ভারত শাসিত জম্মু ও কাশ্মীরে কয়েক বছরের মধ্যে সবথেকে ভয়াবহ হামলাটি হয় গত নয়ই জুন। হিন্দু তীর্থযাত্রীদের নিয়ে যাওয়ার পথে একটি বাসে সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যরা গুলি চালালে নয়জন নিহত হন এবং ৩০ জন আহত হন।
ওই হামলাটা হয়েছিল জম্মু অঞ্চলের রিয়াসিতে জেলায়। সেনা সদস্য ও বেসামরিক নাগরিকদের ওপরে এই অঞ্চলে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ঘটা বহু হামলার সাক্ষী এই জম্মু অঞ্চল।
জম্মু অঞ্চলে ধারাবাহিকভাবে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলির হামলা চললেও শনিবার সকালে কাশ্মীর উপত্যকাতেও সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যদের সঙ্গে ভারতীয় বাহিনীর গুলি বিনিময় হয়েছে। নিয়ন্ত্রণ রেখা লাগোয়া কুপওয়ারা জেলার মাছল সেক্টরের ওই ঘটনায় একজন ‘পাকিস্তানি’ নাগরিক মারা গেছেন বলে ভারতীয় সেনাবাহিনী জানিয়েছে।
সংবাদ সংস্থা এএনআই সেনা অফিসারদের উদ্ধৃত করে জানিয়েছে যে ওই ঘটনায় একজন সেনা সদস্য নিহত ও চারজন আহত হয়েছেন।
ভূস্বর্গ কাশ্মীরে সহিংসতা নতুন নয়, তবে বিশেষজ্ঞদের যে বিষয়টা ভাবাচ্ছে তা হলো সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলির কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র এখন কাশ্মীর উপত্যকা থেকে সরে এসেছে জম্মু অঞ্চলে।
কাশ্মীর নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বন্দ্ব বেঁধে রয়েছে। দুই প্রতিবেশী পরমাণু-শক্তিধর দেশ মুসলমান প্রধান এই কাশ্মীর নিয়ে দুটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ আর একটি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে।
ভারত-শাসিত অঞ্চলটিতে দিল্লির শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ সেই ১৯৮৯ সাল থেকে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।
এ বছর আটটি হামলা, মৃত ১২
ভারত সরকার বলছে, সাবেক জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যকে বিশেষ স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার যে সাংবিধানিক ধারা ছিল, সেটি ২০১৯ সালে বাতিল করার পর থেকে সহিংসতা কমে এসেছে।
তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে, বিশেষ করে জম্মুতে সহিংসতা খুব বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মনে হচ্ছে। এর ফলে ওই অঞ্চলে একটা আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সাল থেকে জম্মুতে ৩৩টি সশস্ত্র হামলার ঘটনা ঘটেছে। শুধু ২০২৪ সালেই এই অঞ্চলে আটটি হামলা হয়েছে, যাতে ১১ জন সেনাসদস্য নিহত ও ১৮ জন আহত হয়েছেন। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে জম্মুতে ১২ জন বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। ওই একই সংখ্যক মানুষ ২০২৩ সালেও মারা গিয়েছিলেন।
জম্মু ডিভিশনের রাজৌরি, পুঞ্চ, ডোডা, কাঠুয়া, উধমপুর, রিয়াসি সহ অন্যান্য এলাকায় এইসব হামলা হয়েছে।
কাশ্মীর উপত্যকার মতোই জম্মুও নিয়ন্ত্রণ রেখার কাছে। এই নিয়ন্ত্রণ রেখাই কার্যত ভারত আর পাকিস্তানের সীমান্ত। ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে ড্রোনের মাধ্যমে সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যদের অস্ত্র, মাদক ও অর্থ সরবরাহ করার অভিযোগ করেছে দিল্লি।
পাকিস্তান অবশ্য এই অভিযোগের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জম্মুতে সাম্প্রতিক হামলাগুলি থেকে বোঝা যাচ্ছে যে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলির কার্যকলাপ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলটির আরও গভীরে ছড়িয়ে পড়েছে।
জম্মু দুই দশক ধরে শান্ত
কেউ কেউ বলছেন, এর একটি কারণ হতে পারে উপত্যকায় নিরাপত্তা বাহিনী ও গোয়েন্দাদের ব্যাপক উপস্থিতির ফলেই সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলিকে দক্ষিণ দিকে সরে যেতে বাধ্য করেছে। আবার কেউ মনে করছেন, জম্মু ও কাশ্মীরের নানা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা থেকে সেনাবাহিনীর নজর ঘোরানোর ইচ্ছাকৃত চেষ্টা করা হচ্ছে।
সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলির কর্মকাণ্ড শুরু হওয়ার পর থেকে উপত্যকাই থেকেছে সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দুতে, যদিও ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে জম্মুতেও ওই সব গোষ্ঠী ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু ২০০২ সাল থেকে জম্মু অঞ্চল তুলনামূলক ভাবে শান্তই থেকেছে।
জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক রক্ষাকবচ ২০১৯ সালে সরিয়ে নেওয়ার দুবছর পরে, ২০২১ সাল থেকে জম্মুতে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলির তৎপরতা বেড়েছে। গত কয়েক মাসে একের পর এক হামলা জম্মু ও কাশ্মীরের পুরো নিরাপত্তা ব্যবস্থাকেই ব্যস্ত করে রেখেছে।
অত্যাধুনিক অ্যাসল্ট রাইফেল নিয়ে জঙ্গল যুদ্ধে প্রশিক্ষিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলির সদস্যরা নিরাপত্তা বাহিনীর নজর এড়ানোর জন্য জম্মুর জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলগুলি ব্যবহার করছে বলে জানা যাচ্ছে।
দুর্গম এলাকা বেছে হামলা
জম্মু অঞ্চলের দুর্গম এলাকা আর যেসব জায়গায় সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভাল নয়, সেই সব এলাকা বেছে বেছেই এই হামলাগুলি চালানো হয়, ফলে নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষে সময়মতো ঘটনাস্থলে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়ে।
অতি সম্প্রতি ডোডা এলাকায় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলির নিহত এক সেনাসদস্যর বাবা, অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ভুবনেশ থাপা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময়ে জানিয়েছিলেন, যে তল্লাশি অভিযানে বেরনোর ঠিক আগেই তার ছেলের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছিল।
ফোনে সেই সেনা সদস্য বাবাকে জানিয়েছিলেন যে তাদের টিমটি এমন এক জায়গায় অভিযানে বেরচ্ছে, যেখানে পৌঁছনোর জন্য পাহাড়ি পথে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা ট্রেক করে যেতে হবে তাদের।
উপত্যকায় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলিকে দমনের কাজে নিয়োজিত ছিলেন, এমন একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা শেষপাল ভৈদ মনে করেন, কাশ্মীর থেকে নজর ঘোরাতেই জম্মুতে সশস্ত্র হামলার সংখ্যা বেড়েছে।
সশস্ত্র হামলার সংখ্যা বৃদ্ধির পেছনে তিনি চীন ও পাকিস্তানের একটি সুপরিকল্পিত নীতি রয়েছে বলে তিনি মনে করেন, যাতে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে অনেকটা জায়গা জুড়ে অভিযান চালাতে হয়।
জম্মুতে দুর্বল গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক?
পাকিস্তানের মতোই চীনের সঙ্গেও বিতর্কিত একটা সীমান্ত রয়েছে লাদাখে। কেন্দ্রশাসিত এই অঞ্চলটি জম্মু-কাশ্মীরের পুব দিকে। সেখানে রয়েছে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বা এলএসি।
লাদাখ অঞ্চলে ২০২০ সালে ভারতের সঙ্গে চীনের নতুন করে সীমান্ত বিরোধ শুরু হয়। আর তারপর থেকে ভারত বাধ্য হয়েছে লাদাখে বাড়তে সৈন্য পাঠাতে। এই সেনাসদস্যদের জম্মু থেকেই লাদাখে পাঠানো হয়েছে বলে জানা যায়। এর ফলে জম্মু অঞ্চলে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলির সক্রিয়তা বেড়ে গেছে।
দীর্ঘদিন ধরেই ভারতের কৌশলগত বিশেষজ্ঞদের কাছে এটা একটা চিন্তার বিষয় যে উত্তর ও পশ্চিম সীমান্তে দুটি ফ্রন্টে যদি একসঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়।
জম্মুতে সেনাবাহিনীর মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুনীল বার্তওয়াল বিবিসিকে বলেছেন, “বিদেশি সন্ত্রাসীদের নির্মূল করতে” সেনাবাহিনী পুলিশের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে “যৌথ এবং সমন্বিত অভিযান” চালাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, এই অঞ্চলের বিভিন্ন নিরাপত্তা এজেন্সির মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
কিছু বিশেষজ্ঞ আরও উল্লেখ করেছেন যে ২০০২ সাল থেকে তুলনামূলক ভাবে কম সহিংসতার কারণে কাশ্মীরের তুলনায় জম্মুতে ভারতের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ততটা উন্নত নয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাফর চৌধুরী বলছেন, “গত তিন দশক ধরে জম্মুতে নয়, কাশ্মীরে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলির মোকাবেলার জন্য বিশেষজ্ঞ অফিসারদের মোতায়েন করা হয়েছে। তারা বছরের পর বছর ধরে কাশ্মীর উপত্যকাটা বুঝে গেছে, কিন্তু জম্মুটা তত ভাল চেনেন না এরা।“