাপতি রাসেল টি আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “লোকাল মার্কেটের বাইরে ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে যে ব্যবসাটা করা হয় সেই সফটওয়ার রপ্তানি সেবায় প্রায় সবাই বিদেশি ক্লায়েন্ট। এই ব্যবসার পুরোটাই লাইভ স্ট্রিমিং এর মতো। ফুলটাইম লাইভে থাকা হয়। এখন পুরো রপ্তানি খাতটা জিরোতে চলে আসছে।”
“রপ্তানি-মুখী এ কাজে দৈনিক ঘণ্টার ভিত্তিতে বিল করা হয়। ইন্টারনেট না থাকায় প্রতিদিন ৮০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হচ্ছে। অর্থাৎ এ খাতে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। এটা শুধু এক্সপোর্টের ক্ষেত্রে,” বলেন মি. আহমেদ।
সফটওয়ার খাতে অনলাইনে লাইভে পুরো কাজ করতে হয় বলে ইন্টারনেট না থাকায় সেবা রপ্তানি একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ থেকে যেসব কোম্পানি বা ফ্রিল্যান্সাররা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সার্ভিস দিচ্ছিলেন এমন অনেক সেবা বন্ধ হয়েছে বলে জানান মি. আহমেদ।
এর ফলে ক্লায়েন্টরা আস্থা হারিয়েছে এবং অনেকে খারাপ রিভিউ দিয়ে বাংলাদেশ থেকে সেবা নেয়া বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলেও খবর পাওয়া গেছে। এসব ক্লায়েন্টদের আস্থা অর্জন করে আবার তাদের ফিরিয়ে ওই বাজার পাওয়া বেশ কঠিন ব্যাপার হবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীদের এই সংগঠনের নেতারা বলছেন, দৈনন্দিন ক্ষতির চেয়ে এখন স্থায়ী ক্ষতি নিয়ে বেশি চিন্তিত তারা। আবার এই ক্ষতির হার করপোরেট কোম্পানির চাইতে ফ্রিল্যান্সারদের বেশি পোহাতে হবে বলে মনে করছেন তারা।
মি. আহমেদ বলেন, “ফ্রিল্যান্সারদের জন্য বিষয়টি আরো বেশি চ্যালেঞ্জিং। কারণ করপোরেট লেভেলে সার্ভিসের ক্ষেত্রে তাদের ফোন নম্বর থাকে ফলে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা যায়। অথবা বিদেশে কোনো বন্ধুদের সাহায্যেও ই-মেইল করে যোগাযোগের চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু ফ্রিল্যান্সাররা ওয়েবসাইট থেকে কাজ পায় আবার সেখানেই ডেলিভারি করে। তারা ক্লায়েন্টদের ফোন নম্বরও দেখে না। ফলে যোগাযোগ করা সহজ ছিল না। তারা কন্ট্রাক্টও হারাবে। খারাপ রিভিউ দিলে ভবিষ্যতে কাজ করা কঠিনও হয়ে যাবে।”
ইন্টারনেটের জন্য এ খাতের অনেক সার্ভিস প্রোভাইডার নিজেদের সাধ্য অনুযায়ী কলকাতা, নেপাল এবং দুবাইতেও চলে গেছে। অন্তত এর মধ্যে যতটুকু সম্ভব সার্ভিস দেয়া যায় এবং ক্লায়েন্টদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা যায় সে চেষ্টাই অনেকে করেছেন বলে বিবিসি বাংলাকে জানান ব্যবসায়ীরা।
মি. আহমেদ স্বল্প পরিসরে ইন্টারনেট পাওয়া শুরু করেছেন জানিয়ে বলেন, “এখন চেক করছি সবগুলো সার্ভিস পাচ্ছি কি না। অনেকগুলো সার্ভিস যেহেতু বন্ধ আছে, সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ সেটি আমাদের প্রয়োজন নেই। তবে, গুগল সার্ভিসের বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছি। কারণ এটা দিয়ে অনেক ধরনের সার্ভিস দেই আমরা।”
“সব এলাকায়তো ইন্টারনেট নেই। তবে বিটিআরসির কাছ থেকে সহযোগিতা পাচ্ছি। যেসব এলাকায় নেই সেখানে আমাদের মেম্বার কোম্পানির নাম পাঠিয়ে দিচ্ছি। তাদের বিটিআরসি ফেইজ বাই ফেইজ অন করছেন,” বলেন মি. আহমেদ।