বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে বিক্ষোভ ও এ নিয়ে সহিংসতার শুরুর পর সারাদেশে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়ে যায়। প্রথমে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করা হলেও এর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটও।
প্রায় দুই সপ্তাহ পর কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে ইন্টারনেটের গতি। চালু হয়েছে ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটকের মতো সোশ্যাল মিডিয়াও।
বুধবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা ইন্টারনেট বন্ধের কারণ জানাতে গিয়ে তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেছেন, ফেসবুক, ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের ভুল তথ্য ছড়ানো কারণেই এগুলো বন্ধ করা হয়েছিল।
কিন্তু ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধের পরও বিক্ষোভ কিংবা সহিংসতা কমেনি বরং বেড়েছে আরও। শেষ পর্যন্ত কারফিউ জারি ও সেনা মোতায়েন করে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করেছে সরকার।
পুরোপুরি পাঁচদিন সব ধরনের ইন্টারনেট সেবা বন্ধের পরে যখন চালু হয়েছে তখনও তা ছিল নামে মাত্র। এটি এতটাই ধীরগতির ছিল যে অতি সাধারণ কাজ করতেও দীর্ঘ সময় লেগে যাচ্ছিল ব্যবহারকারীদের।
অবশ্য শুধু বাংলাদেশেই নয়, ভিন্নমত, প্রতিবাদ কিংবা বিক্ষোভ দমনে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ইন্টারনেট বন্ধ রাখার নজির আছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইন্টারনেট বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করে বিক্ষোভ দমনের সরকারের কৌশল কোনো কাজে লাগেনি বরং হিতে বিপরীত হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশন ডিসঅর্ডার বিভাগের চেয়ারম্যান শারমীন আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ইন্টারনেট বা সামাজিক যোগাযোগ বন্ধ রেখে পরিস্থিতি হয়তো সাময়িকভাবে সামাল দেয়া যায়, তবে এতে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ে, ভুল তথ্যও ছড়ায় বেশি।”
ইন্টারনেট-সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ ও পরে ধীরগতির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে এর ওপর নির্ভরশীল ব্যবসায়িক খাতসমূহ।
বিক্ষোভ দমনে ইন্টারনেট বন্ধ কতটা কার্যকর?
শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে বিক্ষোভ ও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার পর গত ১৯শে জুলাই মধ্যরাত থেকে সারা দেশে কারফিউ জারি করে সরকার।
এর আগে গত ১৭ই জুলাই বুধবার মধ্যরাত থেকে মোবাইল ইন্টারনেট সেবা এবং ১৮ই জুলাই বৃহস্পতিবার রাতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
গত ১৮ই জুলাই বৃহস্পতিবার রাত পৌনে নয়টায় যখন পুরোপুরিভাবে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়ে যায়, তখনও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় চলছিল বিক্ষোভ ও সহিংসতা।
হঠাৎ করে ইন্টারনেট সেবা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ওই রাতে মোবাইল নেটওয়ার্কও কাজ করছিলো না খুব একটা।
দেশের ভেতর মোবাইল ফোনে যোগাযোগের ক্ষেত্রেও ভোগান্তিতে পড়েছিলেন ব্যবহারকারীরা।
এই আন্দোলন ঘিরে সবচেয়ে বেশি বিক্ষোভ ও সংঘর্ষ বাঁধে পরদিন শুক্রবার। এই দিন রাজধানী ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বেশ কয়েকটি জায়গায় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এতে বড় ধরনের হতাহতের ঘটনা ঘটে।
ইন্টারনেট বন্ধ থাকাকালীন দেশের বাইরে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিরা পরিবারের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইন্টারনেট বন্ধ করে সাময়িকভাবে উত্তেজনা দমন করা গেলেও বিক্ষোভ নিরসন সম্ভব নয়। বরং এই সময়ে ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় সংঘাত বেড়েছে বলেও মনে করেন কেউ কেউ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক রাশেদা রওনক খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ইন্টারনেট বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করে বিপ্লব দমন করা যায় না। বরং এগুলো চালু রেখে রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে গুজব কিংবা বিক্ষোভ নিরসনে কাজ করতে হয়।”
“যতদিন ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ ছিল মানুষ বিকল্প হিসেবে ভিপিএন ব্যবহার করেছে। এসময় ভুল তথ্য ও বিভ্রান্তি আরো বেশি ছড়িয়েছে,” বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শারমীন আহমেদ।
সাধারণ মানুষকে ভিপিএন’র মাধ্যমে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে বিরত থাকতে বলা হয় সরকারের পক্ষ থেকে। তবে এই সময়েও ফেসবুক ব্যবহার করে বিভিন্ন পোস্ট শেয়ার করেছেন তথ্য প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।
অন্য দেশে ইন্টারনেট বা সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ হয় কেন?
প্রতিবাদ, ভিন্নমত কিংবা বিক্ষোভ দমনে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ইন্টারনেট বন্ধ রাখার নজির আছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের।
মিশরে ২০১১ সালের বিপ্লব এবং ২০১৬ সালের ব্যর্থ তুর্কি সামরিক অভ্যুত্থানের সময় ইন্টারনেট বন্ধ করতে দেখা যায়। ভারতেও বিভিন্ন সময় ইন্টারনেট শাটডাউনের ঘটনা ঘটেছে। তবে বাংলাদেশে যত দীর্ঘ সময় ধরে ইন্টারনেট বন্ধ ছিল এটি বেশ বিরল।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কনটেন্ট ডেলিভারি নেটওয়ার্ক ক্লাউডফ্লেয়ারের আউটেজ সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, ইন্টারনেট বিভ্রাটের শুরুতে আছে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ সিরিয়া। ২৫ জুলাই দেশটিতে কয়েক ঘণ্টার জন্য সরকারের নির্দেশে ইন্টারনেট বন্ধ ছিল। সিরিয়ার পরেই বাংলাদেশ।
১৭ই জুলাই মধ্যরাত থেকে বাংলাদেশে ইন্টারনেট বন্ধ দেখানোর বিষয়টি উল্লেখ করে ক্লাউডফ্লেয়ার। সেখানে সরকারের নির্দেশে বন্ধের বিষয়টি বলা হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গণতন্ত্র সুসংহত নয়, এমন দেশগুলোতে এ রকম পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।
রাশেদা রওনক খান বলেন, “যে সব দেশে রাজতন্ত্র রয়েছে বা গণতন্ত্র সুসংহত নয় সেখানে ইন্টারনেট বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম খুব সার্ভিলেন্সের মধ্যে রাখা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের মতো গণতান্ত্রিক দেশে ইন্টারনেট বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করে বিক্ষোভ বন্ধ করা যৌক্তিক সমাধান না।”
এর আগে, বাংলাদেশে বেশ কিছু ঘটনার প্রেক্ষিতে ফেসবুকসহ কয়েকটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ করা হলেও এমন ব্যাপক পরিসরে ইন্টারনেট শাটডাউনের ঘটনা ঘটেনি।
প্রায় ১৩ দিন বন্ধ থাকার পর বুধবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউবের প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠকের এগুলো চালু করা হয়।
সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ ও চালু নিয়ে সরকারের ব্যাখ্যা
গত ২৪শে জুলাই ব্রডব্যান্ড ইন্টারেনেট এবং ২৮শে জুলাই মোবাইল ইন্টারনেট চালু হলেও বন্ধ ছিল কিছু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।
বুধবার এসব আনুষ্ঠানিকভাবে এসব প্রতিষ্ঠানের সাথে বৈঠক করে সরকার।
ওই বৈঠক শেষে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ রাখার কারণ আনুষ্ঠানিকভাবে জানান।
তিনি জানান, সাম্প্রতিক সহিংসতার সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন মিথ্যা ও সাজানো খবর ছড়ানো হয়েছে। এসব খবরের বিষয়ে এসব সামাজিক মাধ্যমকে জানানো হলেও তারা এর মাত্র ২০ মাত্র শতাংশ সরিয়েছে, বাকিটা সরায়নি।
সরকারের তরফ থেকে এ বিষয়ে তাদের কাছে আপত্তি জানানোর পরও সেগুলো না সরানোয় এতদিন বন্ধ ছিল ফেসবুক-ইউটিউবসহ এসব সোশ্যাল মিডিয়া।
তবে, ইন্টারনেট বা সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধের কারণে ব্যবসায়িক নানা ক্ষতির বিষয়টি সরকার আমলে নিয়েছে।
বুধবারের সংবাদ সম্মেলনে মি. পলক বলেন, “আমাদের ফ্রিল্যান্সার, উদ্যোক্তা, ব্যবসায়িক সম্প্রদায়, স্কুল-কলেজের ছাত্র-শিক্ষক,গবেষকদের জন্য এগুলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্লাটফর্ম। সব কিছু চিন্তা করেই আমরা এই বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করে নিয়েছি।”
প্রায় দুই সপ্তাহ পর বুধবার দুপুরের পর থেকেই ভিপিএন ব্যবহার ছাড়াই ফেসবুকসহ অন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রবেশ করতে পারছিলেন ব্যবহারকারীরা।
ব্যবসায়িক ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব?
বাংলাদেশে ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ থাকার সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে এর ওপর নির্ভরশীল ব্যবসা খাতে। নানামুখী ক্ষতিতে পড়েছেন তথ্য প্রযুক্তি খাতের ব্যবসায়ীরা।
তথ্য প্রযুক্তি খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, আর্থিক ক্ষতির চেয়ে ইমেজ সংকটে পড়তে হয়েছে সবচেয়ে বেশি। কেননা বিদেশি ক্লায়েন্টরা চুক্তি অনুযায়ী কাজ না পেয়ে অনেকের অর্ডার বাতিল করে দিয়েছে।
আবার কোনো কোনো উদ্যোক্তা এই সংকটে ছুটে গিয়েছেন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত কিংবা নেপালে।
ফ্রিল্যান্সার হাসিব ইমতিয়াজ বিবিসি বাংলাকে জানান, তিনি বিদেশি বিভিন্ন ক্লায়েন্টের কাজ করতেন। ইন্টারনেট বন্ধ হওয়ার আগে তিনি নেদারল্যান্ডসের দুটি কোম্পানির কাজের অর্ডার নিয়েছিলেন।
মি. ইমতিয়াজ বলেন, “আমাকে ওরা দুই বার মেইল দিয়েছে। ইন্টারনেট না থাকায় কোনো উত্তর না পেয়ে তারা আমারে মেইল করেছে- আর ইউ নো মোর?”।
“ইন্টারনেট যখন চালু হয়েছে, তখন মেইল দেখে তাদের সাথে যখন যোগাযোগ করেছি ততক্ষণে তারা এই কাজ অন্য জায়গায় দিয়ে দিয়েছে,” বলছিলেন মি. ইমতিয়াজ।
তবে অন্য যাদের হাতে বড় কাজ ছিল, তাদের অনেকে ভারত কিংবা নেপাল গিয়ে ক্ষতির হাত থেকে বাচার চেষ্টা করেছেন বলে জানান ওই ফ্রিল্যান্সার।
“আমার সাথেই কাজ করতো আমার দুই বন্ধু। ওদের ওয়ার্ক অর্ডার ছিল বেশি। ভিসা ছিল। ওরা দ্রুত কলকাতা চলে গেছে কাজ চালিয়ে নেয়ার জন্য,” জানান মি. ইমতিয়াজ।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস)- এর দাবি ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় যে ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করছে এ খাতের উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা।
বেসিসের সভাপতি রাসেল টি আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “প্রথমে বন্ধ ও পরে স্লো ইন্টারনেটের কারণে আমার কোনো কাজই করতে পারছিলাম না। এখন ইন্টারনেট এসেছে, এটা স্ট্যাবল থাকলে আমরা ক্ষতি রিকভার করার চেষ্টা করতে পারবো। নাহয় সংকট থেকেই যাবে।
বুধবারের বৈঠক শেষে তথ্য প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন, এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে এই খাতের ব্যবসায়ীদের জন্য প্রণোদনার চেষ্টা করছেন তিনি।